ধারাবাহিক উপন্যাস: দিদার চৌধুরী'র "হৃদয়ের কান্না" -১১




শিউলী তার স্বামীর নীরব কষ্টের ভাষা বুঝে নিতো। চুপি চুপি গিয়ে তার স্বামীর পাশে বসলো । গায়ে একটি সাদা রংয়ের  শাল , চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা ,মলিন তার মুখের ভাব। স্বামীর মনকে হালকা করার জন্য , যে সকল কথা পূর্বেই কত শত বার বলেছে, শিউলী আজও সেই সকল কথা বলে যাচ্ছে। সে  তার স্বামীকে বলল,
:  মিছে মিছে ভাবনা করে আর কি লাভ? ঈশ্বর যাহা দেননি তা পাওয়ার জন্য অধির আগ্রহ আর কতকাল? এমনিতেই তো বেশ সুখে আছি। জীবন তো আর থেমে থাকিনি?
শিউলীর কথাগুলি ঝম্পক রায় শুনছে কিনা জানিনা। কিন্তু কথাগুলো যে তার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করতে পারেনি তার স্পষ্ট বুঝা গেল। কথাগুলো শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরা শব্দের সাথে বিলীন হয়ে গেল। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি, শ্রাবণের অঝোর ধারায় ঝরছে।

বিধাতা যাকে সমাজ পরিচালনার করার ন্যায় দন্ড হাতে তুলে দিয়েছেন। যার হাতে সমাজ তথা জাতির ন্যায় বারতা প্রচার এর জন্য ভার দিয়েছেন। তাকে কেন এক রমণীর মুখের মলিনতা দূর করবার শক্তি দেননি। যেই সমাজে নারী তার অধিকার আদায়ের অপারগ, সেখানে সমাজে এক বিচারক হয়ে বহুরূপতার মূল্য কোথায়? একজন ন্যায়দন্ডর বাহক হয়ে স্ত্রীর অধিকার আদায়ের সচেষ্ট নই। এরথেকে বড় অপবাদ আর কি হতে পারে? হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটায় ধ্যানমগ্নতা ভেঙে গেল চম্পক রায়ের। দেখল পাশে স্ত্রী শিউলী বসে আছে।  তার দৃষ্টি বৃষ্টি পড়া মরে যাওয়া একটি লাউ গাছের ডগার উপর। যেখান থেকে একটি কুঁড়ি সহ দুটি কুমড়ো ঝুলে আছে । হাওয়ায় মৃদু ঝুলছে। সে দৃশ্য মনকে ভাবিয়ে তোলে, মনকে করে তোলে  অচৈতন্য। প্রশস্ত একটি হাত নিস্তব্ধতার মাঝে ও তার স্ত্রীকে স্পর্শ করল। শিউলী  স্পর্শ অনুভূতি বুঝে নিয়ে- তার দিকে তাকিয়ে বলল,
: কি মনটা খারাপ?
চম্পক রায় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
: কই না তো, মন খারাপ হতে যাবে কেন?
: তাহলে এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে আছো যে।
: কতক্ষণ?
তারপর কিছুক্ষণ আর তাদের দু'জনার কথা হয়নি, একটু পর শিউলীকে ডেকে বলল,
: শুনছ? 
শিউলী উদাসীন ভাবে জবাব দিল।
: হু।
: চা হবে, একটু গরম চা?

শিউলী চম্পক রায়ের দিকে দু চোখ তুলে তাকিয়ে, তারপর চা আনার জন্য চলে গেল।
চম্পক রায়ের দীর্ঘক্ষণ চেপে থাকা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস তীব্র ভাবে প্রবাহিত হয়ে গেল। এই দীর্ঘ নিশ্বাস হাজারো প্রশ্নের বাহক।
দীর্ঘদিন দুজন মানুষ পাশাপাশি থাকলে কখনো চাহিদার তাগিদে , কথা কাটাকাটি হয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হয়, হয় কুটুক্তি, কটাক্ষতা।
কিন্তু কি অদ্ভুত দর্শন, স্বার্থের সংঘাত, অতুষ্টিকর  এর পরিসীমা কখনো অতিক্রম করেনি অতৃপ্ত শিউলী। অতীতকে ভেদি প্রশ্ন দাঁড়ায় অদূর ভবিষ্যতের প্রান্তে। 
সারা জীবন কি আমার দুয়ার হতে রিক্ত হস্তে বিদায় নেবে ,অসাধারণ এই শিউলী?
চম্পক রায়ের আজ কেন যেন বারবার মনে পড়ছে তার শৈশবের এক স্মৃতি। দুরন্ত ছাত্র জীবনের কথা। পেটের ভিতর কিসের যেন একটি টিউমার হয়েছিল। অনেক কষ্ট ও ব্যথা পোহাতে হয়েছিল তাকে। শেষটায় ডাক্তারের পরামর্শে অপারেশনের করার জন্য কলকাতায় পাঠানো হলো তাকে। যে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে ছিল, তিনি এক বিশ্ব বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন। পুরো ভারতবর্ষের ছিল তার নাম যশ।  কিন্তু  মাঝেমধ্যে নেশা করা ছিল তার বদভ্যাস।
তবে কি সেই ডাক্তার‌ই আমার জীবনের মূল্য স্পষ্ট করে দিয়েছি সে দিন?
এখন কি শুধু বেঁচে থাকার জন্য ? জীবনের কাছে উপভোগের কি কোনো মূল্যই নেই?
পরে জানতে পারলাম , সে ডাক্তারের এক অসতর্কতার জন্য আমার একটি কিডনির ক্ষতি হয়েছে। এবং তার সাথে সাথে শরীরের নানাবিধ উপসর্গ দেখা দিয়ে যাচ্ছে। তাই আজ এই অবর্ণনীয় অসহনীয় জীবনের সূত্রপাত। এ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা অর্থ পাষানের মত বুক চেপে বেঁচে থাকা। বৃথাই হতাশার জীবন অতিবাহিত করা। ডাক্তারের একটু ভুলে আমার জীবনটাই আর চির ভুলের পরিণত হয়েছে।
নানাবিধ চিন্তায় আজ চম্পক রায়কে উদ্বেলিত করে। মানসিক বিপর্যয়ে পতিত করে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ সেই চিন্তার পটভূমিকে আরো প্রসারিত করে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর ব্যথার অনুভব একাকার হয়ে যায়।
শিউলী  গরম চা নিয়ে আসলো। চায়ের কাপে  বাষ্পকনা উপরের দিকে উঠে আসছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চম্পক রায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিউলীর দিকে। তখনো তার ঘোর কাটেনি।  সুন্দর এই পৃথিবীতে এভাবে বেঁচে থাকার অর্থ কোথায়? মনে মনে একটি প্রতিশোধের দুর্বার আগুন পরিকল্পনার দোলা ,মনে দুর্ভেদ্য করে তুলল।

ন্যায় ও সত্যের সেবক হয়েও ন্যায়  বিচারের প্রতি অনীহা এসে গেল। দুষ্কৃতী ও দায়িত্ব অসচেতনতা কখনো ডাক্তারের হতে পারে না। বরং প্রতিনিয়ত হাজারো জীবনের বিনাশের হেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার কৃতকর্মের অনেক অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সে বেঁচে যায় আইনের‌ই জন্য।

কিন্তু না, এই বার এই দুশমনকে আইনের আঘাতে ক্ষয় করব না। হয়তো আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সে রেহাই পেয়ে যাবে। তাতে তার জন্য ন্যায় বিচার হবে না বরং সবকিছু জেনেশুনে তার প্রতি সহযোগিতায় হবে। তার জন্য পুরাতন বাক্সে লুকায়িত যন্ত্রের একটি ক্ষুদ্র অংশই যথেষ্ট। দুশ্চিন্তার অবশেষ করে ,মনের মাঝে একটু সুখ অনুভব হল।
একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, চম্পক রায় বলে উঠলো, জীবনে আর কি চাই! শ্রাবণের বারিধারা সাথে সময়ের ধারা প্রবাহমান। নিস্তব্ধতা পাশাপাশি নিঝুম অন্ধকার চারিদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসলো।হিমেল বাতাস মৃত শীতের পরশ বুলিয়ে দিল ,এমন সময় শিউলি বললো,
: চলো ভেতরে চলো শীত লাগছে।
চম্পক রায় শিউলীর দিকে তাকিয়ে বলল,
: চলো।


দীর্ঘ আট বছর ভবঘুরে জীবন কাহিনী ইন্ধন নিজ গ্রামে  আজ‌ই আসলো মাত্র। কিন্তু গ্রামের কোথাও কোন বাড়িতে উঠল না। বাউন্ডুলে জীবন নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে তার। ভাবনা নেই বলে জীবনটা ভবঘুরের বিলাস বিভ্রম। বিলাসিতা আর রঙের বাহার তার কাছে ক্ষনিকের মাত্র।
শরীর ও বাহ্যিক পরিবর্তনের কারণে গ্রামের প্রায় লোকজনকে চিনতে পারলো না ইন্ধনকে। না চিনুক তাতে কি আসে যায়। দিনা আর রাতের হিসাব কে রাখে। অথচ দিন আর রাত প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে।
আর আট বছর পরে কে আসলো কে গেল। গ্রামের মানুষ সেই হিসাব কোথায় কে রাখে। সেই হিসাব রাখা কি সমোচিত? দিনকাল এর পাশাপাশি  সময়ের পরিবর্তন‌ও ঘটছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তন হবে না তা কি ঠিক? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নানাবিধ কর্মকোলাহল, জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত মানুষ ছুটে চলছে।
সমাজে পরিদর্শক হিসেবে সে নয়। যে সমাজে পরিত্যক্ত হিসেবে পরিগণিত। আর সেখানে তো তবে কথাই নেই।
ইন্ধন গ্রামে আসেই শিউলীর স্মৃতি যেন তাকে আঘাত করে। শিউলির কথা মনের গহবরে পলে পলে নির্মম কষাঘাত করে যায়। 
শীত যায় ,বসন্ত যায় একে একে বছর ও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবনের জ্বালানী শেষ হয়না।
শুধু জ্বলে ওঠে যন্ত্রণার জ্বালামুখ।
শিউলীর দেওয়া সেই বস্ত্র উপহার আজও গায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব করছে। সেই শালখানা এখনো পরম মমতায় গায়ে জড়িয়ে আছে।  প্রায় ছিন্ন সেই বস্ত্র আজো যেন হৃদয়ের প্রাণ হয়ে অন্তিম অবস্থা অবধি অপেক্ষা করছে। স্মৃতি সে যেন এক কঠোর আজ্ঞা পালক। ভুলেও ভুল করা যায় না, স্মৃতি ঠিক এই মনে পড়ে যায়।

ইন্ধন গ্রামে এসে শুধু উৎপলের অনুসন্ধান করেছিল মাত্র। কিন্তু উৎপলের উপস্থিতির ধৈর্য ধরা মুশকিল এই ভবঘুরে ইন্ধনের। তাই আর দেখা হয়নি ইন্ধন-উৎপলের।
মা বোনদের সাথে সেবারও দেখা আর হয়নি। জীবনের কথারম্ভার মধ্যে হারিয়ে গেছে তার জীবন। 
পুনরায় বাহির হল জীবনের পথে ,সেই পথের কি আর শেষ আছে?
হাজারো অত্যা*চারী জীর্ণ শীর্ণ দেহ। কোন মতে বহে চলে দেহকে। এতে দেহের কোন দোষ নেই, দোষ দেহের প্রতি অবহেলা বসতঃ।
যেখানে দেহের কেন্দ্রবিন্দু হৃদয়। আর যেখানে সেই হৃদয়েরই কোন মূল্যায়ন নেই। সেখানে দেহ কোন সুখের অধিকারী।

গৌরীপুরের রাস্তা ধরে হাঁটছে ইন্ধন। পায়ে পুরনো একজোড়া চটি, পরনে একটি পুরাতন প্যান্ট, পিছনের দিকে ছিড়ে গেছে। সারা গায়ে নোংরা কাপড়। মুখমণ্ডল শ্মশ্রুমণ্ডিত।একটি থলে কাঁধের উপর ঝুলছে। গাঁয়ে শিউলীর দেওয়া সেই শাল খানা এখনো জড়িয়ে আছে। গায়ে প্রচন্ড জ্বর, হয়তো ম্যালেরিয়া হবে। অযত্নে-অবহেলায় জংলি এলাকায় থাকে, সেখানে মশার অভাব তো নেই।

চলবে

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।