বিপুল রায়ের গল্প "গোলমাল"





আষাঢ় মাস। দিনে-আতি ঝমঝম করি ঝরি পড়ে। এক কথায় কইলে কওয়া যায়, ঘোর বাইস্যা। নদী-নালা উথাল-পাথাল। জমি-জমাও জলে থৈ থৈ। চৌরপাখে মাছের ছেরাছেরি! অমল বাবু প্রতিদিন স্কুল থাকি বাড়ি আসির পর সইন্ধ্যার সমায় চায়ের দোকানত বসি অনেক্ষন করি আড্ডা মারে। কিন্তু এই বাইস্যাত দোকান অত আতি খুলা থাকে না বুলি অমল বাবুর কয়েকদিন থাকি আড্ডা মারা হয় না।

          একদিন অমল বাবু পাঁচ-ব্যাটারি টর্চ লাইটটা নিয়া, ছাতি ধরি মাছ মারির বিরি পড়িল। সেলা প্রায় আতির আটটা বাজে।

          আতির দশটার দিকে হঠাৎ অমল বাবুর ফোনত কল আসিল। ফোনটা অমল বাবুর নিরক্ষর বনুস তুলিয়া কইল, “হ্যালো।”

           ওপাশ থাকিও একটা মহিলার মিষ্টি কন্ঠ আসি অমল বাবুর বনুসের কানোত ঢুকিল, “হুমম, হ্যালো।”

          “কায় কছেন?” অমল বাবুর বনুস পুছ করিল।

          ওপাস থাকিও একে প্রশ্ন আসিল, “তোমরা কায় কছেন?”

          “আশ্চার্য তো! তোমরা ফোন করি তোমার চিনাকি না দিয়া, মোকে পুছ করেছেন মুই কায়!”

          “কওকেনে কায় কছেন? ”

          “যাক ফোন করিসেন, মুই উমার বাড়িওলি রাধিকা কছোং। তোমরা কায়?”

          “কমল বাবুর বাড়িওলি!”

          “হুমম, মুই অমল বাবুর বাড়িওলি। মোর চিনাকি তো নিলেন। কিন্তু তোমরা কায় কলেন নাতো?”

          আসলে এই ঘোর বাইস্যাত টিনের ঘরত জল পড়ার যা শব্দ, তাতে কাহ বুঝা পাছে না যে, নামটা আসলে অমল বাবু, নাকি কমল বাবু! দুইটা নামে একে মতন শুনা যাছে-- এই কারনে দুইজনের একজনও পরিষ্কার শুনা পাইল না যে কায় কি নাম কছে!

          কমল বাবুর বনুস কইল, “বাজে কথা কন না। কমল বাবুর সাথে বিয়ার প্রায় বারো বছর হয়া যাছে হামার। আর তোমরা কন...”

          কথাটা কওয়ার আগোত অমল বাবুর বনুস কথাটা কাড়ি নিয়া কইল, “তোমরা বাজে কথা কন না! হামারও বিয়ার প্রায় নয় বছর হছে। আর তোমরা কন কি না বারো বছর!”

          একপাখে ঝমঝম করি ঝরি পড়েছে। আর একপাখে দুইজনেরে চলেছে তর্কযুদ্ধ। দুইজনেরে মুখের ভাষার যা পরিবর্তন হছে-- তা আর কওয়ার মতন না হয়! এই ছোট্ট একেনা ঘটনা যে বড়ো ধরনের একটা সংসারিক অশান্তির কারণ হবার পারে তা আর বুঝিতেও অসুবিধা থাকিল না।

          হঠাৎ কমল বাবুর বনুসের ফোনটা সুইচ অফ হয়া গেল। এই কয়েকদিনের নাগাতার বর্ষনে কারেন্টও বন্ধ। বাড়িগিলা অন্ধকারোত পড়ি আছে। দেখা যায় না এই বাড়ি থাকি ওই বাড়ি-- এমনে ঝরির পাগাল।

          কমল বাবু তাঁতিপাড়া গ্রামের পোষ্টমাস্টার। চাকরি সুত্রে বাড়ির বায়রাত অধিকাংশ সমায়টা কাটে। কয়েকটা দিন ছুটি কাটের আসিসে বাড়ি। আসিয়ায় সেই বিকালে চলি গেইসে স্কুল জীবনের বন্ধু তুকারাম বর্মনের বাড়ি। হোটে থাকি দুইজনে চলি গেইসে হিরম্ব রায়ের বাড়ি। এমন করি ইয়ার বাড়ি উয়ার বাড়ি করিতে করিতে আট-দশজন বন্ধু মিলি একসাথে বসি পড়িসে আড্ডাত।

          হুদি অমল বাবুও হাই স্কুলের মাস্টার। মাছ মারা খুব সখ। কিন্তু সমায় হয় না কুনোদিন। স্কুল থাকি হাপসি-খাপসি বাড়ি আসি আর মন চায় না মাছ মারিবার।

          অমল বাবু আর কমল বাবু-- দুইজনে দুইজনকাক আগের থাকি চিনে। কিন্তু ত্যামন একটা কথা-বার্তা হয় না, প্রয়োজনও হয় না কুনোদিন।

          যুদিও অনেকলা মাছ পাইসে তাও অমল বাবুর মাছ মারার সখ মিটে নাই। হিদি প্যাটের ভোকও মাথাত চড়েছে। কাজে যেকিনা মাছ পাইসে ওকিনা ধরি খুশি মনে বাড়ি ফিরিল। কিন্তু বাড়ি আসি যে খুশি মনটা কালা হবে-- সেইটা আর কায় জানে! মাছের ব্যাগটা থুইয়া, হাত-মুখ ধুইয়া ঘর িঢুকিতেকালেই শুরু হইল উয়ার বনুসের খেচখেচি। অমল বাবু দেখিয়ায় বুঝির পাইসে যে আজি উয়ার বনুস চন্ডিরূপ ধারণ করিসে। ব্যপারটা কিছু না বুঝিয়া অবাক হয়া অমল বাবু জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইল রে? প্যাটের ভোক মাথাত চড়িসে, তুই আরও মাথাটা গরম না করিস তো মোর!”

          “কি হইসে মানে! এমন করি কছেন, যুনি ভাজা মাছটাও অল্টে খাবার জানেন না!”

           “বাজে কথা কইস না।”

          “বাজে কথা! তোমরা করির পারেন, আর মুই কইলেই দোষ!”

          “আজব ব্যপার! কি করিলুং মুই!”

          “আজি পরিষ্কার কয়া দ্যাও-- মুই ছাড়া আর কায় আছে তোমার জীবনে?”

          কথাটা শুনি অমল বাবু যুনি আকাশ থাকি মাটিত পড়িল! “কায় আছে মানে!”

          “ওইবাদে মুই ভাবোং, তোমরা দিনাও চায়ের দোকানের আলে আড্ডা মারির যান কেনে!”

          “এবারে কিন্তু সীমা ছাড়ি যাছিস রাধিকা। আর একটা কথা যুদি কইস, খুব খারাপ হয়া যাবে কয়া দিলুং।”

          “খারাপ! কি খারাপ হবে হাঁ? কি খারাপ হবে?” তোমরা গোন্ডায় গোন্ডায় মাইয়া পুষির পান, আর মুই কইলেই খারাপ!”

         “কি যা তা কছিস!”

          অমলে বাবুর বনুস দিমদিম করি যায়া ফোনটা আনি হাতোত ধরে দিয়া কইল, “এইটা কায় ফোন করিল হাঁ? এইটা কায়? মুই মিছা কথা কছোং! ফোনটা দেখি ন্যাও, তারপর আপনে বুঝির পাবেন মুই কি কছোং।”

          ওপাকে কমল বাবু বাড়ি ফিরিলে শুরু হয় একে ধরনের নাটক! কমল বাবুও যার কিছুই জানে না। ফোনটা যে খুলি দেখিবে, তারও ব্যবস্থা নাই। ফোনটা সুইচ অফ!

          অমল বাবু নাম্বারটা চিনির পাইল না, কার নাম্বার। বারবার ফোন নাগায়, কিন্তু ফোন আর ঢুকে না-- সুইচ অফ কয়! খুব টেনশন-- একপাখে অমল বাবু আর একপাখে কমল বাবু দুইজনেরে।

          আতিটা কাটি গেল। সেদিন সাকাল থাকি জল পড়াও বন্ধ হইসে। আতির কান্ড-কির্তীর তানে সকালে চা'ও হয় না কাহরে বাড়িত। অমল বাবুর ভোকের প্যাট জ্বলেছে। অমল বাবু নাম্বারটাত ফোন নাগায়, কিন্তু সেলাও সুইচ অফ কমল বাবুর ফোন। কি করিবে ভাবি পাছে না! সেলাও উয়ার বনুসের চন্ডির ভর থামে নাই।... কিছুক্ষণ পর অমল বাবুর বনুস ভাত আন্দি থুইয়া আরও যায়া থাকি পড়িল বিছিনাত। কি একটা অশান্তির সৃষ্টি হইল, অমল বাবু কিছুই বুঝা পাইল না। নিজে ভাত বারি নিয়া খায়া, এক ধান্দারি বারান্দাত বসি নইল।

          এমন সমায় সেই নাম্বারটা থাকি অমল বাবুর মোবাইলোত কল আসিল। ফোনটা রিসিভ করিয়ায় অমল বাবু কইল, “কায় রে?”

          ওপাকে থাকিও একে প্রশ্ন আসিল, “তোমরা কায়?”

          অমল বাবু কইল, “তোমার তানে কতটা অশান্তিত পড়ি আছোং জানেন! মোক যুদি চিনেনকে না, তাহলে মোর নিয়া আজে-বাজে কথা ক্যাংকরি কইলেন মোর বাড়িওলিক?”

          কমল বাবুও কইল, “একে প্রশ্ন তো মোরও। তোমরাও যুদি মোক না চিনেন, তাহলে মোর নিয়া উল্টা-পাল্টা কথা কইলেন ক্যাংকরি? তোমরা কায় কছেন কও তো? বাড়ি কোটে তোমার?”

          “মুই অমল রায়। গয়েরকটাত বাড়ি। সীতারাম হাই স্কুলের মাস্টার।”

          “আরে অমল দা তুই! মুইও তো গয়েরকাটারে কমল বর্মন। তাঁতিপাড়ার পোষ্ট মাস্টার।

          “আরে কমল তুই! তোর বৌদিক কি কসিস রে?”

          “মুই আর কোটে কি কসুং অমল দা! যা কওয়ার কইসে তো বাড়িওলি।”

          “এমন কি যে কইসে এই দুই বেটিছাওয়া-- বুঝা বড়ো মুশকিল রে কমল! শুন তোক একটা কথা কং-- তুই তোর বনুসোক ধরি হামার বাড়ি চলি আয় আজি। আমনে-সামনে বসি সমস্যার সমাধান করির নাগিবে। না হলে মুশকিল আছে!”

          “মুইও ওইটায় ভাবেছোং অমল দা। মুই তাহলে কোনেক পরে মোর বাড়িওলিক ধরি তোমার বাড়ি যাছোং।”

          “হুমম। আইসেক, মুই বাড়িতে আছোং।”

কোনেক পরে কমল বাবু উয়ার বনুসোক ধরি অমল বাবুর বাড়ি আসি হাজির। অমল বাবুর বনুস সেলাও বিছিনা হাতে উঠে নাই। কমল বাবু আর উয়ার বনুসোক দেখি বিছিনা হাতে উঠিয়া কইল, “বইসো।”

          কমল বাবু আর উয়ার বনুস সোফাত বসিল। এবারে অমল বাবু উয়ার বনুসোক কইল, “হুমম, কালি আতিত কি হইসে কত?... পাড়ার আর একটা পরিবারের আগোত বাড়ির ঘটনা নিকিলাতে রাধিকা রাগে আরও ফুলি উঠিল।

          “কি হইসে, হইসে। নাইফাউকসালি কথা নিকিলান না কয়া দিলুং।”

          কমল বাবু দ্যাখেছে যে অমল বাবুর বনুসও ক্যামন চন্ডির রূপ ধারণ করিসে! কমল বাবু পুছিল, “কি হইসে বৌদি?”

           “কিছু হয় নাই রে।”... কয়ায় কান্দন শুরু করিল রাধিকা।

          অমল বাবু অবাক হয়া কইল, “কি হইল রে! কালি তো তুই আর কমলের বনুস দুইজনে ফোনত কথা কইসেন। কি কথা হইসে-- হামাকও শুনাও।

          “কমলের বনুসের সাথে!”

          “হ্যাঁ, কমলের বনুসের সাথে।”

          এবারে অমলের বনুস কমলের বনুসোক কইল, “তুই কালি কেনে এংকরি কলু হায় ইমার (অমল বাবুক দ্যাখে দিল) কথা?”

          “মুই তো উমার কথা কং নাই। মুই ইমার (কমল বাবুক দ্যাখে দিল) কথা কসুং।

           “তুই কমলের কথা কসিস!”

           “হুমম।”

          “কিন্তু, মুই তো...”

          এবারে পরিবেশটায় অইন্য নাখান হয়া গেল। অমল বাবু, কমল বাবু দুইজনে খোং খোং!

          অমল বাবু পুছিল, “কি হইসে কবেন তো নাকি?”

          কমল বাবুরও একে প্রশ্ন।

          অমল বাবু আর কমল বাবু-- দুইজনেরে বনুসের জিউগিলা ফিরি আসিল। রাধিকা ঘটনাটা চাপা দিয়া কইল, “কিছু হয় নাই। ছাড়ো ওইলা আলাপ, শুনির নানায়।”

          অমল বাবু কইল, “শুনির নানায় মানে! শুনার বাদে তো আজি স্কুল বন্ধ করা।”

          কমল বাবুর বনুস কইল, “হামার শুনিতে হয়তো ভুল হইসে দাদা। দেখিলেন না কালি যে জল পড়েছে, কিছুই শুনা যায় নাই ঠিকঠাক।”

          এবারে কমল বাবু কইল, “শুনা যায় নাই মানে! এতকিছু শুনিসেন, এতবড়ো একটা সমস্যার সৃষ্টি করিসেন! আর এলা কছেন শুনা যায় নাই ঠিকঠাক!”

          অমল বাবু নরম মেজাজের মানষি। কমল বাবুক কইল, “ছাড় কমল। শুনিতে হয়তো ভুল হইসে দুইজনেরে।”

          রাধিকা যে কাক কি কবে, ভাবি পাছে না। নিজের স্বোয়ামীক যে এতটা সন্দেহ করিবে তাও কুনোদিন কল্পনা করে নাই। কমল বাবুর বনুসও ভাবেছে ওই একে কথা।

          কমল বাবু কইল, “ঠিক আছে অমল দা, আজি তাহলে উঠি।”

          রাধিকা কইল, “আরে চা খায়া যাও। বইসো, মুই চা বানাং।”

          “না বৌদি, আজি থাউক, অইন্য দিন।”

          “অইন্য দিন না হয়, আজি। বইসো, মুই চা বানে আনেছোং।”

           কিছুক্ষণ পরে রাধিকা চা বানে আনিল। চা খায়া কমল বাবু আর উয়ার বনুস দুইজনে বিরাইল বাড়ির পথে। তাতে অমল বাবু কমল বাবুর বনুসোক কইল, “ভাল করি শুনি ন্যাও বৌমা, আর যুনি কুনোদিন এমন ভুল না হয়।”

          কমল বাবুর বনুস মাথা নড়ে হুকারি দিল, “ঠিক আছে।”

          আসলে নিজের মনের মানষির ভাগটা কাহ কাহকো দিবার চান্দায় না। অমল বাবুর বনুস য্যামন দিবার চান্দায় নাই, ত্যামনে দিবার চান্দায় নাই কমল বাবুর বনুসও।

তারিখ: ১৭.০৬.২০২০

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।