ইলশেগুঁড়ি ।। অদিতি ঘোষ দস্তিদার



পার্কিং লট থেকে বেরিয়েই বিরক্তি ধরে গেল ধরিত্রীর।মে মাস, তবুও এবছর বসন্তের দেখাই নেই নিউ জার্সিতে ।পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় সারা রাস্তা কুয়াশায় ভরা, প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না ঐ বেলা সাড়ে আটটাতে ও । ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া..আকাশের মুখ গোমড়া । হাল্কা ঠান্ডা ও আছে । এ পোড়ার দেশে বারোমাসই হঠাৎ করে যখন তখন ঠান্ডা উঁকিঝুঁকি মারে বলে back up প্ল্যান হিসেবে এক আধটা সোয়েটার, চাদর গাড়িতে থাকেই ধরিত্রীর ।
কিন্তু এই রে ! গাড়ির ট্রাঙ্ক যে ফাঁকা ! মনে পড়ল গত শনিবার ঝকঝকে রোদ হবার সুবাদে বাচ্চা গুলোকে নিয়ে long drive এ গেছিলো সে আর সুবীর, আর তাই বাড়তি জিনিস সব সরিয়ে ফেলতে গিয়ে শীতের পোষাকগুলোও বাড়িতেই রয়ে গেছে। কি আর করা ! গলার লম্বা স্কার্ফটাই গায়ে কোনমতে জড়িয়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে পড়ল ধরিত্রী।
যে কলেজে ধরিত্রী পড়ায় সেটার সব department গুলোই পাহাড়ের ওপরে আর পার্কিং লট গুলো সব নিচে (ধরিত্রী কাব্য করে বলে তরাই অঞ্চলে)। তাই রোজ ই অনেকটা চড়াই উৎরাই পথ ভাঙ্গতে হয় তাকে ক্লাসে যেতে আসতে ।
পার্কিং লটের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি ( না কি mist ? ) ঝরে পড়ল সারা গায়ে মাথায়। মনে পড়ে গেল মায়ের সতর্কবাণী.." ওরে হিম লাগাস না মাথায়, মাথা ধরে যাবে !"...এটা কি হিম ? হতেও পারে..ঠান্ডা তো ! মা..তুমি কত দূরে গিয়েও কি করে সব মনে করিয়ে দাও ? মাথায় স্কার্ফ টা জড়াতে গিয়ে মন ভেসে গেল স্মৃতির নদীতে।
মনে পড়ল এদেশে আসার আগে ধরিত্রী মফস্বলের যে স্কুলে পড়াত, তার কথা । বাসরাস্তার এপাশে ওপাশে দুটো বিল্ডিংগ ছিল স্কুলটায় । দুটো বিল্ডিংগে যাতায়াত করার সুবাদে প্রায়শই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দৌড়তে হত তাকে । তবে এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভারী ভাল লাগত তার !
আরে ? কি যেন একটা নাম আছে না এই বৃষ্টিটার ? মনে পড়েছে, ইলশেগুঁড়ি..হ্যাঁ হ্যাঁ ইলশেগুঁড়ি ! সারা গায়ে মাথায় বৃষ্টির আদর..মায়ের হাত বোলানর মতো..সেই বৃষ্টি ই তো ইলশেগুঁড়ি ! আর বাবার ঘোষণা.." বুঝলি, এই বার ভাল ইলিশটা উঠবে "। ধরিত্রীর ভাল ভাবেই জানা ছিল ভাল মন্দ যাই হোক, ইলিশ আনবে ই বাবা পরের দিন ! ইলশেগুঁড়ির মান রাখতেই হবে তো ! গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ, মায়ের চুড়ির ঠুনঠুন আর খন্তি নাড়ার শব্দ সব সব মিলেমিশে আছে ইলশেগুঁড়িতে ! কিন্তু এই mist কি ইলশেগুঁড়ি ? ইলিশ খাওয়ার জন্যে এদেশে তো ইলশেগুঁড়ি লাগে না ! বাংলাদেশী দোকানের দৌলতে ধরিত্রীর ফ্রিজে ইলিশ মজুত তো সবসময়ই । কিন্তু একই কি স্বাদ সব ইলিশ ভাজার ?
" Good morning professor !" মনটা আচমকা ই বাস্তবে ফিরে এলো । চারপাশে ছাত্র ছাত্রী রা চলেছে। ধরিত্রী লক্ষ্য করল চড়াই পথের অনেকটা ই উঠে এসেছে সে..আর গা হাত পা হাল্কা জলে মাখামাখি ।
অন্যদিন এই পথটা যেন শেষ হতেই চায় না, আজ এত শিগগির ফুরিয়ে গেল ? মনে মনে ধন্যবাদ দিল এই পাহাড়ী ঝিরঝিরে বৃষ্টিকে..সে ইলশেগুঁড়ি হোক আর না হোক ! বিরক্তি কেটে গিয়ে মনটা অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে !
মনের গভীর থেকে উঠে এলো রবি ঠাকুরের গান...
...." হাতের কাছে কোলের কাছে 
যা আছে তা অনেক আছে 
আমার সারাদিনের এই কি রে কাজ 
ওপার পারে কেঁদে চাওয়া? "

সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন


আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।