হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ির উঠানে লাঙ্গল জোয়াল রেখে শ্রীমান পুকুরে গেল স্নান করতে। ঘোলা জল; তবুও এ জলেই এলাকার অনেকে তৃপ্তি নিয়ে গা ভিজায়। কানে জল ঢোকার ভয়ে দু’হাতের তর্জনী দিয়ে কান চেপে টপটপ করে দু—চার টা ডুব দিলো শ্রীমান। ঘাড় গামছা দিয়ে গা মুছে বাড়িতে যেতেই শ্রীমতি নতুন লাল পাড়ের ধুতিখানা বের করে দিলো।
— ভাত নগোত ঠান্ডা হয়, তাড়াতাড়ি একনা আইসো।— স্বামীর প্রতি ভক্তিমাখা সুরে শ্রীমতির আবেদন।
— যাবার নাগছোং। প্রত্তুতরে শ্রীমান।
গায়ে স্নানের জল পুরোপুরি মুছে নেয় নি। পল্লীর খেটে খাওয়া মানুষগুলোর স্নানের জল, ঘাম এভাবেই গায়ে শুকানোর অভ্যাস। তারা জানে খেটে খাওয়া মানুষের এ ছাড়া আর কি বা পাওয়ার আছে। খেতে বসে শ্রীমান বউকে প্রশ্ন করে—
— আচ্ছা, তোর হাতোত কি আচে ক তো ? তকাইয়ের এতো সাদ হয় কেমন করি ?
আনন্দের ভাব নিয়ে বউকে শুধায় শ্রীমান।
— শোনো ! বেটি ছাওয়ার রান্না না হলে পুরুষের যে উদরপূর্তি হয় না তাক হামরা জানি। তাই চেষ্টা করি ভালো করি আনধোন বাড়োন করবেন। কিন্তু তাতে কী তোমার গুলের কাছে হামার সম্মান বাড়ে ?
এই প্রথম স্বামীর প্রতি একটু রাগান্বিত হয়ে কথা বলে শ্রীমতি।
— তা ঠেক কতা কছো। হউক, আর এক অল্প একনা ভাত দে। সকাল থাকি জমিত হাল দিতে দিতে প্যাটের ভাত সউগ হজম হয়া গেচে।
কথাটি বলে হাতটা একটু চেটে খায় শ্রীমান। শ্রীমতির মনেও একটু ধাক্কা লাগে। এসবের মাঝে কেন সে এমন কথা বললো। কিন্তু আমি যে সকল পুরুষকে নিয়ে এটা বলেছি তা কি আমার প্রাণনাথ বুঝবে ??
— কী হইলো, দেও আর চাইরটে ভাত ?
— থালখেন একনা আগগিয়ে দেও।
প্লেটে ভাত নিয়ে শ্রীমান ভাবে, আমাকে বলা কথাটা নিয়ে নিশ্চই কিছু ভাবছো। ভাবার কি আছে বলো। আমার মরন হলেও তুমি, আমি বেঁচে থাকলেও তুমি।
— পান সুপারি কি আছে, একনা মুকোত দিলেম হয়।
শ্রীমতি জানেন, পুরুষ মানুষেরা খাবারের পর পানসুপারি খাবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই সে সুন্দর করে আগে থেকে বাটা ভরে পান সুপারি সাজিয়ে রেখেছে। এ অভ্যাস শ্রীমতি স্বামীর বাড়িতে এসে শিখেছে তা কিন্তু নয়। তার বাবার বাড়ির লোজনেরও এমন অভ্যাস আছে।
— এই নেও পান। আর চুন কি বেশি করি দেইম, না অল্প করি ?
— চুন বেশি করি দিয়ে মোর মুকখেন পুড়ি দিবের চাইস ? দেকিশুনি ঠিকমত দে।
— তোমার মুক পুড়ি গেইলে ভাত খাবার পাবার নন, তাতে কি মোর ভালো নাগবে কন ?
— তাইলে যে এমন করি কস ?
— সউগ কতা কি আর মনের কতা হয়, কন ? এই নেও পান।
শ্রীমতির হাতের পরশে বানাবো পান মুখে দিয়ে শ্রীমান শুয়ে পড়লো বিছানায়। টিনের চালের ছোট ছোট ফুটো দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে পান চিবায়। পাশে বসে শ্রীমতি হাতপাখা দিয়ে বাতাশ করে। মৃদু বাতাশের স্পর্শে পান খেতে খেতে শ্রীমান কখন যে চোখ বন্ধ করেছে, পাশে থেকে শ্রীমতিও বুজতে পারে নি। হঠাৎ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করে....
ওহে ভগবান, আমি আর কিছু চাই না। শুধু এমন করেই সুখে শান্তিতে আমাদের পথচলা হয় যেনো।
পরের পর্বের অপেক্ষা....
ReplyDelete