মৌলানা জালালুদ্দিন মোহাম্মদ রুমির জন্ম ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর (হিজরী ৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে) পারস্যের অন্তঃপাতী (বর্তমান আফগানিস্তানের) বলখ নগরে। রুমির প্রকৃত নাম জালালুদ্দিন মুহাম্মদ বলখী। পিতা বাহাউদ্দীন ওয়ালিখ বলখে রাজপুরুষগণের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পশ্চিম এশিয়ার রুম প্রদেশের অন্তর্গত কুনিয়াতে বসবাস করেছিলেন দীর্ঘ সময়। সেই প্রদেশের নামানুসারে জালালুদ্দিনের নামের সাথে যুক্ত হয়েছিল রুমি প্রত্যয়টি। যদিও রুমি নামে তার জীবদ্দশায় কখনই তাকে ডাকা হয় নি (গুচ, ব্র্যা. ২০১৭)। তবে তাঁর প্রদীপ্ত প্রজ্ঞার স্বীকৃতস্বরূপ সেই সময়ে তিনি মৌলানা উপাধিটিও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শৈশবে তাঁর প্রতিভার প্রাখর্য প্রত্যক্ষ করে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ধর্মগুরু যথাক্রমে মৌলানা বোরহানউদ্দীন, শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তার এবং হাকিম আবদুল মাজিদ। এবং তাঁরা সকলেই তাঁর প্রতিভাটিকে বিকশিত করবার নিমিত্তে অকুণ্ঠ অবদান রেখেছিলেন। পরবর্তীতে রুমী দামেস্কে এবং আলেপ্পের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে অর্জন করেছিল নানামুখী জ্ঞান। তবে ৩৭ বৎসর বয়সে এসে রুমীর জীবনে যে মহামহিম মানুষটি আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে তাঁর চিন্তার দিগন্তে সর্বোচ্চ ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন তিনি হলেন দরবেশ হিসেবে পরিচিত অতি সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত শামস তাব্রিজি। দুজনের সম্পর্কের ব্যাপ্তি স্বল্প সময়ের হলেও গভীরতা বিবেচনায় তা ছিল অভ্রভেদী। রুমি তাঁর গুরু শামস তাব্রিজির প্রতিভায় এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে সাংসারিক সকল দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে শুধু তার সান্নিধ্য লাভেই ব্যাপৃত থাকবার চেষ্টা করতেন সতত। কথিত আছে যে, তাদের এমন নিবিড় সম্পর্কে হিংসাপ্রবণ হয়ে এক শিষ্য সাদা গোলাপের মতো শুভ্র শামস তাব্রিজিকে হত্যা করেছিলেন, যদিও এর কোনো প্রকৃততা উদঘাটন করা সম্ভব হয় নি। দিওয়ান এবং মসনবী রুমির অন্যতম প্রধান আলোচিত গ্রন্থ। দিওয়ানে অন্তর্ভুক্ত মোট শ্লোকের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার যার সবগুলিই গজল। পাশাপাশি মসনবীর প্রতিটি লেখাই কবিতা। গ্রন্থদুটি তুরস্ক আজারবাইজান, আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর অসংখ্য দেশে বিপুল পঠিত এবং জনপ্রিয়। আমেরিকায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক হিসেবে রুমির পরিচিতি প্রকারান্তরে আধুনিক সময়ে তার উপযোগীতাকে প্রমাণ করে (B.B.C Culture)। আধাত্মিকতা, মানবাকাঙ্ক্ষা, প্রকৃতি এবং প্রেম তাঁর প্রতিটি সৃজনের মূল উপজীব্য। এবং উপযুক্ত বিষয়ে ওপর ভিত্তি করে যে দর্শন তিনি নিমার্ণ করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা আজও মানবজীবনে স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য অতীব জরুরী। সাহিত্যের বিস্তীর্ণ অঙ্গণে শুকতারা হিসেবে রুমির যে উত্থান ঘটেছিল তার প্রবহমানতা আজও জলপ্রপাতের স্বচ্ছ ধারার মতো সচলমান। সঙ্গত কারণেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সাত শতাব্দীকাল পরেও (১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর, হিজরী ৬৭২) তিনি বেঁচে আছেন আজও বিশ্বের অগণিত পাঠকের হৃদয়বৃত্তে।
দুই বন্ধু
জনৈক ব্যক্তি এসে দাঁড়ালেন তার বন্ধুর বাড়ীর দোরগোড়ায়।
দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটি কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো-
কে ওখানে, কে?
বন্ধু, বন্ধু, আমি। ব্যক্তিটি উত্তর দিলেন।
দূর হও। অভদ্র লোকের কোনো স্থান নেই এখানে।
ক্ষুব্ধতা নিয়ে বললেন তার বন্ধু।
ব্যক্তিটি চলে গেলেন এবং দিগ্ববিদিকশূন্য হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকলেন প্রায় এক বছর।
অবশেষে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে,
বিচ্ছেদের অগ্নিতুল্য যন্ত্রণা ব্যতিরেকে কখনোই পরিবর্তিত হয় না
মানুষের কপটতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা।
ব্যক্তিটি তার ভুল শুধরালেন
এবং ফিরে এলেন আবারো তার বন্ধুর দরোজায়।
বাড়ীর সামনে এসেই ইতস্ততভাবে পায়চারি করতে থাকলেন উপর নীচ।
অতঃপর স্থির হলেন,
ভদ্রভাবে কড়া নাড়লেন দরোজায়।
কে রে এটা?
তুই!
আয় আয়, ভেতরে আয়।
আমার স্বকীয়তাই তো তোর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি এখন।
শোন, এই বাড়ীতে দ্বি-চারী ব্যক্তির কোনো স্থান নেই, বুঝতে পারলি।
মনে রাখবি, দু’সুতোর মাথা কখনোই এক সুঁইয়ের চোখে প্রবেশ করতে পারে না।
সুতোর একটিই মাথা, এবং সূহ্মভাবে প্রবেশের পরপরই তার কাজ শেষ হয়ে যায়।
এ জীবনে অহংকারের কিছুই নেই,
থলের ভেতর ক্ষুদ্রতা ধারণ করেই জীবন যাত্রা করে এক অজানার পথে।
*Two Friends, Poems by Mewlana Jalaluddin Rumi-Poem Hunter
তোমার জন্য বয়ে আনা উপহার
তুমি কল্পনাও করতে পারবে না যে,
তোমার জন্য একটি উপহার বয়ে আনতে,
কী নিদারুণ কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে।
কোন কিছুই সঠিক বলে প্রতিভাত হচ্ছিলো না।
সোনার খনি থেকে সোনা কিংবা মহাসাগর থেকে
জল বয়ে নিয়ে আসবার তাৎপর্য কী?
সবকিছুই আমি বহন করে নিয়ে এসেছিলাম
পূর্বদেশ থেকে মসলা গ্রহণের মতো।
কিন্তু এগুলোর কোনোটিই
আমার হৃদয় ও আত্মার গহীনে কোনো সুখানুভূতির উদ্রেক ঘটায় নি।
কেননা, আমি তোমার জন্য যা এনেছিলাম
তার প্রতিটিই রয়ে গেছে তোমার কাছে।
তাই তোমার জন্য উপহার হিসেবে একটি আয়না নিয়ে এসেছি আমি।
এই আয়নার দিকে তাকাও এবং মনে করো আমাকে।
*Gift (www.goodreads.com)
গোলাপের পাঁপড়ি যখন ঝরে যায়
গোলাপের পাঁপড়ি যখন ঝরে পড়ে,
যখন বিবর্ণ হয়ে যায় বাগান,
তখন তুমি আর কখনোই শুনতে পাবে না,
পাপিয়া পাখিদের গান।
ভালোবাসবার মতো মানুষ অবস্থান করে সবখানেই,
পক্ষান্তরে, প্রেমিক শুধুই এক ধরনের আবরণ।
ভালোবাসবার মতো মানুষ সবসময়ই থাকে জীবন্ত,
কিন্তু, প্রেমিক প্রকৃতই একটি মৃত বস্তুর মতো।
ভালোবাসা যদি তার প্রতাপপূর্ণ যত্নকে আটকে রাখে,
তবে ভালোবাসার মানুষটি বিদায় নেয়
অনাদরে প্রতিপালিত পাখির মতো,
ছুটে চলে ডানাবিহীন বিহঙ্গের মতো।
ভালোবাসবার মতো মানুষগুলির অন্তরে নিহিত
আলোকমালা যদি অনুপস্থিত থাকে,
তাহলে কীভাবে আমি জেগে উঠবো, সচেতন হবো?
ভালোবাসা সবসময়ই ইচ্ছে পোষণ করে যে,
এই শব্দটি প্রতিনিয়ত প্রসব হতেই থাকবে।
*When The Rose is Gone and The Garden Faded (www.rumi.org.uk)
আমার দুয়ারে কে?
কে আমার দুয়ারে দাঁড়িয়ে, কে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আপনার বিনীত ভৃত্য-আমি উত্তর দিলাম।
তুমি কী করো? তিনি জানতে চাইলেন।
আপনাকে অভিবাদন জানানোই আমার কাজ হে প্রভু,
আমি বললাম।
কিন্তু কতদিন চলবে তোমার এই কর্মযজ্ঞ?
উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন তিনি।
যতদিন আপনি চাইবেন,
এই বলে আমি আশ্বস্ত করলাম তাকে।
আর কতদিন নিজেকে এই আগুনে পোড়াবে?
যতদিন অবধি না খাঁটি হতে পারি
নিশ্চিত করলাম তাকে।
এটি আমার ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা
এবং এ ভালোবাসার জন্যই
আমি ত্যাগ করেছি আমার পদমর্যাদা।
তুমি শুধু তোমার নিজের পক্ষে
সাফাই গাইছো,
আসলে এর কোনো সত্যতা নেই।
তিনি আমার উপর জোর খাঁটিয়ে বললেন।
আমি অকুণ্ঠ চিত্তে বললাম,
এই যে দেখছেন আমার চোখের বিন্দু বিন্দু অশ্রু; এই অশ্রুই আমার স্বাক্ষী।
আমার ফ্যাকাশে মুখশ্রী;
এটিই আমার স্বাক্ষী।
কিন্তু তোমার প্রমাণাদির তো কোনো বিশ্বস্ততা নেই।
তোমার চোখ এতটাই আর্দ্র যে
সেখানে পৌঁছানোই দায়।
এবার প্রবল আস্থা নিয়ে আমি বলতে থাকলাম
আপনার ন্যয়বিচারের বহ্নিদীপ্ত প্রভাই
আমার ভেজা চোখকে সমুজ্জ্বল ও ত্রুটিবিহীন করে তুলবে।
তুমি আসলে কী খুঁজছো বলতো?
আপনাকে, আপনাকে প্রভু,
আপনাকে আমার স্থায়ী বন্ধু হিসেবে খুঁজছি।
কী চাও তুমি আমার কাছে,
বলো তো, বলে ফেলো।
আপনার দিগন্তবিস্তৃত অনুগ্রহ- এক সমুদ্র অশ্রু নিয়ে বললাম আমি।
তোমার সাথে এ যাত্রায় আর কে কে ছিল বলতো দেখি?
কেউ না, শুধুই আপনার চিন্তার মগ্নতা, প্রভু, শুধুই আপনার চিন্তার মগ্নতা।
কিন্তু বিশেষ কি আকর্ষণ করলো তোমায় যে,
এখানে আসলে তুমি?
কেন! আপনার কোমল পানীয়ের সুঘ্রাণ,
সেইই তো আমায় ডেকে নিয়ে এলো এখানে।
কিসে তোমার পূর্ণতা আসে বলবে কি?
বলবো না কেন!
আমার পূর্ণতা আসে সম্রাটের সাহচর্যে।
কিন্তু, সেখানে কী পাও তুমি?
শত শত অলৌকিকতা।
আচ্ছা, এখানে এত নির্জনতা কেন, বল তো?
আমি বললাম, তারা সবাই চোরকে ভয় পায়।
কিন্তু কে সেই চোর? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
যে আমাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে
সেইই চোর,
আমি বললাম।
কিন্তু তাদের নিরাপত্তা?
কর্ম এবং ত্যাগের মাঝেই- আমি বললাম।
কিন্তু সেখানে ত্যাগ করবার মতো কিইবা আছে?
পরিত্রাণ প্রাপ্তির প্রত্যাশা, প্রভু, আত্মপরিত্রাণের প্রত্যাশা।
কিন্ত তাদের দুর্দশা কিংবা দুঃখটা কোথায় বলো দেখি?
আপনার প্রাণবান ভালোবাসার উপস্থিতিতে।
এই জীবন থেকে তুমি কীভাবে সুখ অণ্বেষণ করো?
নিজের কাছে নিজেই সৎ থাকবার মাঝেই-আমি বললাম।
এই মুহূর্তে প্রকৃতই সময় হলো নীরব থাকবার।
আমি যদি তাঁর প্রকৃত অস্তিত্ব নিয়ে তোমাদের বলি
তাহলে তোমরা তোমাদের সত্তা ছেড়ে আকাশে উড়বে, হারিয়ে যাবে সুদূর নীলিমায়।
কোনো পিছুটানই আর ধরে রাখতে পারবে না তোমাদের।
*Who is at My Door? (www.rumi.org.uk)
মনজুরুল ইসলামের আরো লেখা ক্লিক করুন