সাত পাকের বন্ধন ।। বিপুল রায়



কলোনীত থাকার কি যে জ্বালা-- যায় কলোনীত থাকে তায়ে একমাত্র বুঝে। সরু সিকসিকা একেনা গলি, আর তাতে ঘরের উপুরা ঘর! ‘জনঘনত্ব’ এত বেশী যে আর কওয়ার মতন না হয়। সেই মতনে একটা কলোনী হইল-- চম্পানগর কলোনী। চম্পানগর কলোনীর রাস্তার গোর দিয়া সিকসিক করি চলি গেইসে একটা ছোট নদী।

          চম্পানগর কলোনীর লক্ষ্মীকান্ত ঘোষ তার বেটি চুমকির বিয়া ঠিক করিসে জলপাইগুড়ি পাহাড়পুরের অনন্ত ঘোষের সাথে। চুমকি আর অনন্তর পিরিতী বহুদিনের। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পড়াশুনার বাদে চুমকি জলপাইগুড়ি এ.সি কলেজোত ভর্তি হয়। আর তাতে বন্ধুত্ব হয় অনন্তর সাথে। সেই বন্ধুত্বয় ধীরে ধীরে পরিণত হয় পিরিতে। দুইজনে নিজানিজি বাড়িত জানায় ব্যপারটা। রাজিও হয় দুই পক্ষয়।

          আষাঢ় মাসের ২৩ তারিখ বিয়া ঠিক হয়। বাইষ্যালি দিন-- একেবারে ঘোর-বাইষ্যা। চাইরোপাখে জল থৈ থৈ। হাঁটু খানেক জল উঠিসে চম্পানগর কলোনীত। কুনোটে যাওয়া-আইসা করা তো দূরের কথা, ঘর থাকি বিরা মুশকিল! বিয়ার দিন ঘনি আইসেছে, কিন্তু জল আর কমে না। মহাচিন্তাত পড়িল লক্ষ্মীকান্ত। চুমকিরও মন ধুকপুকায়-- কি যে হছে বিয়ার দিনে!

          বাংলাদেশোত লক্ষ্মীকান্তর শশুড় বাড়ি-- হোটেও নিমন্তন করা হইসে। বাকি সাগাই-সোদরগিলাকও নিমন্তন করা শ্যাস। লক্ষ্মীকান্তর বাড়িত সেই নাখান কুনো বড়ো ধরনের অনুষ্ঠান হয় না বুলি কাহকে নিমন্তন করার সুযোগ হয় না। নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কাহরে সাথে দেখা হয় না। বেটির বিয়া বুলি কথা-- এই সুযোগে সগারে বাড়ি বাড়ি যায়া নিমন্তন করি আসিসে।... চুমকির মামা কথা দিসে বিয়াত যত মসোং নাগিবে, সব উয়ায় দিবে। উয়ার দাদু-দিদা দিবে নালে-সাদায় সাজে। বাকি যা কিছু নাগে তার ব্যবস্থা নিজে করিসে লক্ষ্মীকান্ত।

          বিয়ার মাত্র দুই দিন বাকি। চম্পানগর কলোনীর জল সেলাও কমে নাই। লক্ষ্মীকান্তরটে এইটা একটা মহাবিপদ। আশা ছিল বেটির বিয়া খুব ধুমধাম করি দিবে, সাগাই-সোদর সগায় আসিবে, অনেক আনন্দ হবে। কিন্তু এইমতন করি জল থাকিলে তো সব সপ্নয় সর্বনাশ!

          জলে জলে হাট-বাজার করা শ্যাস। কলোনীত এমন কুনো ফাঁকা জাগা নাই-- যেটে বিয়ার প্যান্ডেল বানা যায়। কি করিবে? কুনো বুদ্ধি খাটে না লক্ষ্মীকান্তর। শ্যাস-ম্যাস বাইধ্য হয়া লক্ষ্মীকান্ত প্যান্ডেলওয়ালাক কইল, নদীর উপুরাতে শক্ত করি প্যান্ডেলটা বানা যাউক।... প্যান্ডেলওয়ালা প্রথমে ‘না’ কইলেও পরে উপায়-আপায় নাই দেখিয়া রাজি হইল। লক্ষ্মীকান্তর কথা মতন নদীর উপুরাতে প্যান্ডেলের কাজ শুরু করিল।

          জল পড়া বন্ধ হইসে। বিয়ার দিন আসিতে আসিতে চম্পানগর কলোনীর জল শুকি গেইসে। কিন্তু বোরবোরা হাঁটু সমান কাদো চৈন্যাফাটা ঔদ ছাড়া শুকায় ক্যাংকরি! কাজে জল শুকি গেইলেও কাদো শুকাইল না।

          আসল নেটা তো নাগিল বিয়ার দিনে সইন্ধ্যাত। হিরহির করি এক গাড়ি পুলিশ আসি হাজির লক্মীকান্তর বাড়িত। ব্যপারটা আসলে কি?-- বুঝির পাইল না কাহয়। লক্ষ্মীকান্ত পুছিল, “কি ব্যপার স্যার?”
          এস.আই সাহেব প্যান্ডেলটার পাখে নেঙুল তুলি কয়, “তোমরা জানেন, কি করিসেন এইটা?”
          “কি স্যার?”
          “নদীর উপুরা যে প্যান্ডেল করিসেন-- কার পার্মিসন নিসেন?”
         “পার্মিসন! কিসের পার্মিসন স্যার?”
         “নদীটাক কি তোমার নিজের সম্পত্তি পাইসেন যে-- তার উপুরা প্যান্ডেল বানাইসেন!”
          “নিজের সম্পত্তি থাকিলে কি আর কাহ নদীর উপুরা বিয়ার প্যান্ডেল বানায় স্যার?”
          “মুই কুনো আইনানুগ ব্যবস্থা নিবার আগত তোমরা নিজে প্যান্ডেল খোসাও।”
          “তোমার পাও ধরি কং স্যার-- দয়া করি এই কাজটা করেন না।”
          “তোমরা যুদি নিজে না খোসান, তাহলে কিন্তু মোকে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করির নাগিবে লক্ষ্মীকান্ত বাবু।”
          “আর মাত্র কিছুক্ষন, তাহলেই তো মাইটার বিয়া। দয়া করি উকিনা টাইম সবুর করো স্যার।”
          “কনস্টেবল, মিষ্টি কথায় কাজ হবে না। হাতের কাজ শুরু করি দ্যাও।”... য্যামন কথা ত্যামন কাজ। কনস্টেবল প্যান্ডেলওয়ালাক ধুমকি দ্যায় প্যান্ডেল খসের বাদে। প্যান্ডেলওয়ালাও ভয়তে সাথে সাথে প্যান্ডেল খুলার কাজোত নাগি পড়ে। লক্ষ্মীকান্ত এস.আই সাহেবের ঠ্যাঙোত পড়ি গোরাগোরি খায়, কিন্তু এস.আই সাহেব উয়ার কুনো কথা শুনিলে তো হয়ায় গেল হয়। চুমকি আর উয়ার মাও'ও হুকুড়ি-ডুকুরি কান্দন জুড়িসে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে বিয়া। এত আয়োজন করা হইসে টাকা খরচ করি-- নিমেষেই তা ধ্বংস হয়া গেল। লক্ষ্মীকান্তর আর সেই মতন সামর্থও নাই যে, ফটকরি অইন্য কুনোটে ছোট্ট করি একেনা প্যান্ডেল বানে নিবে!
 ততক্ষনে ঘটনার জল অনেকদূর গড়াইসে।

          লক্ষ্মীকান্ত এবার নিজে থানাত ফোন করি জানাইলে থানার বড়োবাবু আসি হাজির। বড়োবাবু দ্যাখেছে এস.আই সাহেব অনেকটায় বাড়াবাড়ি করিসে। একজন গরিব মানষির সাথে এতটা অমানবিক আচরণ করাটা মোটেও ঠিক হয় নাই। যাই হউক এস.আই সাহেবেরও একটা মান-ইজ্জত আছে। তাছাড়া পুলিশের চাকরিখান বড়োবাবুরটে শ্রোদ্ধার কাজ। উয়ায় থাকিতে এই কাজোত চুনকালি নাগুক-- সেইটা মোটেও চায় না। কাজে যেহেতু এস.আই সাহেব ভুল করি ফেলাইসে তাও ভুলটা ধামাচাপা দিবার বাদে বড়োবাবু লক্ষ্মীকান্তক কইল, “তোমরা আইন বিরোধী কাজ করিসেন লক্ষ্মীকান্ত বাবু।”
          “আচ্ছা, বড়োবাবু, উপায় নাই বুলি তো আজি এইমন করি প্যান্ডেলটা বানা হইল। এটে মুই কি এমন অপরাধ করিলুং যে এতবড়ো সাজা পাবার নাগিল-- তোমরায় কও তো?”
          “নদী সরকারী সম্পত্তি লক্ষ্মীকান্ত বাবু। সরকারী পার্মিসন ছাড়া তার উপুরা তোমরা বিয়ার প্যান্ডেল বানের পারেন না।”
          “ঠিক আছে বড়োবাবু, তোমারটায় মানি নিলুং। কিন্তু তোমরা নিজে গোটায় কলোনী ঘুরি এমন একখান জাগা দেখাও যেটে বিয়ার প্যান্ডেলটা বানা যায়। যুদি দ্যাখের পান তাহলে মুই মোর সব অপরাধ মাথা পাতি স্বীকার করিম।”
          “কথাটা ওটে না হয় লক্ষ্মীকান্ত বাবু।”
          “তাহলে কোটে হাঁ? আইনের লোক বুলি তোমরা যা খুশি তা করিবেন!”
          “শুনো লক্ষ্মীকান্ত বাবু, এই যে তোমরা নদীর উপুরা যে প্যান্ডেল বানাইসেন-- তাতে তোমার আন্দন-বারন, খান-দান সব হবে। আর তোমার ব্যবহার করা যাবতীয় জিনিস নদীত ফেলাবেন, তাতে কি নদীর জল দূষিত হবে না? জলজ প্রাণীগিলার কি ক্ষতি হবে না? তোমরা নিজে একবার চিন্তা করো।”
          “ঠিক কইসেন বড়োবাবু। কিন্তু সবসমায় আইন মানি কি আর সব কাজ হয়! হামরা গরিব, মুর্খ-সুর্খ মানষি-- অতসব জানি না। কিন্তু হামরা কষ্টের মূল্য দিবার জানি। আচ্ছা, জাগা নাই বুলিয়া তো এই কাজটা হইসে। যেহেতু প্রথম বার না জানিতে এইমন ভুল হইসে, তোমার উচিৎ ছিল সতর্ক করি দেওয়ার যে-- ভবিষ্যতে যুনি কাহ এই কান্ড না করে। তা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তা না করিয়া তোমরা সোজাসুজি...। অল্প কোনেক মানবিকতাবোধও কি নাই তোমার।”
          “ঠিক আছে লক্ষ্মীকান্ত বাবু, হামার পক্ষ থাকি হামরা দুঃখিত। হামারও ভুল হইসে। তোমরা কি কবার চান্দাছেন তে?”
          “কি আর কইম বড়োবাবু! তোমরা আসিসেন, ডিউটি পালন করিসেন, চলি যাবেন। কিন্তু হামরা! এত কিছু যে তছনছ করি দিলেন-- মোর কি এমন সামর্থ আছে, যে আর একবার একে মতন ব্যবস্থা করির পাইম!”... বড়োবাবু ভাবি দেখিল-- লক্ষ্মীকান্তর কথাটা ফ্যালে দেওয়া না হয়। গরিব মানষি, অভাবি সংসার। বড়োবাবু এস. আই সাহেবের সাথে যুক্তি করি কইল, “আচ্ছা লক্ষ্মীকান্ত বাবু বিয়ার জইন্যে যত খরচ হবে-- সবে এস. আই সাহেব আর মুই করিম। এটে জাগা কম, বায়রাত চলো। তোমারে এটেকার তিতলিতলার ফুটবল খেলা মাঠের শীতলা মন্দিরটাত না হয় তোমার বেটির বিয়াখান হইল। আপত্তি নাই তো? ”
          “কিন্তু বড়োবাবু...”
          “কিন্তু টিন্তু বাদ দ্যাও। চলো যা কিছু আছে-- সব গাড়িত ওঠাও আর তিতলিতলা চলো। সমায় যেহেতু বেশী নাই। আর দেড়ি না করেন।”... থানার বড়োবাবু যেহেতু লক্ষ্মীকান্তক কথা দিসে-- নিজে গাড়ি রিজার্ভ করি নিয়া বিয়া বাড়ির যাবতীয় জিনিস ধরি তিতলিতলা চলি গেল। সাগাই-সোদর সগায় তিতলিতলার মাঠ আসি উপস্থিত। জল-কাদো কিছুই নাই এটে, শুকান ঠনঠনা মাঠ।

          আতির দশটার দিকে বরযাত্রীর গাড়ি আসিলে লক্ষীকান্তর সাথে স্বয়ং বড়োবাবুও আগবারে যায়। তার পর নিয়ম-নীতি মানি তিতলিতলার শীতলা দেবীর মন্দিরত খুব ধুমধাম করি বিয়া হয়। বড়োবাবু চুমকির মাথাত জল ছিটায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর সরকারী বাধা-বিপত্তি কাটি উঠি মানবিকতার বিশ্বাসে চুমকি আর অনন্ত সাত পাকে বান্দা পড়িল।

তারিখ: ১৭.০৭.২০২০

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।