আজ তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছে দাদাভাই মনে পড়ছে তোমার রেখে যাওয়া স্মৃতি গুলো। বন্ধুর মত আমায় নিয়ে ঘুরতে সারাক্ষণ। পিতৃতুল্য ভালোবাসা দিয়েছিলে তুমি আমায়। আর মাতৃতুল্য আদরে খেয়ে পরিয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দান করেছিলে তুমি।
শৈশব, কৈশোর কে অতিক্রম করে যৌবনে পা দিয়েছি। এতগুলো বছর অতিক্রম করার পরও আজও মনে পড়ে দাদা তোমার সাথে তোমার পাশে কাটানো শৈশব, কৈশোর। মনে পড়ে আমাকে পড়ানো তোমার আক্ষরিক কৌশলগুলো-তিন লাঠিতে- ব, ফোটা দিলে- র, এক লাগাইলে- ক, মাথায় পাগড়ি- ধ, খুঁটি দিলে- ঝ, মোচড় দেয়া- ম, হাটুভাঙ্গা- দ।
ওগুলো আজও ভুলিনি দাদাভাই। মাঠে-ঘাটে, হাট- বাজারে যেখানে গিয়েছিলে আমাকেই বানিয়েছিলে তোমার একমাত্র সঙ্গী। আমার প্রতি কোন কিছুতেই ভালোবাসার কমতি ছিল না তোমার।
আদর-যত্ন স্নেহ ভালবাসায় সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখতে আমায়। আমি তোমার আধা পাগল ছেলেটার ঘরে জন্মানো সেই সৌভাগ্যবান। পুরো বাড়ি জুড়ে ছিল আমার একার রাজত্ব তখনো। ছিল না আমার কোন ভাগীদার চাচাতো কিংবা জ্যাঠাতো ভাই বোন। আমার একটু অসুস্থতায় অস্থির হয়ে ছটফট করছিলে তুমি।
রাত কিংবা দিন একাকার করে ঘুড়ছিলে ডাক্তার কিংবা কবিরাজের বাড়ি।সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো, গোসল করানোর দায়িত্বটাও তুমি নিয়েছিলে তোমার কাঁধে তুলে। তোমার কোলে পিঠে আষ্টেপিষ্টে রাখতে আমায় সব সময়। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুমিয়ে দিতে আমায়।
তোমার মুখের কিছু বাক্য, ছন্দ এখনো নিরালে পাঠ করি দাদুভাই-শুনবে?
এ্যকে নিমনিম
দুইয়ে পাঠ
তিনে গন্ডগোল
চাইরে বাজে হাট।
এবং
জুঁই চামেলি ফুলের বোঁটায়,
বৃষ্টি পড়ে ফোটায় ফোটায়,
বাদলা দিনের একটানা সুর,
বৃষ্টি পরে মিষ্টি মধুর।
তোমার মুখ থেকে শোনা সেই ছন্দ গুলো এখনো আমার কানে বাজে।আমি দিশেহারা হয়ে যাই আর তোমাকে খুঁজে ফিরি।
জানো দাদা আজ তুমি না থাকায় প্রতিটা জিনিস ভাগাভাগি হয়ে গেছে। একটা বাড়ি থেকে পরিণত হয়েছে চারটে বাড়ি। তোমার ওই সুপারি বাগান টি এখন চার ভাগে বিভক্ত। তুমি বেঁচে থাকতে যেরকম প্রতিটা গাছে চড়তে পারতাম আম,জাম, কাঁঠাল,লিচু,পেয়ারা ইচ্ছেমতো খেতাম কিন্তু এখন আর পারিনা।
কারন কি জানো? এখন সেটা চার ভাগে বিভক্ত।আচ্ছা দাদা তুমি না বলেছিলে আমার যা কিছু আছে সব তোমার! তাহলে আজ কেন আমি তোমার পুরোটা সম্পত্তিতে অধিকার রাখতে পারছিনা?দেখেছো দেখেছো তুমি না থাকাতে আজ আমি কতটা অসহায়?
কাকে বলব আমার মনের কষ্টের কথা? কে শুনবে আমার কথা? আজ বড়ই মনে পড়ে তোমাকে দাদাভাই।
দাদাভাই তুমি না তোমার এক বন্ধুর কথা বলেছিলে আমাকে সুব্রত.....সুব্রত ভট্টাচার্য। আজ তোমার সেই বন্ধুর সাথে দশ মিনিট ফোনে কথা বললাম। তুমি নাকি সুব্রত দাদার খুব কাছের বন্ধু ছিলে!
তুমি নাকি সব মানুষের পাশে দাঁড়াতে!
তুমি নাকি কখনোই মিথ্যা কথা বলনি!
যখনি সময় পেতে তখনিই নাকি ছুটে যেতে তোমার সুব্রত বন্ধুর কাছে।
আমার পরিচয় পেয়ে উনি খুব খুশি হয়েছিলেন যে আমি তোমার নাতি। আর ভালোবেসে অনেক গুলো পথ নির্দেশনা দিয়েছেন আমাকে। আমাকে যেতেও বলেছেন উনার বাসায়। আমাকে নিয়ে বসে নাকি গল্প করবে! আর উনিও নাকি আমাদের বাসায় আসবেন আমার হাত ধরে এলাকাটা ঘুরবেন। আজ যদি তুমি থাকতে.....?
তোমার বন্ধু সুব্রত দাদা আরো কি বলেছে জানো?
তোমার চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার শেষদিনের গল্পটাও উনি সুন্দরভাবে সাজিয়ে বলেছিলেন আমাকে। তোমার আমন্ত্রণে উনিও নাকি ধন্য হয়েছিলেন সেদিন। আরো যে কত কি!
তুমি কিন্তু আমাকে এই গল্পগুলো বলোনি দাদাভাই!
ও দাদা তুমি যে গোলা ঘরটা তৈরি করেছিলে ধান রাখার জন্য। ওই ঘরটির দেয়ালের চতুর্দিকে বিভিন্ন ধরনের চকের লেখা-- এখানে ৫ মণ ওখানে ১০ মণ সেখানে ১৫ ডালি ইত্যাদি ধানের হিসাব এখনো মুছে যায়নি। নেই শুধু তুমি।
কি ভাবছো দাদু ভাই আমি আমার ছোট্টবেলার এসব তথ্য কি করে জানলাম? তাহলে বলি শোনো দাদি আর মা আমাকে সব বলে দিয়েছে ছোটবেলা থেকেই তুমি নাকি আমাকে প্রচন্ড পরিমানে ভালবাসতে। আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতে না।
কিন্তু আমার একটা কথা মনে আছে কিন্তু দাদাভাই কি জেনো এক কারণে তুমি আমাকে একদিন মারছিলে, আমার পিঠের এক পাশে একটা থাপ্পড় দিয়ে ছিলে, আর আমি দৌড়ে গিয়ে বাড়ির পিছনে বসে সবার চোখের আড়ালে কাঁদতে ছিলাম। তুমিও কিন্তু সেদিন মহিলা মানুষের মত করুণা করে অনেক কান্না করেছিলে আমাকে সামান্য একটু মার দিয়ে। তুমি আবার আমাকে খুঁজে এনে বুকে টেনে নিয়েছিলে।
আজ কেন জানি তোমাকে খুব মনে পড়ছে দাদাভাই। আমি প্রায়ই ছুটে যাই তোমাকে পাবার আশায়,একটুখানি দেখার আশায়, একটুখানি তোমার আদর ভালোবাসা পাওয়ার আশায় স্মৃতি বিজড়িত ঐ স্থান গুলোতে।কিন্তু হন্যে হয়ে ঘুরেও আমি তোমাকে খুঁজে পাই না। যখন মাথায় আসে তুমি আর এই জগতে নেই, তখন বোকা সেজে ফিরে আসি। তোমার কবরের পাশে এসে দু ফোঁটা অশ্রু ঝরানো ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকেনা।
"ওপারে ভালো থেকো দাদাভাই"