প্রায়শ্চিত্ত ।। নুসরাত জাহান



ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে চাকুরি জীবন, কোন ঈদেই এত নির্বিঘ্নে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে পারেনি রতন। বাসে-ট্রেনে তেমন ভীর নেই। স্যানিটাইজেশন ব্যবস্থাও সন্তোষজনক। এসব ভাবতে ভাবতেই তিস্তা স্টেশনে পৌঁছে যায় সে। গাড়ি থেকে নামতেই প্রশান্তির হাসি হেসে আব্বা এগিয়ে আসেন তার দিকে। বাপ-বেটাতে মিলে রওনা হয় বাড়ির পথে।
ভাইজান এসেছে, ভাইজান এসেছে বলে বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই হাঁক-ডাক শুরু করে দেয় ছোট বোন তমা। কলপাড় থেকে দৌড়ে আসেন আম্মা। এতদিন পর ছেলেকে দেখে তার মুখে সেকি উপচে পড়া আনন্দ। রতনের আগমনে ঈদের আগেই এ বাড়ীতে ঈদ আনন্দ বিরাজ করতে শুরু করেছে যেন।     

ঢাকা শহরে ছোট্ট একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করেন রতন। করোনা নামক মহামারির কারণে গত ঈদে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পুলিশ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি ফেরার ঝুঁকি নেয়নি সে। মহামারীর কারণে অফিস কিছুদিন বন্ধ থাকলেও কলিগরাসহ ভাড়া বাসায় থেকেই অনলাইনে অফিশিয়াল কাজকর্ম সারতে হয়েছে। তবে এভাবে আর কতদিন! পরিবারের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে, নিজ গ্রামের সতেজ প্রকৃতিতে বিচরণ করতে তার মন যেমন উতলা হয়ে তেমনি বাড়ির সবাইও অস্থির হয়ে উঠেছিল।

তমা আব্বার হাত থেকে ব্যাগ নিতে নিতে বলল, "আমার জন্য ঈদ উপহার কি এনেছ ভাইজান? আর আম্মা-আব্বার জন্য?" কারও জন্যই কিছু কেনার সুযোগ হয়নিরে মোনা। কাজের খুব চাপ যাচ্ছে ইদানীং। তার উপর শরীরটা কয়েকদিন থেকে ভাল না। এমন সময় তার চাচাতো ভাই সাজ্জাদ এসে হাজির। রতনের আসার সংবাদ শুনেই এসেছেন সে। নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে রতনের সাথে কথা বলেন তিনি। যাতায়াত ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা শুনে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তিনি রতনকে সতর্ক করেন। যেহেতু শহর থেকে ফিরেছে তাই বাইরে ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করেন এবং বাড়িতেও নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে হোম কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে চলে যায় সে। এতে রতনের আব্বা-আম্মা মোটামুটি বিরক্ত। তাদের ছেলে ফিরেছে আর মানুষের যত কথা। রতন বাইরে যায়নি ঠিকই তবে কোন ধরনের নিয়মকানুন না মেনে অবলীলায় মিশেছে পরিবারের সবার সাথে।

বিপত্তিটা বাঁধল ঈদের ২য় দিন পর। গত দুই-তিন দিন থেকেই রতনের আব্বা-আম্মা একটু একটু অসুস্থ বোধ করলেও সেদিন হঠাৎ করেই রতনের আব্বার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাকে ডাক্টারের কাছে নিয়ে যাবে এমন সময় ফোনে জানতে পারে সে যে কলিগদের সাথে ভাড়া বাসায় ছিল তাদের মধ্যে একজন করোনা পজেটিভ। বিষয়টা মনে মনে আচ করতে পেরে অতিদ্রুত সে নিকটস্থ হেলথ্ কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করে। তার এবং তার আব্বা-আম্মার ৩জনেরই করোনা পজেটিভ ফলাফল আসে।

করোনার সাথে যুদ্ধে তার ডায়াবেটিস এবং এজমা রোগী বাবা অল্পতেই হার মেনেছেন। আম্মার অবস্থাও খুব একটা ভাল না। তবে মোটামুটি স্বাভাবিক আছে রতন। সেদিন ছোটবোন বলেছিল আমার জন্য কী এনেছ ভাইজান? সামনে তো ঈদ। আব্বা-আম্মার জন্য কী এনেছ? নিজের অজান্তেই যে প্রিয় পরিবারের মানুষগুলোর জন্য করোনা নিয়ে এসেছে আজ তা হারে হারে টের পাচ্ছে। আর অবিভাবক হারিয়ে নিজেদের অবহেলা এবং অসর্তকতার প্রায়শ্চিত্ত  দিতে হচ্ছে পুরো পরিবারকে।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।