'একাত্তরের যুদ্ধ বীর' ইতিহাস আশ্রিত বীরত্বগাথা জীবনোপাখ্যান ।। আশিস রহমান


করোনা কালে অবসর সময়ে পড়ে শেষ করলাম সুনামগঞ্জের লেখক-গবেষক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী'র লেখা সদ্য প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই 'একাত্তরের যুদ্ধ বীর'। নাগরী প্রকাশনী প্রকাশিত ১২৭ পৃষ্ঠার এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান।

সুনামগঞ্জের দুই জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম ও আব্দুল মজিদ এবং একজন বীরাঙ্গনা নারী যোদ্ধা কাঁকন বিবির যুদ্ধকালীন অবদানসহ তাদের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। উল্লেখ্য, এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধাই সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার বাসিন্দা। বইয়ের লেখক এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সান্নিধ্য এসেছিলেন। যে কারণে প্রাসঙ্গিক ভাবেই বইটির লেখায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়ার পাশাপাশি এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব গাথা হুবহু তুলে ধরতে পেয়েছেন।

বইটি শুরু হয়েছে একজন পাহাড়ি সংগ্রামী নারীর কথা দিয়ে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের নত্রাই গ্রামে এক খাসিয়া পরিবারে জন্ম নেওয়া নারী কাঁকাত হেনুইঞ্চিতা। সীমান্তের ওপারের পাহাড়ি কন্যা কাঁকাত হেনুইঞ্চিতা থেকে উঠে এসে এদেশের একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিবেটি হয়ে ওঠা বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবি। জুম চাষী এই নারী জীবনের নানা টানাপোড়ন, ভাগ্য বিড়ম্বনা, জন্ম, কৈশোরকাল, প্রেম, ধর্মান্তরিত, বিয়ে, গুপ্তচরবৃত্তি, পাক ব্যাংকারে সম্ভ্রমহানি ও যুদ্ধযাত্রা, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিবর্তিতে কাঁকন বিবির মানবেতর যাপিত জীবনের দুঃখকষ্ট, সংগ্রামী নারীর স্বীকৃতি, সর্বোপরি তার আত্মজীবনী সুনিপুণভাবে বইটিতে অঙ্কন করেছেন লেখক।

বীরাঙ্গনা কাকঁন বিবির পরেই এসেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বীর প্রতীকের প্রসঙ্গ। অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আব্দুল হালিম বীর ছিলেন একাত্তরের উত্তাল সময়ে টগবগে এক তরুণ শিক্ষার্থী। দেশমাতৃকার টানে এই তরুণ সিলেট টেকনিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে এসে পরিবার স্বজনদের ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। অন্যান্য সতীর্থদের সাথে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সাহস ও বীরত্ব দেখিয়ে। আব্দুল হালিম শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা-ই নন একজন সৌভাগ্যবান মানুষ ছিলেন। ভাগ্যের ফেরে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ৫ বার বেঁচে ফেরেছেন। মৃত্যুর মুখ থেকে পাঁচবার ফিরে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। শত্রুদের মোকাবেলায় নিজের শরীরে গ্রেনেড বেধে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন। যা এখনো কল্পনানীত এবং একজন নিখাদ দেশ প্রেমিকের পক্ষেই শুধু সম্ভব। যুদ্ধকালীন সময়ে এই বীর যোদ্ধা ছাতকের জাউয়া সেতু ধ্বংসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের যুদ্ধবীর বইয়ে সঙ্গত কারণেই লেখক তাকে ছাতকের জাউয়া সেতু ধ্বংসের নায়ক হিসেবে অবিহিত করেছেন। অসীম সাহস ও বীরত্বের ফলশ্রুতিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমকে স্বাধীনতা পরবর্তীতে বীরপ্রতীক খেতাবে সম্মানিত করা হয়। বইটির এই অংশে বীরপ্রতীক আব্দুল হালিমের জন্ম, বেড়ে ওঠা, কৈশোর কাল, যুদ্ধে অংশগ্রহণ, যুদ্ধ পরবর্তী জীবন পর্যায়ক্রমে তুলেধরা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের পর সহযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বীর প্রতীকের প্রসঙ্গ এসেছে। হালিম ও মজিদ দুজনই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই এলাকার বাসিন্দা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও দুই বন্ধু একসাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কাধে কাধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। যুদ্ধের মাঠে হালিম ও মজিদ দুজনই পর¯পরের সাথী যোদ্ধা হিসেবে একসাথে অংশগ্রহণ করেছেন। আশ্চর্য মিল দুজনের মধ্যে! তারা একই সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং একই যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একইসাথে বীরপ্রতীক খেতাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আব্দুল মজিদ ছোট্ট বেলা থেকেই দূরন্তপনা ছিলেন। সংস্কৃতির প্রতি টান ছিলো তার। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই ৬০ এর দশকে তিনি 'রাজপুতের ছেলে' নামক মঞ্চ নাটকে সেনাপতি রঘুদেবের চরিত্রে অভিনয় করে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাতকের রাউলি ব্রীজ ধ্বংস, সোনাপুরের কাভারিং ফায়ার, জাউয়া সেতু ধ্বংসের অভিযান, ঝাওয়া সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস অভিযান, রায়ত গ্রামের যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস দেখিয়েছেন তিনি। বুরকি যুদ্ধে তার দুঃসাহসী রণকৌশল যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের খেসারত স্বরূপ তার বসতবাড়ি, ফসলিজমি ও ফলজবৃক্ষতে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা। বইটিতে পূর্ববর্তীদের ন্যায় আব্দুল মজিদেরও জন্ম, বেড়ে ওঠা, কৈশোরকাল, যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ যুদ্ধপরবর্তী জীবনের বিভিন্ন দিক লেখক তুলে ধরেন।

সর্বোপরি বীরাঙ্গনা কাকঁন বিবি, আব্দুল হালিম বীর প্রতীক ও আব্দুল মজিদ বীরপ্রতীককে জানতে এবং তাদের বীরত্ব গাথা যুদ্ধের স্মৃতি রোমান্থনের জগতে প্রবেশ করতে পাঠকের পছন্দের বই হতে পারে একাত্তরের যুদ্ধবীর। এক্ষেত্রে লেখক ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। যারা মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রের রোমাঞ্চকর ঘটনা পড়তে ভালোবাসেন তারা এই বইটি পড়ে মজা পাবেন। বইটি অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডটকমেও পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের পৌরবিপনীর মধ্যবিত্ত থেকেও বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।