একটি অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনা ।। জরীফ উদ্দীন

আমাদের গল্পটার কোনো সমাপ্তি ছিল না সম্পর্কটার মতোই কিংবা ছিল আমরা খেয়াল করিনি কখনো। আর যখন খেয়াল করলাম তখন সব রিমোট কন্ট্রোলের বাইরে কিংবা কন্ট্রোলেই । তবে দিন যাচ্ছে আমাদের নিয়ে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে নিজেরাই জানি না অথবা জেনেও স্রোতে ভেসে যাই অজানার উদ্দেশ্যে। আমাদের দুটি দেহ ভেসে যায়, একটিও হতে পারে কচুরিপানার মতো কিংবা যায় না কোথাও আটকে থাকে। কোথায়? তা কি আর জানা আছে! 

আমাদের আমি হিমু নই। হিমুর সাথে মিলও নেই একবিন্দু । জীবনে কখনো হলুদ পাঞ্জাবি তো দূরের কথা হলুদ শার্ট কিংবা টি-শার্টও পড়িনি, রাতে একা বাসার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই আরো খালি পায়ে রাস্তায় হাটব! জুতা পায়ে বেশি দূর হাঁটতে পারি না বাতের ব্যাথায়।  হিমুর মতো দুঃসাহসিক কাজ করার সাধ্য নেই, নেই মাজেদা খালাও যে সব সময় সাহায্যের জন্য বসে থাকবে খাটাশ খালুর চোখে ধুলো দিয়ে।  কিন্তু সে রূপা। হুম সে হুমায়ূনের চিত্রে আঁকা রূপাই। কিভাবে যেন মিলে গেছে তা আমি জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি কোনদিন। হয়তো করেও ছিলাম, পাইনি। অথচ হুট করেই তার সাথে আমার প্রেমটা হয়ে গেল। তাও নয়। পরিচয়ের ২৩৫ দিনের পর কোন নাটকীয়তা ছাড়াই আমরা দুজন সম্পর্কে আবদ্ধ হই আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে।  কতবার এই সম্পর্কটা থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছি আমি। সে যে চায়নি তা নয়। অথচ আমরা আটকা পরে গেছি মাকড়সার জালে দিকভ্রান্ত পথিক। যা ছিঁড়ে বাহির হওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার।  

আকাশে মস্ত থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ জ্যোতি ছড়াচ্ছে। যেন ব্রহ্মপুত্রের মতো  বসুধায় জ্যোৎস্নার ঢেউ। সে সাঁতার কাটছে  রোমান্টিক মুডে।  উঠানে করছে জ্যোৎস্না  বিলাস। সেই সময় আমার বড্ড ঘুম পায়। আমি হাই তুলে ঘুমাই। হয়তো ঘুমাইও না। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি। কেন থাকি তার সমাধান মিলেনি আজও। 

কোন এক রাতে বিছানায় শুয়ে আছি  আমার ঘুম আসছে না। রূপার সাথে কথা বলার ইচ্ছে করে আমার। কথা না হউক মোবাইলে অথবা ফেসবুকে এসএমএস হউক কয়েকটা। সেদিন তার চোখে রাজ্যের ঘুম। সে ঘুমিয়ে পরে। আমি শুয়ে থাকি ঘুমহীন কিংবা পায়চারী করি এলোমেলো। অথবা বসে জানালার ফাক দিয়ে দেখি অভাগা পৌঢ় নক্ষত্রকে যারা আমার মতো রাত জাগে নিরুপায় হয়ে। সেই আদিকাল থেকে খসে পরা অবধি।    

শ্রাবণের সকাল কিংবা দুপুর। আকাশে সারিবদ্ধ কালো মেঘ উড়ে যায়। আচমকা বৃষ্টি ঝরে। সেই নব বৃষ্টি। সে নেমে পরে বৃষ্টি বিলাসে কাকতারুয়া কিংবা যে কোন পাখির মতোও পরিও হতে পারে ডানা মেলে উড়তে চায় আকাশে। আমি তখন শুয়ে ঘুমাই কিংবা বসে কার্টুন দেখি  টিভিতে। সে ডাকলেও বৃষ্টিতে ভেজা হয় না আমার সর্দি-জ্বরের ভয়ে। কিংবা সর্দি-জ্বর নয় অনিচ্ছাই আমাকে গ্রাস ক্ল্রে নেয়। 

অন্যদিন বৃষ্টি আসলেই মনটা চায় প্রিয় মানুষটার সাথে গল্প করি এক লেপের নিচে বসে। তার সাথে দরজায় দাঁড়িয়ে হাতদুটো বাইরে দেই বৃষ্টিকে স্পর্শ করি। কিংবা বসে শুনি টিনের চালে ঝমঝম করা বৃষ্টির শব্দ। তা কোনো দিনও হয় না। আমার কপালে নেই বৃষ্টি বিলাস। 

রূপা নীল শাড়ী পড়ে আমার সাথে দেখা করতে আসে। তাকে অনেক সুন্দরী লাগে। মন আটকে যায়। আমার লাল শাড়ী পছন্দ তাকে কোনদিন বলতে পারিনি। কিংবা বলার চেষ্টাও করিনি। অথচ চাইতাম সে লাল শাড়ী পরে আসুক। লাল শাড়ীতে তাকে আরো অপরূপ লাগবে।  আমি দেখা করতে যেতাম পরিপাটি। অনেকটা শুভ্রর মতোই। ফ্যাশন বিষয়টা কখনো আমার মাথায় আসে না। ফরমাল ড্রেসে সহজ মনে হয় নিজেকে। অথচ ও চাইতো আমি অসাধারণ বেশে বেড়াই। কিন্তু আমি সাধারণের চেয়েও সাধারণ যাকে বলে নগন্য।   

দেখা হলে আমাদের তেমন কথা হতো না। কেমন আছি, আসতে কোন প্রব্লেম হয় নাই তো, কতক্ষণ সময় দিতে পাব। এই সব কথা হয়। অবশ্য আর  বলার মতো তেমন কিছু থাকতও না। দুজন প্রথমেই দেখা হতে একজন অন্যজনকে দেখতাম। পাশাপাশি বসে থাকায় আর দেখা হত না। আমাদের দৃষ্টি সামনে আটকে থাকত। না থাকতেই পারে। চলে যায় দূর কোন আকাশে অভ্রের দিকে। অভ্রের কত তাড়া একটুও জিড়ানোর সময় নেই। অথবা সামনে থাকা কোন বৃক্ষের ডালে হলুদ কোন পাখির উড়ে যাওয়ায়। চলে যাওয়ার সময় ছাড়া তার মুখ আর সামনে আসে না। ভাসেও না। অথচ একদিন দেখা না করলে মন ছটফট করে দুজনার। মনে হত কত লক্ষ বছর আমাদের দেখা হয় না। আমাদের দুজনের মতের মিল এখানেই।

আমাদের দুজনের পছন্দ কখনো এক হতো না। অথচ আমরা দুজন অনায়াসে দুজনের পছন্দকে গুরুত্ব দিতাম  কিন্তু নিজের জন্য মেনে নিতাম না।   

আমি তার মতো হতে চাইনি। সেও আমার মতো হওয়াটা কল্পনাই করতে পারেনি। আমাদের তফাৎ আকাশ-পাতাল। অথচ আমরা সীধান্ত নেই বিয়ে করার। সম্ভবত আমাদের বিয়ে করার সীধান্তটা দুজনের ২য় মিলে যাওয়া দ্বিতীয় সীধান্ত। বিয়েতে আমার কিংবা তার বাড়ির কেউ রাজি ছিল না।  তাই এই যাত্রায় বিয়ে বন্ধ করার কথা থাকলেও আমরা বিয়ের দিন ধার্য্য করি মঙ্গলবার কাজী অফিসে। মঙ্গলবার নাকি মঙ্গল বয়ে আনে। রূপার থিউরি।

রূপার দেওয়া হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে মঙ্গলবার সময়েরও ৩০ মিনিট আগে পৌঁছে যাই কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে। সম্ভবত আমার জীবনে তারসাথে দেখা হওয়ার প্রথম সময়ের আগে পৌঁছানো। কাগজের কাজগুলো সেরে নিতে হবে বলে তাড়াতাড়ি আসা । সেও আসার জন্য বাসা থেকে বাহির হয়। আসলেই বিয়ে করে আমরা দূর সম্পর্কের এক কাজিনের বাড়িতে আপাতত থাকা শুরু করব। কিংবা হোটেলেও হতে পারে। 

৪০ মিনিট পর রূপার ফোন। যদিও তার তাড়াতাড়ি আসার কথা। আমি রিসিভ করি অনেকটা রাগ করেই। ওপাশ থেকে ভেসে আসে অপরিচিত কণ্ঠ।

আপনি কোথায় আছেন? তাড়াতাড়ি আসুন কাজী অফিসের সামনে। মেয়েটি এক্সিডেন্ট করেছে। ডায়ালে আপনার নাম্বার প্রথমে দেখে কল করা হলো। মেয়েটির অবস্থা ভালো না। আমি দৌড়ে কাজী অফিস থেকে বাহির। জুতাও পায়ে দেওয়া হয় নি। কাজী অফিসের সামনে ছোট একটা ভীর ঠেলে ভিতরে যাই।  রূপা রাস্তায় পরে আছে। মাথা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বাহির হচ্ছে৷ মুখে কোন বিরক্তি কিংবা ব্যথার চিহ্ন নেই লাল শাড়ীতে তাকে অসম্ভব সুন্দরী লাগতেছে। আমি তার মাথায় হাত দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছি সে চোখ খুলল কিংবা খোলায় ছিল অথবা খুলেই নাই।

আজ তোমাকে সত্যিই হিমুর মতো লাগছে। হলুদ পাঞ্জাবী, পায়ে জুতো নেই, মাথার এলোমেলো চুল। অথচ আজ আমি লাল শাড়ী পরেছি। অথচ আজ আমি লাল শাড়ী পরেছি। আমি জানি লাল শাড়িতেই তুমি আমাকে পছন্দ করো। আজকের দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম লাল শাড়ী পরে বধু সাঁজার জন্য। বধু সাঁজলাম কিন্তু বধু হতে পারলাম না।  আজ হিমু আছে অথচ রূপা থাকবে না। সে হিমুর জীবন থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। 

না রূপা আমি তোমাকে মরতে দিব না। তুমি বেঁচে থাকবে অনেক দিন। 

কিন্তু কে আমাকে বলছিল? রূপা! তার তো ঠোঁট নড়ছে না।  তাহলে.....?


সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।