সুপ্রিয়ার মানিব্যাগ থাকি কুনোমতনে চুপ করি টাকাটা নিকিলি রমেশ সোজা মোহনবাবুর টিক-বাগান চলি গেল। এই টিক-বাগানোত যে উয়ার আত্মাটা পড়ি আছে। এটে জুয়া খেলার আসর বইসে! মদের গোডাউন আছে! মাঝে মাঝে নারীবাজিও হয়! এক কথায় ‘রেড লাইট এড়িয়া’ কইলেও বোধায় ভুল হবে না। মহিলা গুষ্ঠির অভিযোগে অনেকবার আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হইসে, কিন্তু তাতে ত্যামন একটা কাজ হয় নাই। বরঞ্চ যেই যেই মহিলা থানাত যায়া অভিযোগ করিসে, সাঞ্ঝেরক্ষণ তার তার পিটিতে হালুয়া পেন্টি ভাঙিসে! তবে জুয়া খ্যালে কাহ যে রাজা হইসে-- এমন উদাহরণ পাওয়া না গেলেও, ফকির যে বহু মানষিয়ে হইসে তা নির্দ্বিধায় কওয়া যায়।
বিতা কয়েক বছর যাবৎ রমেশ কুনো কাজ-কর্ম করে না। উয়ার বনুষ সুপ্রিয়ার সামাইন্য আয়-উপার্জনে টানিটুনি সংসারটা চলে। রমেশের অমানুষিক কর্মকান্ডের বাদে সুপ্রিয়া যে বাপের বাড়িত অভিযোগ করিবে-- তারও উপায় নাই! ছাওয়া ধরি ডাংডাং-ফাংফাং ঘরটাত অনেক কষ্টে দিন কাটায় বেচারি। বাইস্যাত দোলদোলে জল উসুরে ঘরের টুঁহি দিয়া! টিনের উপুরা মটকা নাই-- ঝড়ের সমায় কুত্তি বা উড়ি গেইসে! ঘরের চাটিগিলাও ঘুনে খায়া নষ্ট করিসে! এইলার পাখে কুনোদিন চোখু তুলিয়া দ্যাখে না রমেশ! সুখের সংসারটাত কয়েক বছরের মাথায় দুঃখের ছাঁয়া জাপ্টে ধরিল! মনের দুঃখে হাপো নিক্কাশ ছাড়ি সুপ্রিয়া কয়, “পোড়া কপালোত কি আর সুখ সয়!”
রমেশের বংশের বাতি উয়ার একমাত্র বেটা সুমন। ক্লাস ফাইভে পড়ে। টিউশন পড়া তো দূরের কথা, বই-খাতা কিনিবার পাইসা জুটে না ঠিকঠাক! সুপ্রিয়া এই নিয়া দুঃখ প্রকাশ করে! সুমনোক যে উয়ায় মানষির মতন মানষি গড়ের চায়। দশ-সমাজের লোক যাতে উয়াক সেলাম দ্যায়-- এমন স্বপ্ন দ্যাখে বেটাক নিয়া। কিন্তু-- রমেশের আলসিয়ামি চাল-চলনে তা কি আর সম্ভব হয়! মনে মনে ঠিক করে, রমেশোক ডিভোর্স দিয়া ঐন্য কুনোটে যায়া মাওয়ে-বেটায় দিন যাপন করিবে। যেই সংসারোত মরদ থাকিয়াও না-মরদের মতন-- তার সাথে সংসার করিয়ায় কি, আর না করিয়ায় কি!
সুপ্রিয়া টেইলারি কাজ করে। ১৫০ টাকা দিন-মজুরি পায়। সেইটা দিয়ায় সংসার চালায়। তারে মাঝোত এন্দুরের ঐত্যাচার! এন্দুর অর্থাৎ রমেশ-- সুপ্রিয়ার কষ্টের টাকা চোর করি জুয়াত নাগায়, মদ খায়! কিছু কবার গেইলে ডাং-মাইর, আর অসইভ্য গালিগালাজ ছাড়া কিছু জুটে না সুপ্রিয়ার পোড়া কপালোত! দিন দিন এই সাংসারিক অশান্তি বাড়িতেই থাকে! চুপচুপে অনেক কবিরাজি চিকিৎসাও করিসে সুপ্রিয়া-- যাতে রমেশ সঠিক রাস্তায় ফিরি আইসে। কিন্তু সেই চিকিৎসাও ব্যর্থ হইল!
জুয়া খেলা আর মদ খাওয়ার পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবের সাথে রমেশ এলা যৌনপল্লী যায়, পতিতালয় যায়! আমোদ-ফুর্তি কত কি করে সুপ্রিয়ার চোখুর আড়ালোত। নিজের আয়-উপার্জন তো কিছু নাই-- সবে সুপ্রিয়ার টাকায়। একটা সোনার সংসার ধ্বংস হইতে ইয়ার থাকি আরও বেশী কিছু নাগে বুলি মনেও হয় না!
একদিন সাঞ্ঝেরক্ষণ সুপ্রিয়া উয়ার কাজ সারি বাড়ি ফিরিবার পথে লক্ষ্য করিল রমেশোক। সাথে পাঞ্চালীও! স্বোয়ামী মরিবার পর যায় খালি টাকাকে চিনে! সগায় জানে-- এই পাঞ্চালী যে ভাল জাতের মানষি না হয়। টাকার বিনিময়ে উয়ায় নিজের দেহা বেচায়। পাড়ার একটা কোনাত উয়ার ঘর। স্বোয়ামী মদারু হউক, জুয়ারু হউক তাতে আপত্তি নাই; কিন্তু একজন চরিত্রহীন নারির সাথে টাকার বিনিময়ে ক্ষণিকের ভালোবাসা কুন বউটা মানি নিবে? অন্ততপক্ষে নিজের মনের মানষিটা ঐন্য আর কাহরো প্রতি আকৃষ্ট না হউক-- এইটা সগায় চায়। পাঞ্চালীর সাথে রমেশোক দেখি সুপ্রিয়ারও অঙ্গ জ্বলেছে! ঝড়ের ব্যাগে উয়াও চলি গেল পাঞ্চালীর বাড়ি। পাঞ্চালী উয়ার বিছিনাত শুতি নরম দেহার গরম উষ্ণতা খালি রমেশোক দিবে মতন, তাতেই পোচ্কোটা দুয়োরখান এক গুড়ি ভাঙি সুপ্রিয়াও ভিতর ঢুকিল। রমেশ চমকি উঠিল, পাঞ্চালীও। সুপ্রিয়া গোমা সাপের মতন ফোঁস ফোঁস করি চোখু দইটা রক্তের মতন নাল করি রমেশোক জোর গালায় কইল, “তোমরা এটে কি করেন?”
মদ খাইলেও ত্যামন একটা নিশা হয় নাই রমেশের। কাজে থোতবোত হয়া কইল, “মু-মু-মুই এটে...”
সুপ্রিয়া আরও কইল, “কি করেন এটে? সেইটার জবাব দ্যাও...”
“পা-পাঞ্চালীর নাকি দেহাত বিষ। মোক কোনেক ডল্লে দিবার কইল। ঐ বাদে...”
“উয়ার দেহাত বিষ! আর তোমাক ডল্লে দিবার কইল! তোমরাও আসিলেন! আহা রে কি মোর মরদটা রে! দরকার নাই-- এলায় হাঁটো তোমরা।”
“ঠিক আছে, মুই যাছোং। তুই আগা।”
“আগা-টাগা না হয়, এলায় চলো।”
রমেশ এবার রাগ দ্যাখে জোর গালায় কইল, “দূর হ এটে থাকি! শালা শুয়োরের বাচ্চা।”
‘শুয়োরের বাচ্চা’ গালিটা শুনিতে শুনিতে সুপ্রিয়ার কান ভোতরা হয়া গেইসে! ঝগড়া নাগিলেই রমেশের মুখোত এইটা একটা কমন ওয়ার্ড। সুপ্রিয়া তাও বাঘিনীর মতন ডিকিরি উঠি কইল, “এলায় চলো। যে না পবিত্র মন্দিরটাত মাথা ঢুকি দিসেন আসি তোমরা!”
“চুপ কর, শুয়োরের বাচ্চা। মন্দির! হ্যাঁ এইটায় মোর মন্দির, এইটায় মোর স্বর্গ। আর পঞ্চালী এই মন্দিরের দেবী। তুই আর কি জানিস!”
“একজন চরিত্রহীন নারীর আগোত মোক এমন করি গালিগালাজ করিতে তোমাক লইজ্জা নাগেছে না!”
“লইজ্জা! হুটা কি জিনিস রে বেইশ্যা!”
“মোক তোমরা বেইশ্যা কইলেন! একজন বেইশ্যার আগোতে তোমরা মোক...! ছিঃ ছিঃ ছিঃ...!” সুপ্রিয়া আর কিছু কইল না। মুখোত শাড়ির আঞ্চলখান চিপি ধরি চোখুর জল মুছিতে মুছিতে বাড়ি ফিরিল। রমেশ তাও বেহায়ার মতন মনের আশা পুরোন করিল।
মতিলালের অবস্থা আগের মতন থাকিলে সুমনোক সাথে ধরি সুপ্রিয়া হয়তো চলিয়ায় গেল হয়। মতিলাল সুপ্রিয়ার বুড়া বাপ। ভরা বাইষ্যাত রইক্ষসি তিস্তা উমার সব জাগা-জমি কাড়ি নিসে! এমনকি সাধের ঘরবাড়ি সহ কয়েকটা প্রানও! মতি বুড়ার প্রান-প্রেয়সী, সুখ-দুঃখের সাথী বিনোদিনীও ভাসি গেইসে রাইক্ষসী তিস্তার বুকোত! সর্বহারা হয়া মতি বুড়া এলা অতীত ফকির! বুড়ালি বয়সে মানষির দুয়োরে দুয়োরে ভিক্ষা করে! কুনোদিন খোরাক জুটে, কুনোদিন জুটে না! এই অবস্থায় বেটিক পুষির মতন ক্ষমতা কি আর আছে উয়ার! উয়ায়ে সুপ্রিয়াক খবর দিসে, আর যে কয়েকটা দিন বাঁচিবে-- সেই কয়েকটা দিন জামাইয়ের বাড়িতে থাকির চায়। তিন কাল যায়া এক কালোত খানিক জিরিবার চায়।
সাদামাটা মতি বুড়া, ঘটকের মুখোত সয়-সম্পত্তির কথা শুনি রমেশের হাতোত তুলি দিল মাও মরা ছাও সুপ্রিয়াক। শশুড়-শাশুরির আদরও কম ছিল না। এক কথায় কওয়া যায় সোনার সংসার।
যতদিন সুপ্রিয়ার শশুড়-শাশুড়ি বাঁচি ছিল, ততদিন সবকিছু ঠিকে ছিলো। যেই না দুইটা মানষিয়ে স্বর্গবাসি হইল, রমেশের ধ্বংসের পথও ফাঁকা হইল। আর সুপ্রিয়ারও কপালোত নামিল দুঃখের ছাঁয়া! জুয়া খেলা, মদ খাওয়া আর নারীবাজীতে মত্ত হইলে সয়-সম্পত্তি ফুরাইতে কয়দিন নাগে! জাগা-জমি বেচা শুরু হইল রমেশের। সুপ্রিয়া বাধা দিয়া কয়, “জাগা-জমিলা কেনে বেচান! তার চাইতে কর্ম করো। মদ খান, না জুয়া খেলান, কি করেন করো-- কর্মের টাকায় করো। তোমার কর্মের টাকা সংসারোত দিবার না নাগে। জাগা-জমিলা কেনে ফুরান! সুমনেরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে-- সেইটা চিন্তা করেন না!”
রমেশ উত্তর দ্যায়, “জ্ঞান দিস না, শুয়োরের বাচ্চা। তোর বাপের সম্পত্তি বেচাছোং?”
সুপ্রিয়া সরল মনে আরও কয়, “বাপের সম্পত্তিয়ে হউক, আর শশুড়ের সম্পত্তিয়ে হউক-- সবে তো হামার, নাকি।”
রমেশ বেশী কথা না বড়েয়া কয়, “জ্ঞান দিবার আসিস না মোক। মোর বাপের সম্পত্তি, কি করোং না করোং-- মুই করিম, তুই কবার কায় রে!”
রমেশের এই কথাটাত খুব আঘাত পাইসে সুপ্রিয়া। সেদিন থাকি আর ভাল-মন্দ কুনো কথায় স্বোয়ামীক কয় না। নিকর্মা স্বোয়ামীর উপুরা ভরসা করাও ছাড়ি দিসে। বিয়ার আগোত যে টেইলারি শিখিসে-- উকিনায় কাজোত নাগাইল। সংসারের খরচ আর বেটার পড়াশুনার খরচের টাকা জোগার করির বাদে সুপ্রিয়া চৌরাস্তার মোড়ত একটা টেইলারের দোকানোত হাজিরা খাটে।
বিয়ার আগোত কত স্বপ্ন দেখিসে সুপ্রিয়া-- রমেশ ঠিক থাকিলে হয়তো পুরোনও হইল হয়। কিন্তু, সমাজের একজন বেইশ্যার ঘরত যায়া আজি রমেশ উয়াক বেইশ্যা বুলি সম্বোধন করিল-- এই অপমান কিছুতেই সইহ্য হছে না উয়ার। মাথার ঘাম ঠ্যাঙোত ফ্যালে সারাটা দিন টেইলারি করি সংসারের খরচ বহন করে উয়ায়। সেই মানষিটাক কাহ এমন করি কইলে মাথা কি আর ঠিক থাকে!
সুপ্রিয়া মনে মনে ভাবে, পঞ্চালীর মতনে হবে-- অনেক বেশী টাকা কামাই করিবে। কিন্তু, পর-মুহুর্ত্বেই ভাবে, “এই সমাজোত পাঞ্চালীর কি কুনো সন্মান আছে? সগায় যে উয়াক ঘিন্নার চোখুত দ্যাখে!”... পাঞ্চালীর যে আগে-পাছে কাহ নাই-- কায় উয়াক কি কবে! কিন্তু সুপ্রিয়ার তো নিকর্মা স্বোয়ামী আছে, বেটা আছে, বুড়া বাপও আছে। উয়ায় ভাল করি জানে-- একবার যুদি কলঙ্কের দাগ নাগে-- সেই দাগ যে কুনোদিনও উঠিবে না!...“নাঃ, পাঞ্চালীর মতন হওয়া যাবে না। এই সমাজ যে পুরুষতান্ত্রীক সমাজ! এই সমাজোত পুরুষ যতয় কুকর্ম করুক, যতয় পতিতালয় যউক-- তার গাত যে কলঙ্কের দাগ পড়ে না! যত নিয়ম-নীতি, ধর্ম-অধর্ম-- সব তো নারীসমাজের জইন্যে। পুরুষ কুকর্ম করিলে চরিত্রবান হইতে সমায় নাগে না। কিন্তু একজন নারী একবার কুকর্ম করিলে নাগি যায় কলঙ্কের দাগ! সাথে সাথে হয়া যায় চরিত্রহীন নারী!”
জীবনের ভাল সমায়গিলা অর্থাৎ বিয়ার আগের বাইশটা বছর ক্যাংকরি যে এত তাড়াতাড়ি বিতি গেল; আর এলা দুঃসমায়গিলা একদায় কাটেও না! ঠিক যুনি কচ্ছপের গতিতে আস্তে আস্তে ঘুরেছে ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা! এত অশান্তি সুপ্রিয়ার দেহা আর সয় না। “এই অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান কি কুনোদিনও সম্ভব?”-- সুপ্রিয়ার মনত এইটা একটা বিশাল প্রশ্ন...
তারিখ: 02.03.2021
খুব ভালো নাগিল গল্পখান।
ReplyDeleteশুবাঞ্ছা জানাঙ
🙏 দীপু রায়