সত্য প্রকাশে আপোষহীন আহমদ ছফা ।। মো. সাজ্জাদ হোসেন


“ফরমায়েস দিয়ে দাস তৈরি করা যায়। কিন্তু শিক্ষক তৈরি করা যায়না। শিক্ষকের মন স্বাধীন না হলে প্রাণের সলতে দিয়ে আলো জ¦ালানোর কর্মটি করা সম্ভব নয়।”
শিক্ষকদের নিয়ে চমৎকার একটি উদ্ধৃতি আহমদ ছফার লেখার মধ্যে এখনও জ¦লজ¦ল করছে। পাকিস্থানি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখতে গিয়ে এবং সামরিক জান্তার কবল থেকে শিক্ষকদের মুক্ত করার জন্য এভাবেই নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন আহমদ ছফা। শিক্ষক দাস নয়, শিক্ষক একজন মহান ব্যক্তি। যার কর্ম শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। স্বাধীন চিত্তে, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে যখন শিক্ষক তার জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ¦লন করে এবং সেই প্রদীপ শিখার আলো লাখ কোটি প্রাণে ছড়িয়ে দিতে পারে তখনই শিক্ষক সার্থক। শিক্ষকের প্রচেষ্টায় জেগে উঠবে ঘুমন্ত প্রাণ। জাগ্রত হবে মুমূর্ষ বিবেক।
সমাজের প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকেও ছেড়ে কথা বলেননি। 
“প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন কাউকে সালাম দিলে, সালামটা তার প্রাপ্য বলে ধরে নেন এবং যিনি সালাম দিলেন তাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছোট লোক বলে ধরে নেওয়া হয়।” 
প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ব্যক্তির সম্মান পাওয়াটা তার অধিকার নয়। সম্মান প্রদানকারি ব্যক্তির নম্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের প্রকাশ।
গাভী বিত্তান্তের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন শিক্ষকদের অযোগ্যতা এবং দলাদলির সার্বিক চিত্র। অযোগ্য ব্যক্তিদের কাজ পাইয়ে দেওয়া, সুন্দরী শিক্ষিকাকে দিয়ে দলাদলি, লাল, নীল, বেগুনি, ডোরাকাটা দলের পাল্টা পাল্টি প্রেসনোট, শিক্ষকতার স্বকীয়তাকে বিলিয়ে দিয়ে পশুপ্রেমে মত্ত, গাভীর খামার কেন্দ্রিক গড়ে উঠা ভাইস-চ্যান্সেলরের অফিস, খামার কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট, পশুপ্রেমে মত্ত থাকায় পারিবারিক কলহ, ছেলে মেয়ের বখাটেপনা সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষকতা পেশার ভেতরের অযোগ্য মানুষদের আস্ফালনের বহিঃপ্রকাশ। 
যদ্যপি আমার গুরুর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় অধ্যাপকের অজানা কথা। আড়ালে আবডালে লুকায়িত বাংলা সাহিত্যের অনেক অজানা তথ্য। 
ভন্ড প্রতারক রাজনীতিবিদের মরণ নিয়ে ভাবনা, মরণ নিশ্চিত জেনেও অনুতপ্তবোধের সামান্য চিহ্নটুকু মুখচ্ছবিতে অনুপস্থিত, অবলীলায় জীবনের নানা কুকর্মের বয়ান ও মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা কি সমস্ত চিত্র নির্ভীক লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। একজন আলী কেনানের উথান দুঃসময়ে তার লেবাস বদল, সুসময়ে আবারও আবির্ভাব। ভন্ডসাধুর নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন। মাজার কেন্দ্রিক গড়ে উঠা সিন্ডিকেট। “মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবেই কারণ সে দুর্বল, অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্খী।”


বাঙালি মুসলমানের মুখরোচক পুঁথি কাব্যের উপর অন্ধবিশ^াস, ভ্রান্ত, কুসংস্কারকে ধর্মীয় চিন্তা চেতনার নামে অন্তরে লালন। সাহিত্য সম্রাট, বাংলা সাহিত্যের স্বার্থক উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপ্যাধায়কে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল, বাংলা উপন্যাসের জনককে অস্বীকৃতি এক শ্রেণির বাঙালি বাবুদের হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ। সব কিছুই অসাধরণ বিশ্লেষণী ক্ষমতার মধ্যদিয়ে সুষ্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন সময়ের সাহসী সন্তান আহমদ ছফা। সময়ের সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সত্য বলার সৎ সাহসের অনুপস্থিতি, সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যা বলার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হওয়া। সুখী মানুষের যেমন জামা থাকেনা তেমনি শিক্ষিত মানুষের মুখে প্রতিবাদের ভাষা থকেনা।
“পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসের বদল হয় প্রাকৃতিক নিয়মে আর আমাদের দেশের পন্ডিতদের প্রভু বদল হয় ক্ষমতার নিয়মে।”
মৌলবাদ এবং প্রগতিশীলতার লেবাসধারীদের মুখোশ উন্মোচন করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। 
“যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনের ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধি সম্পন্ন।”
ওঙ্কার, অলাত চক্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সার্বিক চিত্র। নিহত নক্ষত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তরুণ মেধাবী মুনতাসীরের জীবন সংগ্রাম এবং অকালে জীবনের কাছে পরাজয় বরণ করে ঝরে যাওয়া এক সাহসী তরুণ। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ^রী, পুস্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান, সুর্য তুমি সাথী এমন অসংখ্য গল্প উপন্যাস ও প্রবন্ধের  মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সামাজিক অপসংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত নানান ঘটনা।
অহমদ ছফা ছিলেন একজন কলম যোদ্ধা। লেখনীই তার শক্তি। লেখা তার প্রতিবাদের ভাষা। সময়ের স্রোতে কখনই গা ভাসিয়ে দেননি। মেকি বুদ্ধিজীবীদের ভিড়ে সত্যের পথে অবিচল থেকেছেন। সত্যকে লালন, সত্যকে ধারণ এবং সত্য প্রকাশে আপোষহীন ছিলেন আহমদ ছফা।


Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।