ছেলেটার শেষ কথাটা ছিলো, “আমার মা আমার সঙ্গে ছিলো।” এর পরে আরো কিছু যেন মনে হলো বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি, তার আগেই ছেলেটা পাড়ি জমাল না ফেরার দেশে।ইশ! রক্তে মাখামাখি কি বীভৎস নিথর দেহ খানি। দেখলেই ভিতরটা কেঁদে ওঠে।
মনে হচ্ছে ছেলেটা ওর মাকে নিয়ে কোথাও গিয়ে ছিলো কিন্তু আর ঘরে ফেরা হলো না। একজন গেলো হাসপাতালে আর অন্যজন কবরে।
এইতো সেদিন সন্ধ্যায় একটু রাস্তায় হাটতে বেরিয়েছিলাম। সারাক্ষণ আছি এই পুরোনো বাংলোয়, সকলের স্মৃতি আকরে। তাই ভাবলাম একটু বাহিরে ঘুরে আসি। হাঁটতে হাঁটতে গলি থেকে হাইওয়েতে চলে এসেছি। জায়গাটায় তেমন কোলাহল নেই, বেশ নির্জন। ল্যাম্পপোস্টের আলো ততোক্ষণে জ্বলে উঠেছে। আনমনে হাঁটছিলাম, দেখলাম একটা ট্যাক্সি আসছে। হঠাৎ কিভাবে কি হলো জানি না। দেখলাম গাড়িটা উল্টে আছে। বয়স ২৪/২৫ মতো এক তরুণ ছিটকে পরে আছে হাইওয়ের পাশে। দৌড়ে তার কাছে যেতেই “আমার সঙ্গে আমার মা ছিলো” বাক্য ব্যয়েই প্রকৃতির নিয়মে চোখ বন্ধ করে পাড়ি জমালো ওপারে।
ছেলেটাকে রেখে তার মায়ের কাছে গেলাম। ঠিক তখনই ওই রাস্তায় একটা লড়ি চালক লড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। লড়ির চালক এসে আমাকে সাহায্য করলো ভদ্রমহিলা কে হাসপাতালে পৌঁছাতে। হাসপাতাল থেকে সোজা বাড়িতে চলে এসেছিলাম। পরে আর ভদ্র মহিলার খোঁজ নেয়া হয়নি। চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ব্যস্ততায় আর যাওয়া হয়নি। সারাদিন শুয়ে বসে থেকেও ব্যস্ততা যেন শেষ হয় না।
সেদিনের ওই ভয়ানক ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি তা টের পাইনি। হঠাৎ 'পরীর' ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। “দাদুভাই, ও দাদুভাই আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে” বলতে বলতে আসছে আমার কাছে।
পরিচয় টা দিয়ে নিই, যে মেয়েটা দাদুভাই বলে ডাকছিলো ওর নাম পূর্ণতা।সদ্য ফুটে ওঠা ফুলের মতো সুন্দর। নাম খানা মানিয়েছে বেশ। অবশ্য আমি ওকে কখনো পূর্ণতা বলে ডাকি নি। পরী, আকাশী, নীলিমা, পদ্ম, গোলাপি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকি।
মেয়েটা আমার কেয়ার টেকার 'বিনোদ' এর মেয়ে।
বেশ ভালো বিনোদ ছেলেটা। ভীষণ যত্ন করে আমার। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির অভাব তারা বাবা মেয়ে আমাকে বুঝতে দেয় না।
রুথির মা মারা যাবার পরে খুব কষ্টে ছেলে মেয়ে দুটো'কে লেখাপড়া শিখিয়েছি। আজ তারা বড় হয়েছে, তাদের বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে, আমার ছেলে মেয়ে দুটো আজ বাবা মা'ও হয়েছে।
ছেলে চাকরির সুবাদে দেশের বাইরে থাকছে। পরীর মতো দুটো ফুটফুটে মেয়ে রয়েছে তার। বহুদিন আগে একবার ভিডিও কলে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
মেয়েকে প্রকৌশলীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে দেশেই আছে তবে সংসারের চাপে এখন আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না তেমন।
বড় আহ্লাদ করে ওর মা ওদের নাম রেখেছিলো, রুথি, হৃদান।
যাক গে সেসব কথা, তারা এখন মহা সুখে আছে। এর চাইতে বড় আনন্দের আর কি আছে এক বাবার কাছে,,,?
এখন আমার ওই মিষ্টি পরীর সঙ্গেই কেটে যাচ্ছে দিন। সেদিন আবদার করেছে যদি সে ভালো রেজাল্ট করে তাহলে তার পছন্দের চকলেট কিনে দিতে হবে। চকলেট আমি আগে থেকেই কিনে রেখেছিলাম। কারণ, আমার বিশ্বাস ছিলো সে ভালো রেজাল্ট করবে। পড়াশুনায় বেশি ভালো মেয়েটা।
কতবার বিনোদকে বলেছি, তোর বৃদ্ধ মা আর বউকে নিয়ে আমার বাংলোতে চলে আয়। কিন্তু সে তার বাবার শেষ স্মৃতি নিজের ভিটেটুকু ছেড়ে কোথাও যেতে নারাজ।
সকালের নাস্তাটা সেরে বিনোদের বানানো এক কাপ চা আর বইটা নিয়ে বসেছিলাম তার কিছুক্ষণ পরেই পরী এসেছে। ওর সঙ্গে থাকলে বেশ খানিকটা কষ্ট ভুলে থাকি। মেয়েটা আমি বলতে পাগল। ভীষণ ভালোবাসে আমাকে। মাঝে মধ্যে শাসন করে, ঔষধ কেন খাইনি, ঔষধ না খেলে সে আর আমার সঙ্গে কথা বলবে না এমন হুমকিও দেয়। এইতো এখনি গিয়ে দেখবে ঔষধ খাইনি, আবার শুরু হবে তার শাসন।