তখন কুড়িগ্রামে কলেজ মোড়ে কাজ করি। খেজুরেরতলা একটা মেসে ছিলাম। সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ। দোকানে একদিন এক ভদ্রলোক আসলেন কিছু ব্যানার নিয়ে। আমি তাকে চিনি। আমাদের কমিউনিটি তে বিশেষ একটা প্রজেক্টে কাজ করতেন। তারপর চায়ের দাওয়াত দিলে তিনি বললেন পান, চা এসব তো খাই না আপনারা খাইতে পারেন । কাঠ দিয়ে আলতাফ মামাসহ ফ্রেম বাঁধাই করা শুরু করলাম। রাত বেশ দশটা বাজে মেসে খাওয়া দাওয়া করে রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে রওনা দিলাম। ত্রিমোহনী পর্যন্ত অটোতে আসলাম। পরে আর রাজারহাটের অটো পাওয়া গেল না। জনশূন্য অন্ধকারের রাত্রিতে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে মেইন রোড ধরে রাজারহাট আসতে থাকি দুই-একটা কুরিয়ার গাড়ি, আর মালবাহী পিকআপ চলছে দশ পনেরো মিনিট পরপর। শীতের রাত, ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতেছে। এত রাতে কেউ অটো নিয়ে বের হয় না অটো ছিনতাইকারীর ভয়ে। পথ চলতে চলতে সেদিন বাড়ী ফিরতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে ছিলো। শুক্রবার করে কাজ বন্ধ থাকতো। সেদিনটা করে শাহিন স্যারের সাথে তাদের প্রোজেক্টের স্টিকার লাগাতে যেতাম। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, দুপুরে হালকা নাস্তা খেয়ে নিতাম। স্যারের সাথে নানা ধরনের কথাবার্তা হতো। স্যারের বাড়ি খুলনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম খুলনা তো বাংলাদেশের উন্নত একটা জেলা।
স্যার বললেন: হ্যাঁ মোটামুটি। খুলনা গিয়েছিলে?
না স্যার। আমার একটা বান্ধবী তার নানাবাড়ি খুলনায় সে গিয়েছিল তার কাছে শুনেছিলাম।
একদিন ছিনাই হয়ে মেকলী গ্রামে স্টিকার লাগাতে গেলাম। স্যারের কথা মত কাজ করতে থাকলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল "তোমাদের এদিকে তোষা পাট পাওয়া যাবে?"
- না, তবে হাটের দিন খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে।
- আচ্ছা।
মোটামুটি কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি শুক্রবার স্টিকার লাগানো কাজ চলল। পারিশ্রমিক ও পেলাম।
একদিন কাজ সমাপ্ত করতে দেরি হয়ে গেলো। স্যার রাজারহাট উপজেলা রোডে মোটর চালালেন। কৃষি ব্যাংকের পাশে একটা বাসায় এসে ব্যালকুনির সামনে মোটর সাইকেল রেখে ক্লান্তিভরা কন্ঠে ডাকল
- রুমি, এই রুমি।
-আসছি । বাইরের ছিটকিনিতে একটা সোনালী রঙের তালা ঝুলছে। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম একজন তরুণী পরনে জামা প্যান্ট। বুঝতে দেরি হলো না যে ইনি স্যারের স্ত্রী। আমাকে দেখে মাথায় ওড়না টেনে ঘোমটা দিলো । আমি ভিতরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম । আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারপর বললেন
-এই যে নিলয় ভাই বসো । লজ্জা পাচ্ছ নাকি?
- ও তোমার আপা হয়।
- আমি আপাকে আদাব জানালাম।
- আপু আমার সাথে কুশল বিনিময় করলেন।
তারপর অগোছালো ঘরের ছোটখাটো জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করলেন।
দেখলাম স্যার বোতলে করে পানি নিয়ে আসলেন।তারপর আপা টিভি চালু করে ক্রিকেট খেলা দেখতে শুরু করল । ম্যাচটা ছিলো শ্রীলঙ্কা বনাম বাংলাদেশের ।আর আপুর হাতে একটা সাজেশন। নিশ্চুপ হয়ে থাকলাম , কিছুক্ষণ পর বললাম আপু কিসে পড়েন।
-অনার্স তৃতীয় বর্ষে ম্যানেজম্যান্ট। তুমি পড়াশোনা করো?
- হ্যাঁ, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছি।
- তাই ,কাজ ও করো দেখছি।
- কি করবো আপু নিজের পড়াশুনার খরচ লাগে সে জন্য কাজ করি। ভর্তির সময় তো অনেক টাকা খরচ হয়।
- হুম দোয়া করি অনেক ভালো করে পড়াশোনা করো।
- আপনি খুব ক্রিকেট পছন্দ করেন বুঝি?
- হ্যাঁ মোটামুটি তোমার ভাইয়া ও ক্রিকেট পছন্দ করে।
- আপু আপনি কোন কলেজে পড়েন?
- সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ।
- ও আচ্ছা।
তারপর এদিকে একটা পিরিচে করে সিদ্ধ ছোলা আর মুড়ি, সাথে একটা চামচ দিয়ে খেতে দিলেন। আমাকে বললেন, তোমার আপু তো আজ রান্না করেনি দেরি করো আমি রান্না করি।
-না না স্যার। আরেকদিন এসে না হয় খেয়ে গেলাম।
তারপর আপু আমাকে হালকা মরিচা পড়া একটা বটি দিয়ে আখ কেটে খেতে দিল। আপু আর আমি নিশ্চুপে খেলা দেখতে ছিলাম। স্যার প্রজেক্ট এর কিছু নথিপত্র আপুর পাশে বসে গোছগাছ করতে ছিলেন।
খাওয়া শেষে একটা হালকা তক্তাপোষ যেখানে একটা মুখ বন্ধ বস্তা আর একটা কার্টুন পাশে গ্যাসের সিলিন্ডার আর সংসারের বাসন-পাত্র রাখা আছে। কার্টুনের ভেতর থেকে জুসের বোতল বের করে খেতে দিলেন । আমি না খেতে চাইলে স্যার বললেন খেয়ে নাও নিলয়। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে তোমাকে রেখে আসি। আপুর আতিথিতেয়তায় আমি বিমুগ্ধ হয়ে গেছি। শেষে আপু বলল, ভাত খাওয়াতে পারলাম না মনে কিছু নিও না।
তারপর স্যারের মোটর সাইকেলে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
চলতে চলতে স্যার বললেন।
-নিলয় কম্পিউটারের কোর্স করিও। যেগুলোতে আবেদন করতে পারবা সেগুলো তো একটু চেষ্টা করিও। তোমার আপুকে নিয়ে আগামীকাল আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। এক মাস পর আমি কক্সবাজারে স্থানান্তরিত হয়ে যাব। তাই জিনিসপত্রগুলো বিছানায় বস্তা বেঁধে রেখেছি। আর আমাদের বিয়ে হওয়ার বছরখানেক পার হয়ে গেল গ্রামের বাড়িতে তোমার আপু ওর বাবার বাড়িতে যাবে। কক্সবাজারে গুছিয়ে নেয়ার পর সেখানে নিয়ে আসব।
-আচ্ছা স্যার আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন।
- নিশ্চয় নিলয়।
স্যার চলে যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে একদিন মোবাইল করেছিল।
তবে আমার সাথে কথা হয়নি। আরেকদিন আমি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- কেমন আছেন স্যার?
- হ্যাঁ ভালো আছি নিলয়। তুমি কেমন আছো?
- ভালো
- সেদিন তোমাকে ফোন দিয়ে পাইনি। তোমার জন্য একটা খুশির সংবাদ আছে।
- বলেন স্যার।
- তোমার আপুর মেয়ে হয়েছে।
- তাই শুভকামনা আর শুভেচ্ছা রইলো।
কয়েক দিনের পরিচয়ে আমার কত আপন হয়ে গেছে যেন স্যার । মাঝে মাঝে মনে পড়ে। স্যারের সাথে বেরিয়ে কিছু শিখেছিলাম যা বারবার মনে করিয়ে দেয়। স্যারের কথা বলার ভঙ্গি ও হাটা চলার ভঙ্গি টা বাড়িতে এসে অনুকরণ করতাম। ভালো থাকুক ওরা ভালো থাকুক আপুর ফুটফুটে সন্তানটি।