মেয়েটা কলম কামড়ে ধরে ছাদের কোনায় বসে আছে। হাতে একটা খাতা। চোখ পানিতে টলমল করছে। কারণ মেয়েটার অনেক দুঃখ।
সত্যিই মেয়েটার অনেক দুঃখ। কলেজ থেকে ফিরে কেবল মাত্র ঘামে ভেজা পোশাক পালটে খাবার খেতে বসেছে। রান্নাঘর থেকে মামীর চিল্লাচিল্লি, অভিযোগ কে যেন একটা মাছের পিস বেশী খেয়ে ফেলেছে। মেয়েটার গলা দিয়ে ভাত নামে না, মনে হয় ভাত গুলো দলা বেঁধে গলায় আটকে রয়েছে।ভাতের প্লেট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। মামীটা সুযোগ পেলে রোজই এমন করে।
সত্যি মেয়েটার অনেক দুঃখ। আব্বু- আম্মু বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে আছে। বিদেশ- বিভূঁই না বলে উপায় আছে, ওটা নামকাওয়াস্তে দাদাবাড়ি। গত দশ বছরেও যাওয়া হয় নি। না না হয়েছিল,যেবার আম্মু চিরদিনের জন্য শুয়ে পড়লেন অই বাড়ির পারিবারিক গোরস্থানে,আম্মুর কবরটা হয়েছিলো ঠিক তার দাদীর কবরের পাশেই।
মেয়েটার সত্যিই দুঃখ অনেক। মেয়েটা আম্মুর আদর খুব একটা পায় নি,যতবার তার আম্মুর সাথে দেখা হয়েছিল ততবারই আম্মু তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকত যেন তাকে চিনে না । আম্মু আর সুস্থ হলোই না। তার আগেই চলে গেল।
মেয়েটার মনে ঢের দুঃখ আছে, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা দুঃখ। অন্যরকম দুঃখ। বাবা বিয়ে করলেন আবার, মেয়েটার মনে অনেক ক্ষোভ জমেছিলো সেবার। আবার মুহূর্তেই মিলিয়ে গিয়েছিলো, বাবাই তো! কিন্তু বাবার যখন আরেকটা মেয়ে হলো। খবরটা শুনেই মেয়েটার মাথাটা ক্যামন যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল, কি যেন হারিয়ে গেল ভেবে মেয়েটার মন বিষিয়ে উঠেছিল। সত্যিইই তাই, যাব যাব বলে কবে থেকে বাবা আর এ বাড়িতে আসে না।
মেয়েটা কলমটাকে তার কামড় থেকে নিষ্কৃতি দেয়। মেয়েটা খাতায় কলম চালাতে থাকে, স্কেচ আঁকে মেয়েটা। আঁকতে আঁকতে মেয়েটা সুখী হয়ে উঠছে।
মেয়েটার সত্যিই সুখ আছে। নানী বেঁচে আছে, এই বুড়ো বয়সে যার চিন্তাভাবনার সমস্ত টাই জুড়ে রয়েছে এই মেয়েটাই। মেয়েটার খাওয়া-দাওয়া, গোসল সবকিছুর দায়িত্ব তিনি আজও বয়ে নিয়ে চলেছেন। রয়েছে আলাভোলা, সাদাসিধে বড় মামা। ভাগ্নী কে ভালবাসেন, কতরাত যে মামা- ভাগ্নী সহ একসাথে ব্যলকনিতে বসে গান গেয়েছে। ছোট আন্টি তো মেয়েটার পড়াশুনা বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। সুযোগ পেলেই বলে উঠেন, কিরে ক্লাস ক্যামন হচ্ছে? পড়া বুঝিস তো? পরীক্ষা কবে?
মেয়েটার সত্যি প্রচন্ড সুখ আছে। মেজ আন্টির মত মা আছে। মেয়েটার আস্ত অস্তিত্ব জুড়েই মেজ আন্টি। মেজ আন্টিই তো তার জীবনের পুরো ভার বহন করে চলেছে। অসম্ভব ভালবাসেন, বাহির থেকে বোঝা যায় না। মেয়েটার কষ্টে লুকিয়ে তিনিও ডুঁকরে কেঁদে উঠেন। মেয়েটাই যেন তার একমাত্র সন্তান, ওপরওয়ালা চমৎকার ভাবে সেই ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন বটে।
মেয়েটার স্কেচ আঁকা অনেকটা হয়েছে। একটা মেয়েরই ছবিই এঁকেছে। বউ বউ চেহারার আদলে একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। নাকে নোলক পড়িয়েছে, মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে। ঠিক তার পাশেই তার বরটাকে একেঁছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। উসকো-খুসকো চুল,খোঁচা খোঁটা দাড়ি-মোচ যার মুখ অবয়বে। তারপর মেয়েটা কি ভেবে স্কেচের মেয়েটার পাশে লিখল নিজের নামটা, বরের পাশে প্রিয় মানুষটার নাম।
মেয়েটার সত্যিই এত্তগুলা সুখ আছে। এই প্রিয় মানুষটার সাথে মেয়েটার রোজ দেখা হয়। যার কাঁধে মাথা রাখলে মেয়েটার সব দুঃখ মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষ সে, যার জন্য পৃথিবী তে তাকে ছাড়া আর তার চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু থাকে না। তার প্রিয় মানুষটা যখন নিঃসংকোচে তার হাত ধরে বেড়ায়,রাস্তা পার করায়। মেয়েটা লজ্জায় ডুবে মরে,তবুও মেয়েটার অনেক ভাল লাগে। মানুষটার চোখের দিকে তাকালেই বোঝে মেয়েটা, সেই মানুষটার একমাত্র অধিকারিণী।
স্কেচ আঁকা শেষ। স্কেচটার অবয়বে সদ্য বিবাহিত দুটা মানব- মানবীর চোখে- মুখে এক চিলতে হাসি।
এক দৃষ্টে মেয়েটা নিজ হাতে আঁকা স্কেচটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নাকের কাছে আসা অবাধ্য চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। মেয়েটার মুখেও এখন এক চিলতে হাসি।
- তাহমিদ আহবাব