কর্কশ ।। শ্রাবন্তি দেব স্মৃতি



মনটা গম্ভীর। আশপাশটা কেমন ছাইয়ের মতো লাগছে। আচ্ছা ছাইয়ের ভিতরে তো সোনা থাকে; তবে কী আমিও আশপাশের ছাই থেকে কিছু পেতে যাচ্ছি... আমার দেখার কী কোনো ত্রুটি রয়েছে।  আশপাশটা৷ আরও যত্ন নিয়ে কী আমার দেখা উচিত...কী বা দেখবা..সেই তো ঘুরে ফিরে একই জিনিস... রাস্তা ঘেঁষে এক ২ তলা কুটির... নীচতলাটা পুরাটা উঠান …উঠানের একপাশে  ২ টা টিউবওয়েল.. সারাদিনের খটখট শব্দে মাথা ধরিয়ে দেয় তার সাথে যুক্ত হবে বাড়িওয়ালা - ভাড়াটিয়াদের  এক বড়সর চেচামেচি...মা প্রায়ই কাজ ফেলে তৈরি হয়ে যায় আচল কোমরে গুঁজে বাড়িওয়ালাদের বাড়ির বউয়ের সাথে লাগতে..পানের চুন থেকে জুতার ফিতা এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে  তাদের লাগে না...বাবা নির্বিকার চিন্তায় চায়ে চুমুক দিয়ে বাড়িওয়ালা নাফিজ চাচার সাথে আড্ডা জমিয়ে দেন যেনো বাবা আর চাচা এই ঝগড়াঝাটি তাদের সকালের অংশ হিসেবেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন..তাদের এই গল্পে যুক্ত হয় রিয়াদ যিনি বয়সে আমার থেকে নয়/দশ বছরের বড় হলেও তার কথা বার্থা অমায়িক আমার সমবয়সীদের মতে..কী সুন্দর তিনি..তার স্নিগ্ধতা-সুনৃদরতা  হয়তে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রেখেছে  এই অসুন্দর সাথে... না ভুল বললাম..শুধু উনি নয় এই বাড়ির পিছনে একটা কুয়া রয়েছে সেও আমার নিস্তব্ধতার সঙ্গী.. আমার মনের সকল অভিমানের সাক্ষী... বাকিরা আমার মনের কথার গুরুত্ব না দিলেও আমার কুয়া তা দেয়..সুন্দর করে আমার সকল কথা শোনে... কুয়ার ভেতরটা আমাকে প্রবল মুগ্ধ করে..বারবার উঁচু হয়ে ভিতরটা জানার চেষ্টা করি..মনে হয় আমার মতোই কেউ ওখানে রয়েছে যে কুয়াকে তার সকল কথা বলে কষ্ট লাগঘ করে...বারবার তাকে আমি ছুঁতে চাই..দেখতে চাই...যত  ছোঁয়ার চেষ্টা করি, আগ্রহে উঁচু হয়ে দেখতে যেতে থাকি, যত কুয়ার গভীরের অজানাকে জানতে যাই ততবার," অনু, এই অনু  কী করছিস.. মরবি নাকি বলে  চেচিয়ে উঠে গালে দুটো ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় মনা ...
এই দেখো.. এতো কথা বলতে বলতে আমার পরিচয়টাই যে দেওয়া হলো না তোমাদের... বাবা আনন্দ ও মা  অনামিকার ছোট সন্তান আমি অনামি ওরফে অনু.... বয়স আর পনেরদিন পর পনেরতো গিয়ে পড়বে.. আমার বড় বোনা মনামী ওরফে মনা এবার এবার ১৯ পের করিয়ে ২০ এ পা দিয়েছে.... 
রিয়াদ ভাইদের বাড়ির একমাত্র ভাড়াটিয়া আমরা... আমাদের বাসার দুই পরিবারের বউয়ের  ঝগড়াদিয়ে শুরু হলেও রাত শেষ হয় দুজন দুজনকে পানের বাটি থেকে পান সাজিয়ে দিয়ে ঘুমাতে গেলাম ভাবি বলে... বাসার মধ্যে সারাদিনের কর্মকান্ড কাউকে বিচলিত করে না...সবাই সবার মতো নিজ স্বার্থে ব্যস্ত যেনো একই  ছাদের নিচে থাকলেও ছাদ গুলো আালাদা... কারে ছাদ কাউকে স্পর্শ করছে না...মানুষ এত নির্বিকার কীভাবে হয় তা গবেষণা করতে করতে আমার দিন পার হয়...না একটু ভুল বললাম..আমার দিন পার হওয়ার বিশেষ মূহুর্তগুলোর মধ্যে হলে রিয়াদ ভাইয়ের কর্নকান্ড দেখে, তার গল্প শুনে দিন পার করা...কী বিষ্ময়,, সীমাহীন কষ্ট -দুঃখকে একসাথে নিয়ে আমি রিয়াদ ভাইয়ের সাথে সময় কাটাই...এসবের ব্যাখ্যা হাজার চেয়েও আমার মন ব্যাকুল-অস্থির হওয়া ছাড়া আর কোনো উত্তরই পাইনি আমি...  আচ্ছা এসবের উত্তর যদি আমি রিয়াদ ভাইয়ের থেকে চাই আমি উনি কী দিবে আমাকে উত্তর নাকি নিষিদ্ধ করে দিবে তার ঘরের দড়জা.!.. কোনটি হবে- কোনটি হবে না  এইসবের থেকেও আমি এখন অতি আগ্রহে বসে আছি আমার জন্মদিনের জন্য...জন্মদিনে রিয়াদ ভাই সবসময় বিশেষ আকর্ষণ সবার..সবাইকে সবার জন্মদিনে খুশি করে দেওয়াী মতো ক্ষমতা তার প্রবল..এইতো কিছুদিন আগে মনা আপুকে ২০ তম জন্মদিনে ২০ প্রকারের গোলাপ ফুল দিয়ে তার জন্য গান গেলো..দুজনে ছাঁদে গিয়ে কবিতা পড়লে..আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি আর বিষ্ময় হয়েছি রিয়াদ ভাইয়ের গুণে..ইচ্ছে করছিলো দৌড়ে গিয়ে সামিল হই ওদের সাথে..আমার উপর কোনো জাদু হয়ে যাক..বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রিয়াদ ভাইকে আকর্ষণ করি.. 
কিন্তু অলৌকিক দিবাস্বপ্ন তার জগতেই পড়ে রইলো..আমার উপর কোনো জাদু  হলো না...নিঃসঙ্গীর মতো আমি মনে মনে কষ্ট নিয়ে মাকে সাহায্য করতে লাহলাম..
এবারো কী তাহলে রিয়াদ ভাই আমার জন্য ওমন কিছু করবে..আমাকে চমকে দিবে..! নাকি তার এই বিশেষ ক্ষমতা শুধু বিশেষ মানুষের জন্য কে জানে...মনা কী তার তাহলে সেই বিশেষ  মানুষ..!!আচ্ছা বিশেষ মানুষ মানে কী? যে খুব অঙ্ক পারে যেমন মনা ভীষণ ভালো অঙ্ক পারে..রিয়াদ ভাই তাকে অঙ্ক করায় আর ওর খুব প্রশংসা করে..দু'জন অনেক সময় কাটায় একসাথে.. আমার দেখে কেনো জানি খুব মন খারাপ হয়... 
আচ্ছা বাবাকে যদি এই বিশেষ মানুষের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করি তাহলে কেমন হয়?...বাবার কোনো বিশেষ মানষটার ও নাম জানা হয়ে যাবে এই ফাঁকে... তবে বাবা যদি বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করে "তোর বিশেষ মানুষটাকে আমার কাছে  বিশ্লেষণ কর " তখন আমি কী বলব...বাবাকে আমি মিথ্যা বলতে পারবো না...বাবা আমার চোখর দিকে তাকিয়েই সব যদি বুঝে ফেলে তখন কী হবে..বাবা তো খুব বুদ্ধিমান তাকে ফাঁকি দেওয়া বিশাল ব্যাপার...  ধুর  আমি এসব কেনো ভাবছি..আমার তো কোনো বিশেষ মানুষই নেই...তাও আমার মনটা এমন আনমনে হয়ে লাফাচ্ছে কেনো বিশেষ কথা শুনে...তবে কী আমার মন কোনো  ইঙ্গিত দিচ্ছে যেটা মস্তিষ্ক ধরতে পাচ্ছে না.….তবে কী মস্তিষ্কের ইঙ্গিত -মনের ইঙ্গিত আলাদা.. তাদেরও কী আমাদের বাড়ির দুই বউয়ের মতে দা-কুমড়া সম্পর্ক হলেও দিনশেষে এক সঙ্গেই কাজ করে..
ধুর কীসব ভাবছি...আর একদিন পর আমার জন্মদিন... সবার ব্যাস্ততা আমার নজরে না পড়লেও রিয়াদ ভাইয়ের কোনো আজানা কারণের খুশি মুখ, আনন্দময় ব্যস্ততা আমাকে ভাবাচ্ছে... রিয়াদ ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে  তার সাধনার বহু অপেক্ষার কোনো কাজ খুব শ্রিগই হতে যাচ্ছে..... মন চাচ্ছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করি কীসের এত চোখ ঝলসানো খুশি তোমার....আমার জন্মদিন তাই!... রিয়াদ ভাইয়ের দরজায় কড়া নাড়লাম আর সাহস করে বলেই ফেললাম কী গো রিয়াদ ভাই..মনে আছে আর   ৬ ঘন্টা পেরুলে আমার জন্মদিন... আমার গিফট রেডি তো?..
রিয়াদ ভাই এক অপরুপ হাসি হেসে আমার গাল টিপে বলল," হ্য রে সব মনে আছে.. সময় হোক দেখ তোকে এমন এক উপহার দিবে যা তোকে আনন্দে নাচাবে...আমিও তোদের হতে যাচ্ছিরে...যা যা শুয়ে পর...সকাল হতে বেশি দেরি নেই..সকালেই তোর জন্মদিন পালন করবোতো আমরা...যা ঘুমা.."..
আমার শরীর এক ঝটকা দিয়ে উঠলো...প্রতিটি কথা কানে বাজতে লাগলো... রিয়াদ ভাই আমাদের হতে যাচ্ছে.. তবে কী সে আমাকে বুঝতে পেরেছে...আমার ঠোঁটের কণায় অজানা হাসি... আমি চলে আসতে লাগলাম এমন সময় রিয়াদ ভাই আবার ডাকল, বলল একবার মনাকে ডাক দিস তো...ওর সাথে আমার কথা আছে...জলদি ডেকে আন..
আমি মনা আপুকে নিয়ে এলাম..ওরা ছাদে চলে গেলো চোখের আড়ালে... আমিও গেলাম পিছু পিছু.. গোপনে দাঁড়িয়ে রইলাম.. রিয়াদ ভাই মনার হাত ধরেছে আর বলছে তোর-আর আমার বিয়ে পরিবার মেনে নিয়েছেরে... তারা কাল আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করবে...আমি তোদের হয়ে গেলাম...আমি তোর হয়ে গেলাম..মনা আপু কাঁদছে... রিয়াদ ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে কাদছে বলছে সৃষ্টিকর্তা আমার কথা শুনেছে...আমরা এক হতে যাচ্ছি প্রিয়...অনু শুনলে অনেক খুশি হবে...খুশিতে নাচবে.. ওকে কালই আমারা সব জানাবো...
অনু থমকে রয়েছে.. এক ঘোরের ঘুণির্তে ঘুরছে...ব্যক্তি স্বার্থ নাকি পরিবার স্বার্থ কোনটিকে বেছে নিবে তার  প্রবোল দ্বিধা তাকে নাশ করছে...সে হুট করে বড় হয়ে গেছে...না পরিস্থিতি বড় বানিয়েছে...সূর্যের আলােয় চারপাশটা জ্বলজ্বল করছে... মনার হাত থেকে আয়না ভেঙে যাওয়ায় তার মা ভিষণ চিলাচ্ছে  কারণ সে স্বপ্ন দেখেছে কোনো মৃত মানুষকে গোসল করানো হচ্ছে বাড়িতে... চারপাশের সবাই আনন্দ করছে..তাও মাথার উপর  অনেক কাক কা- কা করছে...
রিয়াদ ভাই আমাকে ডাকছে কই যাচ্ছিস অনু...আমি তাকে বলছি অজানাটাকে এবার জানতে হবে...সেটার উদ্দেশ্যই যাচ্ছি ভাই কুয়াটার কাছে ... রিয়াদ ভাই থতমত খেয়ে বলে কী বলছিস.. যা মনার কাছে যা..ওও তোকে সাজিয়ে দিবে...
মনা নিচে নেমে আসছে আমাকে সাজানোর জন্য নিয়ে যেতে...
অনু কুয়োটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
কুয়াটা ভীষণ  গর্জন করে ডাকছে...সেই ডাক সবার কানে পৌছায় না... কেউ কেউ পায়... 
চারদিকের হুলুস্তুলুআর কাকের কর্কশ ডাক  কেমন যেনো করে তুলছে পরিবেশটা...তার সাথে কুয়ার ভয়ংকর গর্জন....এই গর্জনকে উপেক্ষা করা হয়তো আর কারো সাধ্যি  হবে না...
পনের বয়োসের খুকি অনু   হয়তো অজানার রহস্য উন্নোচন করেই ফেলবে! রহস্যের ভার বইতে না পারা কুয়াকে প্রশস্তি দিবে... নাকি  আবার আগের মতে অনুর গালে মনা এসে আগের মতে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিবে মনা!...কুয়ার গর্জন কী থেমে যাবে.. নাকি কাউকে সে ডেকে নিয়ে যাবে তার রহস্য উন্মোচনে... 
 এই রহস্যময় পৃথিবীতে তার নিজস্ব রহস্যের ভার থেকে তবে কী কুয়া প্রশস্তি  পেতে যাচ্ছে ...!  কেননা কাকগুলো যে এখনো জড় হয়ে মাথার উপর কর্কশ হয়ে কা কা করছে... 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।