আহমদ ছফা ৩০ জুন ১৯৪৩ সালে চট্রগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছ বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হেদায়েত আলী ও মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। পিতার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষার হাতেখড়ি। আহমদ ছফা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মধ্যবিত্ত পরিবারের গন্ডি থেকে বের হতে পারেননি। বের হওয়ার চেষ্টাও হয়তবা কখনও করেননি। আহমদ ছফার সরল স্বীকারোক্তি আমার পরিবার চাষা। আমার পক্ষে এটা ওভারলুক করা কষ্টকর,রঙ চড়িয়ে কিছু বলতে চাইনা। আমার পূর্বপুরুষেরা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ছিল। এই পরিচয় আমার অহংকার।
কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করাটা সত্যি এক গর্ব এবং অহংকারের বিষয়। যে অহংকার মাথা উচু করে বাঁচতে শেখাই।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে মাথা উচু করেই বাঁচতে চাই। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। এ লড়াই খেয়ে পরে বেঁচে থাকার পাশাপাশি আত্মমর্যাদার লড়াই।
লেখক, উপন্যাসিক, কবি ও মুক্তচিন্তাবিদ আহমদ ছফা। মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক। সত্যকে লালন করে মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার সংগ্রামের অগ্রনায়ক ছিলেন আহমদ ছফা। প্রথাবিরোধী,স্পষ্টবাদিতা ও নিজস্ব স্বকীয়তার মত অসংখ্য গুণে গুণান্বিত। সত্যের পথে অবিচল, নির্ভীক একজন কলম যোদ্ধা। পাহাড় সমান ব্যক্তিত্বের অধিকারী আহমদ ছফা।
মার্ক টোয়েন বলেছেন- “সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে কথা বলে সে ব্যক্তিত্বহীন।”
উপন্যাস,প্রবন্ধ ও কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সমাজের অবক্ষয়। লেখার মাধ্যমে ভন্ড, কাপরুষতার মুখোশ উন্মোচন করেছেন। সাহসীকতার সাথে লড়েছেন কুসংস্কার ও অন্ধত্ববাদের বিরুদ্ধে। আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠ, আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিশীল। সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে অনন্য এক নাম। ধর্মান্ধতা ও হীনমন্যতার বিরুদ্ধে আপোষহীন।
আহমদ ছফা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন অকৃত্রিম ভালোবাসায়। শিক্ষকদের দলাদলি, অসৎ রাজনীতিবিদ, খুন, ব্যভিচারী, সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী নেতা এবং এক ভন্ড সাধুর উথান পতন তুলে ধরেছেন প্রতিবাদী কলমের মাধ্যমে। অনুসন্ধিৎসু মনের ব্যাকুলতায় খুঁজে পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে। স্মৃতি চারণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সাহিত্যের লুকায়িত সম্পদ।
আহমদ ছফার লেখার মাধ্যমে উঠে এসেছে প্রকৃতি ও প্রেম। যান্ত্রিকতার শহর ঢাকা। ঢাকা শহরে উদ্ভিদ ও পাখি প্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন আহমদ ছফা। ব্যক্তিগত জীবনের নানান ঘটনাবলি তুলে ধরেছেন অবলীলায়। মনের গোপন কোণে যে স্বপ্ন উঁকি দিয়ে গিয়েছে তার সফল পরিণতি আসেনি। সমাজ নিয়ে ভাবনা চিন্তা যার নিত্য দিনের কাজ। তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া অপূর্ণ থাকাটা স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার অপূর্ণতা থাকার পরও মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। কুরুচি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের মুখোশ টেনে খুলে দিয়েছেন।
বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাস তার সাহসী পদক্ষেপ। বাঙালি মুসলমানদেরকে ধর্মান্ধতার অন্ধকার থেকে বের করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন আহমদ ছফা। অড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা শিল্পী এসএম সুলতান ও তরুণ মেধাবী মুনতাসীরের পরিচয় তুলে ধরেছেন। অপোষকামী ও সমাজের ভীরু কাপুরুষদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। শাসক শ্রেণির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শক্ত হাতে, প্রতিবাদী কলমের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন জুলুমের চিত্র। কখনওবা একাই গর্জে উঠেছেন জুলুমের বিরুদ্ধে। মেকি বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা তুলে ধরেছেন কাগজের পাতায়। ভোগ বিলাসী জীবনকে পরিহার করে বেছে নিয়েছেন বোহিমিয়ানের জীবন। সময়ের স্রোতে কখনও গা ভাসিয়ে দেননি। সংসার বিবাগি হয়েও সমাজ থেকে বিচ্যুত হতে পারেননি। বস্তির অবহেলিত শিশু কিশোরদের শিক্ষাসহ সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বিভিন্ন মত ও পথের লেখক ও কবি সাহিত্যিকদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন লেখক শিবির। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রতিরোধ’ ও ‘দাবানল’ পত্রিকা। ব্যক্তিত্বের বিশালতায় সাহিত্যঙ্গনে আহমদ ছফা এক ও অদ্বিতীয়। স্পষ্টবাদিতায় আহমদ ছফার জুড়ি নেই। আহমদ ছফা একটি প্রতিবাদী নাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন। আহমদ ছফা এই ঘুণেধরা সমাজের আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলেন। ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় আহমদ ছফা অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের জন্য অনুকরণ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আহমদ ছফা শুধু পাঠ করার বিষয় নয়,আহমদ ছফাকে অন্তরে লালন করার বিষয়।
সরদার ফজলুল করিম স্যার যথার্থই বলেছেন-ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চার বিষয়।
প্রভাষক, লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ
নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।