লকডাউনে সাধারণ মানুষ কেমন আছে? ।। রাজু চন্দ্র দাস

করোনা মহামারিতে লকডাউন শব্দটি আমাদের বার বার উচ্চারণ করতে হচ্ছে। লকডাউন শব্দের অর্থ হচ্ছে-তালাবদ্ধ করে দেওয়া। শব্দটি ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়-"কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে ঘর থেকে বের হতে না দেয়া কিংবা ঘরের বাহিরে বের হলে বাঁধা দেওয়া"।
করোনা বর্তমান বিশ্বে একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস এর নাম। ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশ থেকে এই মরণঘাতী ভাইরাসের সূচনা হলেও অতি অল্প সময়ে সারাদেশে এর বিস্তৃত লাভ করে। এবং এই ভয়ংকর ভাইরাসের থাবায় সারা পৃথিবীতে  মৃত্যুর পথযাত্রী হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। রেহাই পায়না বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও!
বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত করা হয় ৮ মার্চ ২০২০ সালে। তারপর ১৭ মার্চ সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন  এবং  কোভিড-১৯ এ প্রথম রোগী  মারা যায় ১৮ মার্চ ২০২০ সালে।
১৯ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশের মাদারীপুরের শিবচরে প্রথম লকডাউন করা হয়। তারপর ২৬ মার্চ সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় অতঃপর চলতে থাকে সারাদেশে লকডাউন এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত চলমান!
আর সেই লকডাউনে  রিক্সাচালক, ভ্যানচালকসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকেরা পড়েছে বিপদের অকূল সাগরে।
দীর্ঘ একবছর লকডাউনে অনেক কষ্টে জীবন পাড় করলেও এখন আর চলছে না সংসার।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দীর্ঘদিন ধরে লকডাউন থাকায় লাগামহীন ভাবে বেড়ে চলছে কর্মহীনতা এবং দারিদ্রতা। নেই সরকার থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা! কিভাবে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকবে তার নেই কোনো নিশ্চয়তা নেই আশ্বাস দেওয়ার মতো কেউ!! তাহলে কি হবে এই সাধারণ মানুষের!!  
বাংলাদেশের মত একটি দেশে যেখানে এখনও প্রায় ৬০ শতাংশ লোক দিন আনে দিন খায় সেখানে কীভাবে মেনে নিবে তারা এই লকডাউন?
নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজ এখন হয়ে আছে বলির পাঠা! 
লকডাউনের খবর শুনলেই সরকারি আমলা ও উচ্চশ্রেণির লোকেরা ছুটে চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানে আর কিনে নিচ্ছে মাসিক বাজার। অথচ রিক্সা চালক,ভ্যান চালকের মতো হাজার হাজার মানুষ পাচ্ছে না একবেলার জন্য দু'মুটো খাবার। তারা কি করে থাকবে লকডাউনে বাসার চার দেয়ালের মাঝে  যাদের বাসা থেকে বের না হলে মিলে না প্রয়োজনীয় খাবার। 
ভিক্ষুক হয়তো সবার কাছে হাত পেতে নিজের খাবার জোগাড় করে নেয় কিন্তু একটা বার কি ভেবে দেখেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের কি অবস্থা!?
 তারা না পারে ভিক্ষা করতে না পারে লকডাউনে বের হয়ে রোজগার করে টাকা যোগার করতে। তাহলে কি করে চলবে তাদের সংসার? 
একটি দেশের অভিভাবক হচ্ছে সরকার প্রধান। আর অভিভাবক হিসেবে উচিৎ রিক্সা, ভ্যানচালকসহ মধ্যবিত্তের সন্তানেরা কেমন ও কি অবস্থায় আছে তার খুঁজ নেওয়া এবং সেবা দানের দায়িত্ব পালন করা। 
আদৌ কি তা করেছেন?? একটি বার ভেবে দেখেছেন কেমন অবস্থায় আছে সাধারণ জনগণ !
২ জুলাই ২০২১ একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে ভিডিওতে একজন বাসের হেল্পারের কথাটি ছিল এমন যে,"গাড়ি চালাতে পারে না বলে পেটে দুদিন ধরে খাবার নাই। তার একটি দুধের বাচ্চা আছে কিন্তু  মা নাই বলে বাচ্চাকে বাজারের কেনা দুধ খাওয়াতো। কিন্তু লকডাউন হওয়ার এই দুধের বাচ্চারকে দুধ খাওয়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে"! কারণ রোজগার বন্ধ তাই কেনার সামর্থ্য নেই। এই যদি হয় অবস্থা!!  তাহলে ঐ বাচ্চা শিশুটি মারা গেলে এর দায়ভার নিবে কে?
৮ জুলাই রাজশাহীতে দেখা গিয়েছে মুদি দোকানি রাস্তায় থালা নিয়ে বসে আছে তাদের দাবি "হয় দোকানপাট খোলার অনুমতি দেন নাহয় ভাত দেন"-এই যদি হয় দেশের অবস্থা তাহলে সাধারণ মানুষ কি করে বেঁচে থাকবে?
৯ জুলাই ২০২১ রাতে সিলেটে একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যা দেখে চোখের পানি আটকিয়ে রাখা অসম্ভব! 
ঘটনাটি ছিল এমন যে,"সিলেট টু ঢাকা চ্যাকপোস্টে পুলিশ যখন রাতে ডিউটি অবস্থায় ঠিক তখন দেখতে পায় একজন লোক ভ্যানগাড়ি নিয়ে ছুটে চলছে। পুলিশকে দেখে ঐ ব্যক্তি প্রচন্ড ভয় পায়। তারপর ঐব্যক্তিসহ পুলিশ ভ্যানগাড়ি আটক করলে ব্যক্তিটির কান্নার সীমা থাকে না! কারণ ভ্যানগাড়িতে ছিল একটি বস্তা পুলিশ সেটা খুলতে বলে তারপর ব্যক্তিটি বস্তা খুলে এবং বের করে পঁচা দুটি কাঁঠাল যা থেকে বের হচ্ছে  গন্ধ"।
পুলিশ তার কাছে জানতে চায় এই পঁচা কাঁঠাল দিয়ে কি করবেন?
 উত্তরে ভ্যানচালকটি বলে-"সারাদিন তার বাচ্চাকাচ্চা কিছু খায় নাই,রেলস্টেশনের পাশে পঁচা কাঁঠাল দেখে সেটা তুলে এনেছে যদি সেখান থেকে দু'একটা ভাল কোষ পেয়ে যায় তাহলে তা নিয়ে খাওয়াবে তার সন্তানকে। আর সাথে একটা বাটার বন কিনেছে"-এসব কথা বলে কান্নার ভেঙে পড়ে। এর একমাত্র কারণ হলো লকডাউনে কাজ নেই রোজগার নেই।
তখন হৃদয়বান পুলিশ কর্মকর্তা তাকে কিছু অর্থ দিয়ে সাহায্য করে থাকে।
এখন কথা হচ্ছে এভাবে যদি দেশ চলতে থাকে তাহলে এই লকডাউন দিয়ে কি হবে? যেখানে অনাহারে মারা যাচ্ছে এসব মানুষের মতো নাম না জানা অনেকেই।  
টিভি, পত্রিকা, ফেইসবুক ইত্যাদি খুললে দেখা যায় রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালক বসে বসে কান্না করছে রিক্সা নিয়ে কারণ লকডাউনে নাই তাদের আয়, চলেনা সংসার! কিন্তু মাস শেষ ঠিকই দিতে হয় বাসা ভাড়া।
লকডাউনে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের যতসামান্য যে সঞ্চয় ছিল তা শেষ করে ফেলছে। আবার নতুন করে ঋণ নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ও নেই কারণ যার আয়ের রোজগার নেই তাকে জেনেশুনে ঋণ দেবেই বা কে!
এই অবস্থায় যদি সরকার তাদের কাজ ও আয়ের ধরন বিবেচনা করে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করত তাহলেও হয়তো কিছুটা কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে চলার মতো অবস্থা হতো। কিন্তু আদৌ কি সরকার ভাবছে এমন কোনো পরিকল্পনা! 
তারপর তো রয়েছেই দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি! বিশেষ করে তেলের দাম বাড়ছে লাগামহীন ভাবে। এ অবস্থায় লকডাউন মানে কি গরিবের পেটে লাথি দেওয়া ছাড়া আর কি বুঝায় এর বেশি জানা আমার নাই।
ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোহসীন বলেন,"দেশের শহর ও গ্রামের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের"-কথা হচ্ছে শুধু কি প্রস্তুতি থাকতেই হবে এর কি কার্যকারীতার প্রয়োজন নেই!!
যদি না খেয়ে মানুষ মারা যায় তারপর আপনাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাদেরকে নিয়ে করবেন? 
কোভিড-১৯ হলে হয়তো হুট করে জীবনটা নিয়ে নেবে কিন্তু পরিবারের কর্তা হয়ে যদি দেখতে হয় ছোট বাচ্চাটি ক্ষুধার তাড়নায় না খেয়ে বসে আছে সেটা কি করোনার চেয়ে ও বড় কিছু নয়!
এই মহামারী ভাইরাসের জন্য লকডাউন হয়তো প্রয়োজন কিন্তু লকডাউনের জন্য যদি হতাশায়,ক্ষুধার যন্ত্রণায় না খেয়ে মরে যেতে হয় তাহলে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ তা বিবেচনা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি জ্ঞাপন করছি।
হ্যা,লকডাউন অতীব গুরুত্বপূর্ণ  সেই সাথে আরো গুরুত্বপূর্ণ এই লকডাউনে সাধারণ লোকজন  কেমন আছে তার খেয়াল রাখা। 
পরিশেষে বলি,বর্তমান কোভিড-১৯ এর জন্য অবশ্যই লকডাউন খুব প্রয়োজন সেই সাথে প্রয়োজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনের কথা চিন্তা করা যেন তারা দু'বেলা দুমুঠো খাবার তাদের পেটে দিতে পারে।তাদের সন্তানেরা যেন অনাহারে মারা না যায়। সেই দিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রের মানসকন্যা,মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় দৃষ্টি জ্ঞাপন করছি।  

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।