বন্যা মোকাবেলায় আমাদের করণীয় ।। সাদিয়া আফরিন

 
বন্যা(Flood)  তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোনো নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়। তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত করলে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্লাবনভূমি যেহেতু মানুষের কাঙ্খিত ও কৃষিকাজের সহায়ক, তাই বন্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ও এর ক্ষয়ক্ষতি যাতে সীমা ছাড়িয়ে না যায় তা লক্ষ্য করা জরুরী। প্রতি বছর বিশ্বের বহু অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন্যার ঘটনা ঘটছে। জুন থেকে সেপ্টেম্বরের এই সময়ে পৃথিবীর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্রীষ্ম মৌসুম জারি থাকে।
কিন্তু বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় এই মৌসুমী প্রবাহ ধেয়ে আসে মূলত উত্তরপূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের দিকে। এ সময় উপকূলীয় এলাকা থেকে আবহাওয়ায় ব্যাপকভাবে আদ্রতা নিয়ে আসে এই মৌসুমি প্রবাহ। 
বাতাসের এই প্রবাহ ঘটে সাধারণত পূর্ব হিমালয়ে। তাতে ভারি বর্ষণ এবং বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়।এর ফলে বাংলাদেশসহ ভারতের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় এই মৌসুমে বারবার বন্যার মতো ঘটনা ঘটে। 
পানি প্রবাহের ধরন-প্রক্রিয়া, জলবায়ুর কারণ ও ভৌগলিক অবস্থানগত কাঠামোর ফলে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই বন্যাপ্রবণ।
বাৎসরিক বন্যা হলেও জুন থেকে সেপ্টেম্বরের এই সময়ে বাংলাদেশে বন্যা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। এতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। বিশেষ করে বিভিন্ন নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী বন্যায় আক্রান্ত হয়। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ সবসময় নানাবিধ সমস্যা ও কষ্টের সম্মুখিন হয়।     
যেমন- ২০০৭ সালের বন্যায় প্রায় নব্বই লাখ মানুষ ঘর ও ভূমিহীন হয়ে পড়ে। এ সময় বন্যার পানিতে ডুবে ও বন্যা পরিস্থিতিতে উদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে কমপক্ষে ১ হাজার মানুষ। বন্যায় লোকালয়ের এত ক্ষয়ক্ষতির বড় কারণ হল বন্যায় নদীভাঙন। এডিবির পরিসংখ্যানমতে, বর্ষার মৌসুমে এটি বাংলাদেশের একটি স্থায়ী সমস্যা। এর ফলে প্রতি বছর নদী তীরবর্তী এক লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে করে আর্থসামাজিক কাঠামোতে দারিদ্র্য পরিস্থিতির মারাত্মক প্রভাব পড়ে।      
বন্যায় সাধারণত পানির গতিপ্রবাহ ধ্বংসাত্মকভাবে বেড়ে যায়। ব্যাপক এলাকায় এর ক্ষয়ক্ষতি ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত বন্যায় রাস্তাঘাট, গাছপালা, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, কৃষিজমি, ফসল, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ঘরবাড়ি আবাসভূমি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 
সেন্টার ফর ইনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)এর মতে, পদ্মা, যমুনা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রায় এক লক্ষ হেক্টর জমি তলিয়ে যায়। যেটি ঢাকা শহরের চেয়েও বড় হবে। নদী ভাঙ্গন ও বন্যার ফলে ঘর ও ভূমিহারা মানুষ সরাসরি এবং খুবই তাৎক্ষণিকভাবে প্রদারিদ্র্য আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে অনেকেই অন্য এলাকায় চলে যায়। এতে করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের নগর এলাকাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতি ও জলাবদ্ধতার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।      
পুনর্বাসনঃ চলতি বছরের জুলাই মাসের দিক থেকে বাংলাদেশের নিচু এলাকার অন্তত ১০ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়। সংবাদ মাধ্যমগুলো বিশেষ করে এসব এলাকায় খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সংকটের কথা জানিয়েছে।   
এধরনের বিয়কর পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত জরুরি ত্রাণ-তৎপরতা ও বন্যা দুর্গতদের মধ্যে যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলো এসব কাজে তাদের মতো করে সক্রিয় থেকেছে। তারা প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা দিয়েছে। তবে তাদের পাশাপাশি সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে। এর জন্য সরকারের এ মন্ত্রণালয়কে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে যথেষ্ট প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা, প্রকল্প বাস্তবায়নে মনিটরিং সেল গঠন করা এবং সার্বিক কাজের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এগিয়ে যেতে হবে।       
বন্যার ঝুঁকি মোকাবেলায় বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে। ২০০৭, ২০০৪ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার মতো বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ না হলেও সবচেয়ে বন্যপ্রবণ এলাকাগুলোতে সার্বিক প্রতিরোধে প্রযু্ক্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। যাতে ভবিষ্যতের বন্যা মোকাবেলায় যেকোনো ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। 
এখানে অনেকগুলো বিষয় যুক্ত আছে। নদী ব্যবস্থাপনা, মজবুত করে নদীর তীর বাঁধা এবং নদীতে বাঁধ তৈরি করার বিষয়গুলো যেমন আছে তেমনি এসব কাজ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে গেলে কি কি সমস্যা তৈরি হয় এবং দ্রুত কাজ শেষ করা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ত্রুটিপূর্ণ কাজ, পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাবসহ বিভিন্ন প্রশ্নগুলোও কাজ করে। এধরনের স্থানীয় সরকার ও জনসম্পৃক্ততার বিষয়টিও জড়িত আছে। সেকারণে বন্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে নদী ব্যবস্থাপনার সাথে এসব প্রশ্ন ও জটিলতাগুলোর সমাধান করতে হবে সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে।    
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। বিশেষত বন্যা ব্যবস্থাপনায় এ সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তারপরও বেশকিছু সংকট এখনো রয়ে গেছে। পশ্চাদমুখিতাসহ বিশেষত দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ, সমষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ, সম্পদের যথাযথ ও কার্যকর ব্যবহারে অদক্ষতা ও সংকটে চ্যালেঞ্জ নেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।       
যেসব উদ্যোগ আরো শক্তিশালী করতে হবেঃ বন্যার পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আরো দ্রুত, আধুনিক ও শক্তিশালী করতে হবে। এতে স্থানীয় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরো বড় ধরনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। বন্যাপ্রবণ ও মৌসুমি বর্ষণে বেশি ক্ষতি হতে পারে এমন এলাকায় বন্যা ও বর্ষণের পানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্থানীয় সরকারকে আরো বেশি যুক্ত করা জরুরি। এতে ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করতে আগ্রহী লোকজনকে অন্যান্য এলাকার ও পেশার লোকজনকে সম্পৃক্ত করতেও চেষ্টা করতে হবে।বিশেষ করে বন্যা মোকাবেলায় অতিরিক্ত বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে বন্যা মোকাবেলায় এগিয়ে আসাটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিকল্পনাও নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। অন্তত বছরে একবার বাস্তবায়িত উদ্যোগগুলো আরো উন্নত ও হালনাগাদ করা। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো শনাক্ত করা। মোকাবেলা করতে সক্ষমতার জায়গাগুলো কিরকম এবং কতখানি তাও চিহ্নিত করা। 
জরুরি তহবিল গঠনে সংশ্লিষ্ট খাতে এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করা। একইসাথে সরকারের দিক থেকে নির্ধারিত কাজে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চত করা। 
অপরদিকে কর্তৃপক্ষকে বন্যা মোকাবেলার ও পুনর্বাসনের সরঞ্জমাদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে পর‌্যাপ্ত পরিমাণ স্টোর, টিন, চট, বাঁশ, কাঠ, তাবু তৈরির জিনিসপত্র, লাইফ জ্যাকেট, পানি শোধনের ওষুষ বা অন্যান্য প্রক্রিয়া, জরুরি চিকিৎসা-ওষুধ, তরল ও শুকনো খাবার, খাবার পানি, পোশাক-কাপড়, সাময়িক লেট্রিন স্থাপন, ও পয়:নিষ্কাসন ব্যবস্থা, কেরোসিন তেল, হারিকেন, চেরাগ, হ্যাজাক, লাইট, চার্জ লাইট, টিউবওয়েল স্থাপন, পাইপ ও পরিবহনসহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত করা। 
ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীদের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বন্যা মোকাবেলায় সহায়তাকারী এসব কর্মীদের পানি নিয়ন্ত্রণ, দুর্গতের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব ও তড়িত দক্ষতা অর্জনের মজবুত প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। 
দুর্গত এলাকার সত্যিকার চিত্র বিশ্লেষণ করে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বেচ্চাসেবী, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকর্মীর অংশগ্রহণ বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। এসব লোকবলের অন্তত ৫০ শতাংশ হতে হবে নারী।    
এছাড়া নদী ব্যবস্থাপনা, নদীরক্ষা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও দুর্গতদের পুনর্বাসনসহ সার্বিক বন্যা উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বাধুনিক উন্নত প্রযুক্তি, ধারণা ও উন্নতদেশগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যবহারিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।      
 বন্যা থেকে প্রতিরোধ এর জন্য আরোও কিছু করনীয়ঃ-
১. বেশি বেশি গাছ লাগানো। 
২. নদীর পাড় যেন মজবুত ও উচুঁ থাকে সেই দিকে লক্ষ্য রাখা। 
৩. ড্রেজার ব্যবস্থা চালু রাখা । 
৪. নদীর পাড়ে বাঁধ দেওয়া ।
৫. নদীর চারদিকে অবৈধ্য স্থাপনা তুলে দেওয়া। 
৬. পরিকল্পিত নগারায়ন গড়ে তোলা। 
বন্যার কারণ এ প্রতিবছর ক্ষতির পাশাপাশি লাভ ও রয়েছে। পলি পড়ে বন্যার কারণ এ ফসলের জমিতে ফসল বেশি উৎপাদন হয়।
বন্যায় প্রতিবছর অনেক ব্যক্তি ঘরছাড়া  হয়ে পড়ে। যার কারণে অনেক বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আর যার কারনে সারাজীবনের কিছু মানুষের স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। 
সুতরাং, অবশেষে বলা যায় যে, বন্যা থেকে বাচাঁর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পদক্ষেপ। সেই সাথে প্রয়োজন বাস্তব উপযোগী পরিকল্পনা। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।