মানুষ সামাজিক জীব।সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয়তার তাগিদ মানুষ খুঁজে বেড়ায় মহাকালের আয়োজনে কিংবা মহাকাব্যের অমর কোন চরিত্রের পূর্ণতায়।মানুষ সামাজিক জীব হওয়ার দরুন প্রতিক্রিয়ায় একাকী বসবাস করতে পারেনা। সেই সৃষ্টিলগ্ন হতে আজ অবধি মানুষ চেয়েছে দলবদ্ধভাবে বসবাসের সুযোগ কিংবা সুপরিকল্পিত কোন এক সুন্দর জীবনের উত্থান যার কারণে পূর্ণতা পেয়েছে কোন নিত্যনৈমিত্তিক উপখ্যান।
মানুষের জীবন স্রষ্টা প্রদত্ত এমন এক উপহার যার পরিপূর্ণতা স্বয়ং মহান আল্লাহ দিয়েছেন।মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব কারন সকল সৃষ্টির মাঝে একমাত্র মানুষই স্রষ্টার অপার সৌন্দর্য বহন করে সর্বাধিক।মহামান্য পালনকর্তা মানুষকে এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন এমন দুটো গুণের অধিকার মানুষকে দিয়েছেন যা দ্বারা মানুষকে অন্যান্য সৃষ্টি হতে পৃথক করেছে। মানুষকে মহান সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন স্বাধীন বুদ্ধিমত্তা এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি যার ফলে মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব।এই দুই কারনেই মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে মহাকালের প্রয়োজনে।
মানুষের জীবনে উত্থান - পতন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।যা যেমনটা নির্ভর করে স্রষ্টার উপর তেমনটা নির্ভর করে মানুষের নৈমিত্তিক কৃতকর্মের উপর।মানুষের কৃতকর্ম নির্ভর করে কিংবা মানুষের জীবন এমন একটি নিদর্শন যা নিয়ন্ত্রণ মানুষ করতে পারে তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা দ্বারা।মানুষের কাছে জীবন এমন একটি নিদর্শন যা থেকে মানুষ কখনোই পালিয়ে বেড়াতে পারেনি।মানুষ জীবন থেকে কখনোই পালিয়ে বেড়াতে পারেনি।কারন মানুষ হউক সন্নাসী কিংবা সংসারী কেউ পালাতে পারেনি এই জীবন থেকে।
প্রতিবারই মানুষ পরাজিত হয়েছে জীবনের কাছে।এখন সেই জীবনকে যদি মানুষের পূর্নতা দিতে হয় তবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে বই পড়ার উপর, জ্ঞানের পরিধি বর্ধনের উপর,দর্শন কিংবা সাহিত্য চর্চার উপর।কারন স্রষ্টা মানুষকে এমন ভাবে গড়ে তুলেছেন চাইলেই মানুষ তার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করতে পারে,সুন্দর করতে পারে নিজেকে কিংবা আলোকিত করতে পারে সমাজকে, দেশকে।এনে দিতে পারে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি যার জন্য বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
মানুষ যদি তার দায়বদ্ধতা পুরন করতে চায় তাহলে দেবদূতের মতোন তাকে সহায়তা করে তার জ্ঞান যা তার স্বাধীন বুদ্ধিমত্তাকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।এই সাহায্যের নিমিত্তেই মানুষ তার সামাজিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আন্ঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা পুরণ করতে পারে অতিসহজেই এবং অতি-সাহসিক মানসিকতায়।এই জ্ঞান মানুষ অর্জন করতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে। বই এমন একটি উপায় যা মানুষ চর্চা করলে সে অনুপ্রাণিত হয় এবং নিজ দায়িত্ব সে লুপে নেয় স্বমহিমায়।কারন সে বুঝতে পারে সূর্যের মতোন সমাজকে আলোকিত করতে বই পড়ার কোন বিকল্প নাই এবং এই বই মানুষের নৈতিকতার পরিধি এমনভাবে বর্ধন করে কিংবা এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় চাইলেই মানুষ তার সমাজে বৃহৎ পরিসরে পরিবর্তন আনতে পারে।এই পরিবর্তন শুধু সমাজে সীমাবদ্ধ থাকেনা বরন্ঞ্চ এই পরিবর্তনে পাল্টে সমাজের প্রত্যেকের মননশীলতা এবং সৃষ্টি হয় নবজাগরণের, ফলে মানুষ তার ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে স্বমহিমায়।পরিবর্তন হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার কিংবা শাসনতন্ত্রের। মানুষের বই পড়ার মাধ্যমে চর্চিত হয় সাহিত্য,দর্শন,বিজ্ঞান, অর্থনীতি এবংরাজনীতির।
ফলস্বরূপ মানুষ তার জীবনকে,তার সমাজ নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।মানুষের এই চর্চার দ্বারা সৃষ্টি হয় গনজাগরণ,জনবিপ্লব, মুক্তির সংগ্রাম কিংবা মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের মুল বীজমন্ত্রকে অঙ্কুরিত করে বই'ই।বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, "ব্যালট শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন করে কিন্তু সাহিত্য পরিবর্তন করতে পারে পুরো সমাজকে, দেশকে এবং বিষ্ফোরন ঘটায় এক বিপ্লবের"। অর্থাৎ বই পড়ে মানুষ চাইলেই গণবিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে যা মানুষের ভাগ্যর পরিবর্তন ঘটায়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি দিয়ে আলোকিত সমাজ এবং দেশগঠনে দেবদূতের ভুমিকা পালন করতে পারে।
উদাহরন স্বরুপ আরও বলা যেতে পারে ফরাসী বিপ্লব এবং রুশবিপ্লবের কথা।ফরাসীরা এবং রুশরা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক মুক্তিলাভের জন্য যথাক্রমে ফরাসীরা বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটিয়েছিলো ১৭৮৯ সালের ১৪ ই জুলাই এবং ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো তাদের প্রবল ক্ষমতাধর সম্রাট ষোড়শ লুইকে।এই ঐতিহাসিক বিপ্লব হয়েছিলো শুধুমাত্র কয়েকজন সাহিত্যিক, দার্শনিক কতৃক যারা তাদের অমর কীর্তি কিছু বই দ্বারা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো এবং সচেতন করেছিলো নিজ অধিকার নিয়েই। প্রথমত ফরাসী বিপ্লবের স্লোগান, " স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব " যে স্লোগানের নিমিত্তেই ফরাসীরা গর্জে উঠেছিলো আধুনিক সাম্যে আলোকিত ফ্রান্স গঠনে।যে স্লোগানের প্রবর্তক ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক এবং সাহিত্যিক জ্যা জ্যাক রুশো। যিনি তার অমর গ্রন্থ "The Social Contract" এর মাধ্যমে ফরাসীদের মাঝে মুক্তির বীজ বপন করে দিয়েছিলেন।বিখ্যাত দার্শনিক, নাট্যকার,ইতিহাসবেত্তা যাকে ফরাসী বিপ্লবের প্রান পুরুষ বলা হয় ভলটেয়ার যিনি তার অনন্য কীর্তি " Annals of the Empire " গ্রন্থের মাধ্যমে ফরাসীদের এই স্বাধিকারের চেতনাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।
আরও উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিখ্যাত দার্শনিক এবং ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবং ক্ষমতা স্ব তন্ত্রী করণ নীতির প্রবক্তা মন্টেস্কুর কথা যিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ "The Spirit of the Laws" এর মাধ্যমে ফরাসী বিপ্লবের প্রেরণা যুগিয়েছিলেন আপন স্বকীয়তায়। রুশ বিপ্লবও পূর্ণতা পেয়েছিলো এই বই পড়াকেই কেন্দ্র করে।
রাশিয়ার সর্বশেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের নেতৃত্বে আসা ভ্লাদিমির ইলিয়াচ লেনিন যিনি তার দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্ক্স এর "Das Capital" গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে।রুশ বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন সর্বকালের অন্যতম দুজন ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কি এবং লিও তলস্তয়। যারা তাদের বিখ্যাত দুই উপন্যাস যথাক্রমে মা এবং ওয়ার এন্ড পিসের মাধ্যমে রুশদের আধুনিক সাম্যে আলোকিত দেশ গঠনে সহায়তা করেছিলেন। মানুষের নৈতিক শিক্ষাকে বৃদ্ধি করে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলোও।
যে ব্যক্তি পবিত্র ধর্মের সকল বাণী অনুসরণ করতে পারে তারাই নৈতিকতা অর্জন করে এবং সমাজকে গড়ে তুলে স্বর্গের অপার সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। যেমন পবিত্র কোরআন,বাইবেল,ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট, গীতা, ত্রিপিটক ইত্যাদী বই পড়ে মানুষ স্বমহিমায় মহিমান্বিত হয়ে সমাজকে রাঙাতে পারে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভুয়সী প্রশংসায় ভাসাতে পারে নিজেকে মহাকালের অতল গহ্বরে। এবং রচনা করতে পারে অমর এক মহাকাব্য।
পরিশেষে বলা যায় মানুষ তার স্বীয় মহিমায় মহিমান্বিত এবং উদ্বেলিত। মানুষই পারে তার জীবনকে সুন্দর করতে,সমাজ কে সুন্দর করতে পারে এবং আলোকিত করতে।
মানুষ তার দায়িত্ব পালন করে প্রতিষ্ঠা করতে পারে তার অমুল্য এক দর্শনের।
যার ফলে মানুষ উপহার দিতে পারে এক আলোকিত সমাজ যেখানে মানুষ মুক্তি দিতে পারে সামাজিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য হতে।
এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারে একটি সুন্দর সমাজ, একটি সুন্দর দেশ এবং পৃথিবীর বুকে এনে দিতে একখন্ড স্বর্গীয় আনন্দ।যার জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই।
কারণ সাহিত্য চর্চা,দর্শন চর্চা,বিজ্ঞান চর্চা এবং সাংস্কৃতিক চর্চা করতে বই পড়ার কোন বিকল্প নাই।