কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য হুমকি ।। ইসরাত জাহান হীরা


''মাগো তোমার ছেলে ফিরবে না জেনেও
অপেক্ষা করে চলেছো,
কুপির কেরোসিন ফুরিয়ে আসা অবধি।
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসলো মোয়াজ্জিনের আজান,
ঠিক তখনি তোমার ছেলের নিথর দেহ নিয়ে
আসা হয়েছিলো.....''
এভাবে প্রতিনিয়তই হাজারো মায়ের বুক খালি হয়ে যাচ্ছে।এই হাজারো মায়ের হাহাকার নিয়ে আজ আমি লিখা শুরু করছি।মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলেকে বুয়েট থেকে পড়াবে। ইঞ্জিনিয়ার হবে তার ছেলে।সুনাম ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না মায়ের।কিশোর গ্যাং নামক এক ভয়াবহ আতঙ্ক নিমিষেই মায়ের স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে। তেমনি এক ভয়ংকর ঘটনা আমরা দেখতে পাই ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ।সেদিন বুয়েটের ছাত্র আবরারকে হত্যা করেছিল।পরিবারের সদস্যসহ অনেকেরই শুধু একটাই কথা,,এই শান্ত স্বভাবের ছেলেটাকে কেন হত্যা করা হয়েছিলো? কেন তার মায়ের বুক খালি করেছিলো? তার পেছনে একমাত্র কারণ ছিলো কিশোর গ্যাং।
২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারির উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের উপর আদনান কবিরকে কুপিয়ে হত্যা করে।১৫ বছর বয়সের এই কিশোর বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলতে গিয়েছিল। মা ভেবেছেন আজানের আগেই ছেলে ফিরে আসবে।হ্যাঁ, আদনান ফিরে এসেছিল ঠিকই,কিন্তু তার নিথর দেহ নিয়ে।গ্যাংস্টার বয়েজ গ্রুপের অন্তর্দ্বন্ধের স্বীকার হতে হয়েছিল আদনানকে। এমন আরও শত শত আদনান এর কিশোর প্রাণ ঝরে পড়ছে অকালে।খালি হচ্ছে শত মায়ের বুক।
''স্বপ্ন ছিলো তারও,
ওয়ান টু নয়, ওপর ক্লাসে পড়বে সে আরও
পরীক্ষাতে প্রথম হবে,রোল হবে তার এক।''
কিন্তু কিশোর গ্যাং নামক ভয়াবহ কার্যক্রমে যোগ দিয়ে ভুলে গিয়েছে সে তার স্বপ্নটাকে। যোগ দিয়েছে রাজনীতিতে। স্থানীয় নেতাদের সাথে মোড়ে মোড়ে তাদের ব্যানার পোস্টার শোভা পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনার কারণে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম বেড়েছে।অনলাইনে পেইজ খুলেও সংঘটিত হচ্ছে তারা।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এমন অধপতনের জন্য সামাজিক অবক্ষয় ও সুশাসন না থাকাকে দায়ী করলেন বিশেষজ্ঞরা।
''বয়স কতই হবে?
১১ পেরুলো সবে..
ইশকুলে সে গিয়েছিল ক'দিন?
সব মিলিয়ে সাত আট কিংবা ন'দিন... ''
কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের বয়স প্রায় ১২-১৭ হয়ে থাকে।কিশোর অপরাধ আগেও ছিলো এখনও আছে।তবে দিন দিন যত বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র,নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্নরুপে দিচ্ছে।খুন, ধর্ষণ,ধর্ষণের পর হত্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে।পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার লক্ষ্যে এখনই এর লাগাম টেনে ধরা দরকার।
২০১২ সালে কিশোর অপরাধে সারা দেশে মামলা রেকর্ড করেছে ৪৮৪ টি, আসামী সংখ্যা ৭৫১ জন।২০১৩ সালে রেকর্ড করেছে ৫৮৯ টি মামলা, আসামী সংখ্যা ৮৪৮ জন। ২০১৪ সালের মামলা ৮১৮ টি,২০১৫ সালে ১১৮৪ টি, ২০১৬ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৯৬টি
''ছেলেকে রেখেছি অনেক আদর যত্নে
ছুতে দেই নি কোনো মাছি, মৌমাছি, প্রজাপতি
নাড়ার আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছি মাঠের ছোলা এখন আমি বৃদ্ধ হয়েছি, ছেলে আমার মস্ত দূরে...''
ভয়ংকর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। মাঝে মাঝে দেখা যায় তুচ্ছ কারণ নিয়েও মারামারি হচ্ছে।কাউকে যথাযথ সম্মান না দেখালে,এমনকি বাঁকা চোখে তাকানোর কারনেও মারামারির ঘটনা ঘটে। এবং একটা সমাই এই কিশোর গ্যাংগুলোতে ধীরে ধীরে অস্ত্র বহন করতে শুরু করে।তাছাড়াও দেখা যায় তারা মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে।এই গ্রুপগুলোকে কাজে লাগিয়ে টাকা আদায়ের ধান্দা শুরু করে তারা।ছিনতাই করতেও দ্বিধা করে না।ফলে আমাদের সমাজে নেমে আসে চরম বিপর্যয়।
কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম্য রোধ করতে হবে।এদের দমন কিংবা সমাধানে চাই সম্মিলিত একটি প্রচেষ্টা। পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের শিশু-কিশোরদের নিয়মিত নজরদারির পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করতে হবে।ছাত্র সংগঠন বা নেতৃত্বের বিষয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকের শিশু কিশোররা আগামী দিনে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
'' আমার ঐ একটাই বাপ,কলিজার টুকরা
ওরে আর কোনোদিন দেখতে পামু না আমি।
অনেক কষ্টে বড় করছিলাম, মানুষের মতো মানুষ করতে চাইছিলাম। আমার ওই সোনামনিটাকে তারা কুপাইয়া মারতে পারলো?এমন বুকফাটা আহাজারিতে পুলিশ কার্যালয়ে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছিলেন মেধাবী কিশোর শুভ আহমেদ এর মা।''
আমরা চাই না, আমাদের এই সোনার বাংলায় আর কিশোর গ্যাং এর সৃষ্টি হোক।কোনো মায়ের বুক খালি হোক,কোনো বাবার কাঁধে উঠুক তার সন্তানের লাশ।কোনোকিছুরই স্বপ্ন যেনো অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।