অর্থহীন ।। শ্রাবন্তী দেব স্মৃতি


ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন রাত এক করলেও ঘুম আর যায় না চোখের কোনা থেকে।   দিন রাত মায়ের বকাবকি খেয়েও বেহায়া আমি আরেক বেহায়া ঘুমকে নিয়ে নিমগ্ন থাকি নিজেদের কাজে।  তবে আজকের দিনটা অন্য রকম।  প্রতিবছর এই দিনে আমার সাথে  একটা বিশেষ মানুষের দেখা হয়।  সে হলো আমার বাবা।  বাবা- মা আজ ৭ বছর ধরে আলাদা হয়ে গেছেন।   তীব্র ভালোবাসাও মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়।   যার বাস্তবতা আমি প্রতি মূহুর্তে উপলব্ধি করি।  বাবা- মা দুজন দুজনকে  প্রয়োজনের চেয়েও ভালোবাসে তাই তো তাদের ভালোবাসা তাদের জীবনে বিষের ন্যায় হয়ে গেছে।   মা-আমি  মিরপুর বেনারসির ২ তলার ছোট্ট একটা রুমে থাকি।  আজকের দিনে আমি আমার বাবা- মায়ের কাছে আসি। আমার জন্মদিনকে কেন্দ্র   করে বাবা আমাদের সাথে সময় কাটাতে চলে আসেন।  অন্য সব দিনেও বাবার এই বাড়িতে আসা নিষেধ না হলেও  অভিমান বাবাকে আসি - আসি বলেও আসতে বাঁধা দেয়।  তাই আজকের দিনে মাকে  আর কুহু মা,খুকি ওঠ বলে চিল্লাতে হয় না।  আমি আপন মনেই উঠে যাই।  মা তার কষ্ট, অভিমান, ক্ষণিকের দেখা পাওয়ার  উদিগ্নতাকে শত কষ্টে লুকিয়ে রাখতে  নিজেকে ব্যস্ত রাখে আমাদের জন্য নানান পদের রান্নার    কাজে।  তারপরে তার মনের অজান্তের চোখের জল প্রায়ই তার অনুমতি ব্যতিতই গড়িয়ে পড়ে আমার সামনে।  যদিও তা চোখে কিছু পড়েছে, পেঁয়াজ কেটেছি বলে পাশ কাটিয়ে দিতে দিতে মা অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন।  মাকে আজ বড় উল্লাসিত লাগে; চোখে মুখে এক অদ্ভুত   মায়া,এক জনের অপেক্ষা  ফুটে উঠে।  
নিজের অর্থহীন জীবনটা তখন আর অর্থহীন লাগে না।  অদ্ভুত শান্তি নেমে আসে চারিধারে। আয়নায় কাজল দিতেই হঠাৎ মা'র এক নজরে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি নজরে এলো।  মা বলে উঠলেন,কুহু মা বড় হয়ে গেলি যে। তোকে আমি এক ডাক্তারের কাছে বিয়ে দিব।  তোর বাবাকে বলবো তোর জন্য ছেলে দেখতে... বাবা কেন মা ?আমার জন্য  ছেলে তুমি দেখবে।  আমার সংসার জীবনের মধ্যেই  পরোক্ষভাবে তুমি আমার জন্য হওয়া সংসার জীবনের অপূর্ণতা মিটাবে মা। তুমি তোমার পছন্দ মতো ছেলে আনবে।  আমার কোনো সমস্যা নেই..
মা কিছুটা ভ্রু কুঁচকে  তাকালেন। মায়ের চোখ যেনো বলতে লাগলেন কোনো অপূর্ণতা! তোর বাবা আমার কোনো অপূর্ণতা রাখেনিরে মা।   প্রয়োজনের চেয়ে তীব্র ভালোবাসাই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।  তোর জন্য কিছু হয়নিরে মা।   তোকে তীব্র ভালেবাসার সে ভুল আমি করতে দিবো না রে খুকি। 
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।  মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলতে গেলেন।  কপালের টিপ দেওয়া শেষ হতেই  বাবা সামনে এসে দাঁড়ালেন।  সাথে এক খাঁচা।  খাঁচায় এক পাখি।  নে মা, আমার কুহু পাখির জন্য  আরেক পাখি এনেছি, একে তোর কাছে রেখে দে।  আমি  কয়েকদিন পুষেছি।  পোষ মানছে  নারে আমার কাছে। তোর ফুফু দিয়েছে। কোনো বাচ্চা- কাচ্চা দেয় না বলে,তাই দিয়ে দিয়েছে। তুই তোর কাছে রেখে দে।  
ওর নাম কী বাবা? কোনো নাম নেই তো মা,  এটাতো ঘুঘু পাখি।  তুই দিয়ে দে একটা নাম।  খাঁচার দরজা খুলতে  হঠাৎ সবাইকে চমকে আমার হাতে নির্ধিদ্বায় চলে আসে পাখিটি;যেনো কত ভরসার হাত খুঁজে পেয়েছে  কয়েক জনম পর।   দিন পার হলো, সময় পার হলো।  যথারীতি সবকিছুই  আগের মতোই চলতে থাকলো।  বিয়ের পাত্র খোঁজাকে কেন্দ্র করে বাবা- মা'র  কাছাকাছি আসা দেখে নিজেকে আবারও অর্থহীন  থেকে অর্থবহ হতে লাগলো।  আমার জগতে যোগ হলো বাবার দেওয়া ঘুঘু যার নাম অর্থহীন,  আমার মতোই সে।   আমার জন্মদাত্রী মাতা-পিতা জন্মদিয়েই কোথায় পালিয়ে গেলেন! আমার এই মা আমাকে দত্তক নিয়ে এই নতুন পরিবার দিলেও হারিয়ে ফেললেন নিজের সংসার। আমার মতো পাখিটাও  বাচ্চা- কাচ্চা না দিতে পারায় কারও জীবনের জন্য লাভবান বা সুখকর হতে পারছে না। আমাদের দুজনের জীবনটাই অর্থহীনের তালিকাই রয়ে গিয়েছে। তাই হয়তে এত মিল আমাদের।  এই নির্বাক প্রাণীটি ভালেবাসা আমায় মুগ্ধ করে। এত ভালোবাসা আমায় স্বস্তির সাথে অস্বতিও এনে দেয়।  ভালোবাসা হয়তো একেই বলে। স্বস্তি  -অস্বস্তি  মিলেই হয়তো ভালোবাসা।  ভালোবাসার মোহও যে বিশাল,  তাই হয়তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও  মানুষগুলো  ভালেবাসার মোহের  বেড়ায় আটকে পড়ে।  ভালোবাসার বাধাও বেশ শক্তিশালী।  এই যেমন মা - বাবা  হাজার দূরে থেকেও একে অন্যের কাছে বাঁধা।  
তাদের এত সুন্দর সম্পর্কে নিজেকে কাটা হিসেবে দেখতে বড্ড অপরাধী লাগে।  হাজার দূরে যেতে চাইলেও কোনো এক অজানা শক্তি আটকে দিয়েছে।  হয়তো মায়ের ভালেবাসার শক্তি,   ভালোবাসার সংজ্ঞায়ন কী তবে!  
এমন সময় মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন,  মা কাঁদছেন। কাল তোর বিয়ে কুহু, তুই চলে যাবি আমায় একা করে।  আমি কী নিয়ে থাকবোরে!  মা তুমি বাবার কাছে চলে যাবে, তোমার সাজানো সংসারের কাছে ফিরে যাবে। 
তা কী হয় রে মা! একবার যে জিনিস হারিয়ে যায় তা যে ফিরে আসে নারে মা।  চল বাইরে চল, তোর বিয়ের আয়োজন হচ্ছে।  বাবার সাথে দেখা করবি, চল।  অর্থহীন আমার কাঁধে চলে এলো ওকে নিয়ে বাইরে এলাম৷ 
চারপাশটা পূর্ণিমায় আলোয় ঝলমল করছে।  বাবা মা অতি আনন্দে সব দিক সামলাচ্ছেন।  তাদের একসাথে দেখে আমার অপরাধবোধ থেকে খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছি, খুশিতে কান্না পাচ্ছে । এলাহিকান্ড চারপাশে।  আগুন জলছে আমার সামনে।  রান্নার আয়োজন চলছে। অর্থহীন খাবার খাচ্ছে।      এমন সময়  বাবুচির হাত থেকে অসাবধানতায় আমার গায়ে কেরোসিন পড়ে যায়। বাবা- মা ভয় পেয়ে  বকাবকি শুরু করেন।  আশপাশটা ডেকোরেটিং এর লাইটিং এ ভরে উঠেছে।  অর্থহীন খাবারের সন্ধানে আগুনের খুব কাছে চলে গিয়েছিলো।   অজান্তেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম।  এ কী! অর্থহীন আগুনে পড়ে  যাচ্ছে।  ঝাপটে গিয়ে  আগুনের উপড় পড়লাম।  দাউ দাউ  আগুন।  মা'র তীব্র চিৎকার কানে যেতেই জ্ঞান হারালাম। 
চোখ খুলতেই দেখি এক হাসপাতালে অক্সিজেনের নল পড়ে শুয়ে আছি, 
সামনে মা - বাবা।   আর মা'র হারানো পুরো সংসার মাকে সাহস দিচ্ছে।  ডাক্তার  তার সর্বশেষ চেষ্টা শেষ করে পরিবারকে মৃত্যুশোকের খবর মেনে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে বলছেন। 
চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে, ঝাপসা ঝাপসা করে আমার জন্য হারিয়ে যাওয়া মায়ের পুরো সংসার দেখছি সামনে।  অপরাধবোধ হতে মুক্তি পেতে যাচ্ছি। তীব্র ভালোবাসা বাবা- মা কে বিচ্ছেদ করে দিলে। 
আর অর্থহীনের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আমাকে স্বস্তির মৃত্যুস্বাদ এনে দিলো।  এনে দিলো অপরাধবোধ থেকে মুক্তি।  আর শেষ সময়ে জীবনকে অর্থবহ ভাবার আনন্দ।  ভালোবাসার সংজ্ঞায়ন আর জানা হলো না।  জীবনের ইতি টানতে যাচ্ছি।  বিদায়ের অপেক্ষার চোখ অর্থহীন কে খুঁজছে।  আমার ছোট্ট অর্থহীন জীবন নাটিকা  আজ অর্থবহ হতে চলেছে। অপরাধবোধ হতে মুক্তি পেতে যাচ্ছে।  অর্থহীন তুই আসলেই ভালোবাসার  মূল্য দিলিরে,  আমাকে স্বস্তির মৃত্যু স্বাদ দিলি।  অর্থহীন শেষ বিদায় জানাতে দেখা দিবি না? সময় তো আর বেশি নেই,  অর্থহীন তুই কোথায়? 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।