বর্তমানে 'কিশোর গ্যাং' শব্দটা বহুল আলোচিত সমালোচিত। কিশোর অপরাধ আজ কালকের ঘটনা নয় এটি আগেও ছিল। তবে বর্তমান সময়ে এটি অন্য রকম রূপ ধারণ করছে। যত দিন যাচ্ছে তত বেশি তারা অপরাধের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। তাদের অপরাধ গুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে। প্রথমদিকে ছোট ছোট অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তারা পরবর্তীতে এই ছোট ছোট অপরাধ থেকেই জড়িয়ে পড়ে বড় অপরাধে। প্রথমদিকে তারা জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই, পকেটমার এসবের সাথে।পরবর্তীতে খুন, ধর্ষণ, হত্যা এসব হিংস্র অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
জন্মের পর থেকে যখন একটা মানুষ ধীরে ধীরে বড় হয় তখন সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একটা ছেলে বা মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন তখন লক্ষ্য করা যায় যখন সে কিশোর-কিশোরীতে রূপান্তরিত হয়। তাইতো ছুটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ এ বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে সবকিছুর রঙিন মনে হয় এবং তাদের মধ্যে যে ধরনের পরিবর্তন আসা শুরু করে সেটা তাদেরকে অনেকটা উন্মাদে পরিণত করে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, কিশোর গ্যাংয়ে যারা যুক্ত হয় তাদের অনেকেরই বয়স থাকে ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।এই কিশোর গ্যাং গুলোর নির্দিষ্ট করে নাম এবং লোগো থাকে। তারা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এবং সর্বদা আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। আর এই আধিপত্য ধরে রাখতে গিয়ে জন্ম দেয় ন্যাক্কারজনক ঘটনার।
সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। আর এই হতাশা সেসব সন্তানকে অপরাধের দিকে টেনে নিয়ে যায়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক/নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আবার অনেক সময় বেকারত্ব ছেলেমেয়েদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। তবে বর্তমানের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে সেটা হচ্ছে কর্মজীবী মা বাবার সন্তানদের কিশোর গ্যাংয়ের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। এমন অনেক মা-বাবা রয়েছে যারা কর্মক্ষেত্রে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সন্তান কার সাথে উঠাবসা করছে সেদিকে নজর দেওয়ার সময় যেন তাদের নেই। কথায় তো বলে, 'সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ'। মা বাবার হেয়ালিপনা তাদের সন্তানদের জীবনে ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে।
১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী গ্যাং কালচারে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেয়। আর তখন থেকেই এই কিশোর গ্যাং দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই গ্যাংয়ের সদস্য গুলো বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। তাই তথ্য প্রযুক্তি মনিটরিং ও ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রমণাত্মক গেইমস গুলো অফ করতে হবে। আবার অনেক সময় এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সেল্টার প্রদান করে সমাজের নামধারী কিছু বড় ভাই যারা আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে ভালো সম্পর্কে যুক্ত থাকে এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কর্মক্ষেত্রে জড়িত মা-বাবা গুলো তাদের কর্ম জীবনের পাশাপাশি সন্তানের দিকে নজর দিতে হবে। সন্তান কার সাথে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কি করছে সর্বদিকে তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক সময় পর্যাপ্ত বিনোদন ক্ষেত্রের অভাবে ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের অপরাধমূলক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিশোর গ্যাং রুখতে হলে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা। তার পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়ার আগেই কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে। আর এজন্য প্রশাসনের নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।