অরবিন্দ স্বর্গবাসী হওয়ার পর গোলাপী কোনেক শান্তিরও নাগাল পাইল না...!
স্বপ্নাদেশ পায়া বাড়িত বিশহরি ঠাকুরের পূজার আয়োজন। সাথে একশো তেত্রিশ কোটি দ্যাবতারও পূজা। কিন্তু, সেই দিনেই যে দুু্র্ঘটনা ঘটিবে, সেইটা আর কায় জানে! গোলাপীর সিতার সেন্দুর মুছি গেইল স্বোয়ামী অরবিন্দ কালনাগিনীর ঠোকান খায়া! খবর শুনি তো প্রায় পাগিলি’ই উয়ায়!... পূজা বন্ধ করি, মা বিশহরিক ‘কানি বিশহরি’ বুলি সম্বোধন করি, ইচিত-বিচিত কত ধরনের গালিগালাজ করিল। হয়তো এই কারণে মা বিশহরিও রাগ উঠি অভিশাপ দিসে উয়াক!
ছাওয়াক কোলাত নিয়া গোলাপী বারান্দাত চুপচাপ বসি আছে। এমন সমায় পঞ্চাইত যতীন তার দলবল সহ আইসে ভোট প্রচারের বাদে। দলের ঝান্ডা নাগায় গোলাপীর ভাঙি পড়া ঘরের চাটিত। গোলাপী বাধা দ্যায়।
“বৌদি, যা হইসে-- হইসে। এলা তো ঐলা ভাবি লাভ নাই।”
“লাভ নাই মানে! মোর জীবনটা তুই নষ্ট করি দিলু! কাক ভোট দিম না-দিম সেইটা মোর ব্যক্তিগত ব্যপার। ঝান্ডা নাগাবেন না এটে। ব্যাস...”
“ভুল তো মানষিরে হয় বৌদি। তাই বুলি...”
“ভুল! তোর একটা ভুলের তানে আজি মুই কলঙ্কিনী, চরিত্রহীনা, বেইশ্যার মিছাং অপবাদটা নিয়া ঘুরি বেড়াছোং! চলি যাও এটে থাকি।”... গোলাপী চোখুর জল মুছে।
“বৌদি, প্লিজ ভোটটা যুনি অপাতে না যায়।”
যতীনোক দেখিলে গোলাপীর অঙ্গ জ্বলে। রাগ উঠি চিল্লায়, “তুই যাবু না নাই এটে থাকি!”
মান-সন্মানের পাখে লক্ষ্য রাখি যতীন ফিরিবার ঘাটা ধরে। ভোট আসিলে জোট নাগে ইমাক। ভোট ফুরাইলে তুই কায় মুই কায়! গোলাপী ভাল করি জানে।
ভোটত জিতি এবারেও পঞ্চাইত হইল যতীন। গোলাপী পার্টিটাক পছন্দ করিলেও ভোট দ্যায় নাই যতীনোক। উয়ার মতন একজন চরিত্রহীন লোকোক কেনে যে মানষিগিলা ভোট দিয়া জিতায়-- ভগবানে জানে! পুরানা কথা মাথাত রাখি গোলাপী একেলায় ধিক্কার জানায়, প্রতিবাদ করে! আজি যেই মিছাং অপবাদটার দায়ে দোষি হয়া আছে উয়ায়-- তা তো একমাত্র যতীনের বাদেই।
যতীন প্রথমবার পঞ্চাইত হইল গোলাপীর স্বোয়ামী অরবিন্দ স্বর্গবাসী হওয়ার পর। অরবিন্দ সেলা পঞ্চাইত ছিল, আর উয়ার ডাইন হাত ছিল যতীন। অরবিন্দ স্বর্গবাসী হওয়াতে পঞ্চাইতের আসনখান পাইল যতীন! যুদিও জনগণের সাপোর্ট ছিল না। ক্যাংকরি যে চাল খাটে তাও পঞ্চাইত হইল, উয়ায়ে জানে!
গোলাপীর ভরা যৌবন ভোগ করির খুব সখ যতীনের। কিন্তু গোলাপী তাতে কুনোদিন সায় দ্যায় নাই। যতীনের এই অস্বাভাবিক আচরণের জৈন্যেই গোলাপী একদিন ছোবা খড়ি দিয়া পিট্টান জুড়িসে উয়াক।... ফল স্বরূপ যে কাজটা করিল যতীন, তা ব্যখ্যা করার মতন না হয়। ফাকোতে একদিন কুন একজন পর-পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কের হাল্লা ওঠাইল গোলাপীর নামে! নিষ্পাপ গোলাপীক চরিত্রহীনা, পতিতা নারী হিসাবে স্বীকৃতি দিল! মুহুর্ত্বেই খবরটা ছড়াইল গ্রাম থাকি গ্রামান্তর! ছছা-মিছা যাচাই না করি সমাজও নির্দ্বিধায় তা মানি নিল! জুতার মালা গালাত দিয়া, মাথা নাড়িয়া করে গোটায় গ্রাম ঘুরাইল গোলাপীক! বিনা দোষে দোষি হয়া এমন কঠিন শাস্তি! ইয়ার থাকি বেশী অপমানজনক ঘটনা আর কি হবার পায়! গোলাপী এই কঠিন পরিস্থিতির মুখোত পড়িসে রক্ষক রূপী ভক্ষক একমাত্র যতীনের বাদে!... মাস কয়েক বাড়ি থাকি বিরির পায় নাই লইজ্জায়!
সেইবার দুর্গাপূজার ভাসানির দিনে মা দুর্গাক সেন্দুর পর্যন্ত নাগের দ্যায় নাই কাহ গোলাপীক। একজন পতিতা নারীর নাকি মা’র কপালোত সেন্দুর নাগের কুনো অধিকার নাই-- জানে দিসে পূজা কমিটি! কিন্তু, উয়ায় যে পতিতা না হয়-- সমাজ কি আর সহজে তা মানে! চোখুর জল ফ্যালে গোলাপী সেদিন মা দুর্গাক কইসে, “হে মা, তুই তো সবে দেখিস, সবে বুঝিস-- তাও কেনে তোর এমন অবিচার! কুন পাখ থাকি মুই অ-সতী? সংসারের রীতি অনুযায়ী এই শরীল একমাত্র স্বোয়ামী ছাড়া তো আর কুনো পর-পুরুষ স্পর্শ করে নাই, তাও কেনে মুই চরিত্রহীনা?”... মা দুর্গাও হয়তো গোলাপীর এই প্রশ্নের উত্তর দিবার পায় নাই!
বছর কয়েক বিতি গেইলে গোলাপী আরও সমাজোত ঠাঁই পায়। সাধারণ আর কয়েকজন মহিলারে মতন মাথা উঁচা করি বাঁচিবার স্বপ্ন দ্যাখে উয়াও।
হুল্টি নাগা সমস্যা আর কুনোদিন পাছ ছাড়িল না উয়ার! পাকা ঘর, নলকূপ আর রাস্তা দেওয়ার নাম করি যতীন আরও গোলাপীক কুপ্রস্তাব দ্যায়। একবার ভুল না করিয়াও সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করির নাগিসে উয়াক। আর না। কাজে-- গোলাপী লইজ্জায়, ঘিন্নায়, রাগে সেই প্রস্তাব অস্বীকার করি, সাথে সাথে জুতা খুলি চড় মারে যতীনোক। যতীন সাথে সাথে পাল্টা প্রতিবাদ করির পায় নাই। কিছু কবারও সাহস পায় নাই। গোলাপীও যে দুই-একটা মানষি ড্যাকে অভিযোগ করিবে, তারও উপায় নাই! কাহ বিশ্বাস করিবে না উয়ার এই কথা-- বরঞ্চ মানষি আরও খারাপ ভাবিবে উয়াক।... রক্ষক রূপী ভক্ষকলায় যুদি সমাজ রক্ষার দায়িত্ব ন্যায়-- তাহলে তো সমাজের পতন অবসম্ভাবি!
কয়েকদিন পরেই ছাতুয়া গণেশের বাড়িত একাদশী। ভাজতি বৌ-- সুত্রে গোলাপীকও নিমন্তন করিসে গণেশ। কিন্তু সেদিন উয়ার বেটা হরিমাধবের মাথাত বিষ আর জ্বর! গোলাপী যাবার পায় নাই অসুস্থ্য বেটাক ছাড়ি। এই সুযোগটাকে কাজত নাগাইসে যতীন। সারা আতি কুন একটা লোকোক গোলাপীর ঘরের কোনাত খারা করি থুইসে। পরের দিন ভোর ভোর সমায়ে প্লান মাফিক হাল্লা ওঠাইল গোলাপীর নামে!... শুনিয়ায় গোলাপীর মাথা খারাপ! একবার যেই মানষিটা বিনা অপরাধে অপরাধী হইসে, সেই মানষিটায় যুদি বিনা অপরাধে আরও অপরাধী সাজে-- তার মানসিক অবস্থাটা কি ঠিক থাকির পারে! আচ্ছা, এই সমাজোত কি একজন স্বোয়ামীহীনা সতী নারী শান্তিতে থাকির পারে না?
অভিযুক্ত ব্যক্তিক নাকি ধরি থুইসে গ্রামবাসী। প্রধান, পঞ্চাইত(যতীন) আসিল। বিচার সভা বসিল। গোলাপী অপমানিত হবার ভয়ে ঘরের কোনাত চুপচাপ বসি আছে। কারণ, মানষি জানে-- রটিসে মানে ঘটনা অবশ্যই ঘটিসে! গোলাপীক ডেকাডেকি করা হইলে ঘর থাকি বিরির সাহস পায় না উয়ায়। ফটাফট একখান চিঠি লেখি জ্বরুয়া বেটা হরিমাধবের হাত দিয়া প্রধান সাহেবোক প্যাটে দ্যায়। বেটা ফিরিবার আগতে এক ঢোকে বিষের শিশিটা আজারি করি বিছিনাত থাকি পড়িল গোলাপী।
প্রধান সাহেব চিঠিখান হাতোত নিয়া জোর গালায় পড়া শুরু করিল, যাতে সগায় শুনা পায়। চিঠিত লেখা ছিলো--
মানী ডাঙোরীয়া,
এই মিছাং অভিযোগের সাথে মোর কুনো সম্পর্ক নাই। ইয়ার আগতও বিনা অপরাধে মোক একবার অপরাধী সাজাইসে এই সমাজ। তার জইন্যে দায়ী অবশ্যই গ্রামের বর্তমান পঞ্চাইত যতীন সিংহ। আর আজি মুই যে কারণে অপরাধী তার আগা-মাথাও মোর কিছু জানা নাই। যেহেতু হাল্লা উঠি’ই গেইসে, মানষির মুখ তো আর বন্ধ করা যাবে না! অপরাধ না করিলেও মুই দোষি সাব্যস্ত হইম-- জানোং।
অতএব মহাশয়েরটে হাত জোড় করি একটায় অনুরোধ, মোর মরা দেহাটা যুনি পোষ্টমর্টাম করা হয়। তাতেই ধরা পড়িবে মুই দোষি না নির্দোষি।
নিবেদক,
গোলাপী রায়”
বিচার তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। অপরাধ স্বীকার করা ব্যক্তিক বান্দি থুইয়া গোলাপীর ঘর দৌড় মারিল অনেকেই। ততক্ষণে মাটিত পড়ি ধরফরাছে গোলাপীর নিষ্পাপ দেহাটা!... সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্স আনা হইল। হাসপাতালের পাখে মরণ ব্যাগে ছুটিল গাড়ি। আধঘাটাতে দেহা ছাড়ি দিল গোলাপীর পবিত্র আত্মা!
হাসপাতাল নিগি পোষ্টমর্টাম করা হইল। গোলাপীর অপরাধের চিহ্নমাত্র ধরা পড়িল না তাতে। বাড়ি আনি সন্মানের সাথে শশ্মান যাত্রার ব্যবস্থা করা হইল। উয়ার জ্বরুয়া বেটা হরিমাধব কান্দি-কাটি মুখাগ্নি দিল।
সেদিনে আরও বিচার বসিল। অপরাধ স্বীকার করা ব্যক্তিক গ্রামবাসী প্রধানের মুখের আগতে হাড্ডিফাটা মাইর মারিল। তারপর বাকিল সেই ব্যক্তি-- যতীনের কথা মতন এই কাজ করিসে উয়ায়! কাজটার বাদে নাকি যতীন উয়াক ঘুসও দিসে!
শুনা মাত্রই গণধোলাই শুরু হইল যতীনেরও উপর। প্রধান সাহেব কুনো রকমে পরিস্থিতির সামাল দিল। ...কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসি ধরি গেইল দুই অপরাধীকে।
গোলপী আসলেই সীতার মতন একজন সতী নারী।... কিন্তু মানষির মুখ তো আর বন্ধ করা যায় না! এতকিছুর পরেও কি উয়ার পবিত্র আত্মা সতীত্বের মর্যাদা ফিরি পাবে?
তারিখ: ১৬/০৯/২০২১