পল্লী সমাজে নববর্ষ ।। শর্মিলা সরকার



গ্রাম! লোকায়ত সংস্কৃতি ও জনজীবনের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। সাধারণ জনমন এবং গ্রামীণ প্রকৃতির অপূর্ব মেলবন্ধনে রঙিন হয় গ্রামবাংলার প্রতিটি ভোর। তবুও, সচরাচর জীবনযাত্রার ব্যাতিরেকে অন্যান্য দিনলিপির চাইতে খানিক পার্থক্য থাকে বিশেষ কোনো দিনের কিংবা মূহুর্তের। সেটা যদি হয় বাংলা নববর্ষ !

বাংলা ১৪২৯- সন। গ্রামের বন্ধুদের মুখে নববর্ষের নানা গল্প শুনে ঠিক করেই নিলাম নববর্ষ টা শহরের বাইরে কাটাবো। যেহেতু, গ্রামে নববর্ষের আগের দিনটা চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে পালিত হয়। এবং সে দিনকে ঘিরেও থাকে নানা লোকাচার। চৈত্র সংক্রান্তির আগেরদিনই আমি গ্রামে পৌঁছে গেলাম। আমি শুরু থেকেই দেখবো এ প্রত্যাশায়। পরেরদিন দেখলাম-হঠাৎ যেন প্রতিটি বাড়িতে উৎসব লেগে গেল মুহুর্তেই। অন্যরকম উৎসব।

ঘরে চিড়া,মুড়ি,নারকেল, মিষ্টি, দই আর সবচেয়ে বড় ঝোলাগুড়। দই-চিড়া খাওয়ার মাধ্যমে বাংলা গ্রামবাংলাও পুরনো জীর্ণতাকে পরিপাক কেরে দিবে। যেন নতুনভাবে সব শুরু করা যায়। চৈত্র সংক্রান্তির আরেকটি হলো সুক্তো নানা ধরনের বন্য সবজি এবং বিভিন্ন সবজি, ডালের বড়ির মিশ্রনে তৈরি হয় সুক্তো। গরম ভাত আর সুক্তো! আহা! বাঙালির তৃপ্তির ভোজন। দুপুর এ সুক্তো ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালি চৈত্রের দুপুরে একটু গড়িয়ে নেয়,অতঃপর - ঘুম!ক্রমশ,দুপুর গড়িয়ে বিকেল - অতঃপর সন্ধ্যা নামলো গ্রামের বুকে। পল্লীজীবন তখন লণ্ঠন জ্বালিয়ে নতুন ভোরের অপেক্ষায় নানা আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঘরের গৃহিণীরা রাতভর করছিল পহেলা বৈশাখের আয়োজন। ভাত রান্না করে রাখা। রাতের খাবার শেষে অতিরিক্ত ভাতে জল ঢেলে পরদিনের পাস্তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। আরও নানা কাজ। কিছু পরিবার হালখাতার আয়োজন করছিল। যার ফলে তাদেরও প্রস্তুতি চলছিল গণেশ পূজা সহ নানা পূজা পাঠের।

এভাবেই নানা আয়োজনে, আধো ঘুমে শেষ হয় ব্যস্ততার রাতটুকু।ভোরের আলো গ্রামের বুকে ছড়ালো আর পূর্বাকাশপতি তার আঁখি খুললো শুরু হলো বাংলা নববর্ষ -১৪২৯ সন। ধর্মভীরু পল্লীজীবন দিনটি শুরু করলো তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় অনুভূতি, বিশ্বাস আর স্রষ্টার মাহাত্ম্যতে কৃতজ্ঞ হয়ে। বাচ্চারা দ্রুত পরিষ্কার হয়ে নতুন জামা কিশোর-কিশোরীরা নতুন শাড়ি, পান্জাবি আর নানা সাজে সজ্জিত করলো নিজেদের উৎসব। বাচ্চাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলছিল যে যত নতুন জামা পড়ে গুরুজনদের সালাম করছে, তারা সালামি পাচ্ছে। তাদের প্রতিযোগিতা চলছিল কে কত বেশি পাচ্ছে। এসব দেখতে গিয়ে হঠাৎ কানে গেল পাশের বাড়িতে বউমা এবং শাশুড়ী তে ভীষণ ঝগড়া। বৃদ্ধা ঠাম্মু বলে উঠলেন- "আরে,আরে!! করছ কি সুমনের মা! বছরের পয়লা দিনডা ঝরগা দিয়া শুরু করলি? সারাডা বছর তো ঝরগাতেই কাড়বো তগো।"-----

পান্তা- ইলিশ খেলাম আলু ভাজা, শুকনো মরিচ ভাজা, ডালের বড়া সহযোগে। আহা!!ঘরে ঘরে মিষ্টিমুখ। দোকানিরা হালখাতা খুলেছে। সে এক অন্য রকম উৎসব। যে যার মতো মাছ, মাংস কিংবা ভালো খাবার খেয়ে বছরের প্রথমদিন শুরু করছিল। তাদের বিশ্বাস বছরের প্রথম দিনটা যেভাবে শুরু হবে বাকিটা দিন বছরের সেভাবেই কাটবে। তাই তাদের নানা সতর্কতা।

শুনলাম বিকেলে মেলা বসবে। বন্ধুদের সাথে মেলায় গিয়ে দেখলাম পল্লীবাংলার মানুষের নানা হাতের কাজ,কুটির শিল্প,মৃৎশিল্পসহ নানা পন্য। লোকগান, বিভিন্ন গানের আয়োজন। প্রতিটি জিনিস যত্নসহকারে তৈরি এবং নান্দনিক।কিছু জিনিস কিনলাম। খেলাম বন্ধুদের সাথে। মেলায় ঘুরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম। গ্রামের মেঠোপথ – দুইপাশে খোলা মাঠ, অনতিদূরে ধানের ক্ষেত এ বাতাসের খেলা আর আমাদের পথহাঁটা। স্বপ্ন ঠাওরাচ্ছিলাম। বাড়ি ফিরে পুরো দিনটা একবার হৃদয়পটে আঁকলাম। আহা কত মনোরম,মনোহর,সুন্দর জীবন আর তাদের নববর্ষ। এখানে না আছে অতিসংস্কৃতির হুড়োহুড়ি। না ডিজে গান,না উত্তাম নাচ। এখানে আকাশ মাটিকে ছোঁয়। মাটি আর মানুষ একাকার হয়ে বাঙালিত্ব ধরে রেখেছে গ্রামবাংলার মানুষ। তাদের জীবনপ্রণালী আর উৎসব উদযাপনের রীতিই বাংলা সংস্কৃতির ধারক। প্রকৃত - বাংলা নববর্ষ।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।