অজয়পাড়ের উপকথা ।। সুদীপ ঘোষাল (পর্ব ০১)


এক
অজয়নদের পাড়ে অবস্থিত কয়েকটি গ্রাম বর্ধিষ্ণু। সেইসব গ্রামের ছেলেরা ধনীর দুলাল।তারা কানডা,সিঙ্গাপুর,সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ লোক গরীবের দলে। আর অজয়নদের আশেপাশের গ্রামগুলিতে কবি জয়দেব থেকে শুরু করে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাসস্থল। আমাদের বন্ধু সোমনাথ কমার্শিয়াল আর্টস দু-একটা করেন শিল্পী। পার্থপ্রতিম দেবের কাছে এখন শিক্ষারত। গুরুদেব ছিলেন বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন।শিব চন্দ্র হাই স্কুলে পড়তেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, এইচএস অব্দি পড়াশোনা করেছেন। সেভেন, এইটে পড়তে পড়তে আঁকা শুরু।একদম বালক বয়স থেকে আঁকা শুরু। কীর্ণাহার, নানুর থানায় বাড়ি, অঙ্কনশিল্পী সোমনাথ মন্ডলের।
১৯৭৫ সাল থেকে অজয়নদের পাড়ে আশেপাশের  গ্রামের ছেলেদের নিয়ে বন্ধুদল।আমাদের বন্ধুদল সমাজসেবার কাজ  ও ভ্রমণ করার  উদ্দেশ্যে টাকা জমানো শুরু করে ।প্রতিমাসে একশ টাকা করে মোট তিরিশজন টাকা জমা রাখতাম আমাদের বন্ধুদলের কো অপারেটিভ সংস্থায়।  দশ বছরে অনেক টাকা জমেছে।জীবনটা ঠিক ছবির মত। মন খেয়ালের তুলিতে রাঙানো যায় জীবনটা মধুবনি কৌশলে।আমাদের দলের ক্যাপটেন বিশু বলে, ঠিক দেড়শ বছর আগে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল।গত শতাব্দীতে ভারতের বামপন্থী রাজনীতিও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে, আর তাতে অক্টোবর বিপ্লব তথা সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আগাগোড়াই।রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বা তার উত্তরসূরী স্তালিন একটা পর্বে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন, কিন্তু পরে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মাও জে দংয়ের আবেদনই যে ভারতের বামপন্থীদের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাতেও বোধহয় কোনও ভুল নেই।কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একশো বছর আগেকার সেই অক্টোবর বিপ্লব ঠিক কীভাবে ছায়া ফেলেছে?বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা মূল কথাই হল আন্তর্জাতিক সংহতি বা সলিডারিটি। সুদূর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়েই যে এদেশে কমিউনিজমের বীজ রোপিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই।আমাদের বন্ধু মীর আলি বলেন,  ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে।শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ।১৯৭১ সালে সিপিআই(এম-এল) ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। চারু মজুমদারের দল থেকে সত্য নারায়ন সিং বেরিয়ে যান। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন । তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পলিটব্যুরোর অন্যতম নেতা সুশীতল রায়চৌধুরী আত্মগোপন থাকা অবস্থায় মারা যান। প্রধান নেতৃবর্গের বড় অংশই জেল বন্দী হন। পরে নকশালপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) বহু ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। অনেক বছর পরে অন্যতম প্রধান নেতা কানু সান্যাল ২০১০ সালের ২৩শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানার হাতিঘিষা গ্রামের নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। শারীরিক অসুস্থতা সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। আমাদের সংস্থার সদস্য সংখ্যা কুড়িজন। আমরা গ্রামে গ্রামে গরীব লোকদের সাহায্য করি, অসহায় লোকের পাশে দাঁড়াই। এখন ১৯৮০ সাল। দশ বছরে আমরা অভিজ্ঞ হয়েছি কিন্তু বড় হইনি মনে। মন রয়ে গেছে অঙ্কুরে।আমরা যাত্রাদল খুলেছি,বড়দের নিয়ে।  বিভিন্ন জায়গায় বড়দের সঙ্গে যাত্রাপালা দেখতে যাই । আমাদের কোন মোবাইল গেম ছিল না। তবু কত আনন্দ ছিল। আমরা এখন সকলে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভরতি হয়েছি। অজয় নদ সংলগ্ন গ্রামে যত কবি সাহিত্যিক আছেন আমরা তাঁদের জন্মদিন পালন করি। তাঁদের জীবন ও কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের সংস্থার নাম, জোয়ার। নামে কি আসে যায়। কাজটাই প্রধান। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম এক নম্বর ব্লকের অধীনে গ্রামগুলির ছেলে আমাদের বন্ধুদলে আছে। আট থেকে আশি বছরের বন্ধু আছে আমাদের দলে।।প্রবাদবাবু ছিলেন বিরাশি বছরের তরতাজা তরুণ।তিনি এই বয়সেও তাঁত নিজের হাতে চালান। ওনার বাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে দূরের একটি গ্রামে। তিনি মাসে একবার করে আসতেন আমাদের মজলিশে। তিনি ছিলেন আমাদের সিনিয়র ফ্রেন্ড। প্রবাদবাবু বললেন, কতবার বলেছি একবার আমার তাঁত দেখতে চল তোমরা, তো তোমরা শুনছ না কথাটা।বিশু বলল,যাব একদিন নিশ্চয় যাব। আপনি বুঝিয়ে আমাদের তাঁত সম্বন্ধে কিছু বলবেন। বিশু ছিলো পটশিল্পীর নাতি। তবে বিশুর বাবা ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বিরাজুলের নানা ছিলেন শিলকোটানির শিল্পী।তবে বিরাজুল এখন চাকরি করে। রমেনের দাদু ভুলোলাগা বামুনের অভিনয় করত। আমার দাদু ছিলেন যাত্রাশিল্পী।তখন যাত্রাদলে মহিলারা আসেবর্ধমান জেলা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত বর্ধমান বিভাগের একটি জেলা। এটি মূলত কৃষি প্রধান জেলা। একে পশ্চিম বঙ্গের শস্য ভান্ডার বলা হয়। জেলার বৃহত্তম শহর বর্ধমান মহানগর। ধান এ জেলার প্রধান ফসল। এ ছাড়া গম, পাট, আলু, পেঁয়াজ, আখ হয়। জেলার রানিগঞ্জ এবং আসানসোল কয়লাখনির জন্য প্রসিদ্ধ। দুর্গাপুরে আছে লৌহ-ইস্পাত কারখানা। মীর আলি কম আসত আড্ডায়। ওর বাড়ি বিল্বেশ্বর গ্রামে। পায়ে হেঁটে সাত মাইল পথ।বিরাজুল ছিল ভ্রমরকোল গ্রামের ছেলে। বিশু, আমি ও রমেন একই গ্রামের ছেলে।অরিন্দম, সোহন,অশোক,বিথিকা, অপরূপা  ও আরও অনেকে পাশাপাশি গ্রামের ছেলেমেয়ে। সব খবর ছড়িয়ে পড়ত বাতাসে বাতাসে। সকলে আমরা সকলের আত্মীয়র মত হলে গ্রাম্য হিংসা বা রাজনীতি কম ছিল না। একশজনের মধ্যে চল্লিশ শতাংশ অপরের সমালোচনা করতে ভালবাসে,হিংসা করে আর ভালো লোককে, গরীব লোকদের একঘরে করে অত্যাচার করে। সর্দার পাড়ার,হাজরা,পাড়ার,বায়েনপাড়ার লোকদের অস্পৃশ্য, অশুচি বলে। এই তো গতমাসে বিমান বামুন প্রাতঃকালে ভ্রমণে গিয়ে হাজরাপাড়ায় দেহ রাখলেন। শেষবারের মত জল দিয়েছিল ধাতৃমাতা বিশাখা হাজরা। বিমান বামুন ওকে বেসকা নামে ডাকত। শোনা যায় যৌবনে অই বেসকার সঙ্গে বিমান বামুনের প্রেম ছিল। বেসকা ঝিগিরি করত ওদের বাড়িতে।বেসকা বলত, বামুনের রূপ দেখেছি চেঁটে খাওয়ার সময়। শেষে সে জল খেল ওর হাতেই। জীবন এইরকমই। জেলা সদর বর্ধমান থেকে অল্প দূরে কাঞ্চন নগর ছুরি, কাচির জন্য প্রসিদ্ধ। ধাত্রিগ্রাম তাঁতের কাপড়ের জন্য প্রসিদ্ধ।ন নি। দাদু মহিলা সেজে চমৎকার অভিনয় করতেন। অবিভক্ত  বর্ধমান জেলার অজয় নদের উপর কাশীরামদাস সেতু কেতুগ্রাম থানার চড়খী গ্রামে অবস্থিত।কাটোয়া মহুকুমা বিরাট এলাকা।আমাদের এলাকার লোকেরা বেশিরভাগ কৃষিকাজে যুক্ত। তাছাড়া তাঁতি, পটশিল্পী,শিলকোটানি,ছুতোর, জেলে,কুমোর,কামার সকলে মিলিত হয়ে বাস করেন এখানে। একদিকে কেতুগ্রাম থানার বিভিন্ন গ্রাম আর একদিকে কাটোয়া থানার বিভিন্ন গ্রামের পরিবেশ, প্রাচীন কবি সাহিত্যিক ও সমাজজীবন নিয়ে চলছে প্রবাহ । অজয় নদের ধারে ধারে গীতগোবিন্দম এর রচয়িতা  কবি জয়দেব থেকে শুরু করে চুরুলিয়া গ্রামের কবি নজরুল,কোগ্রামের কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া কাটোয়া মহুকুমার কড়ুই গ্রামে কবিশেখর কালিদাস রায় ও সিঙ্গি গ্রামের কবি কাশীরামদাস উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া এখনকার কবি সাহিত্যিকগণ এই কাটোয়া মহুকুমার গর্ব। আধুনিক কালে আটের দশক থেকে শুরু করে শূণ্য দশকের অনেক কবিসাহিত্যিক এই কাটোয়া মহুকুমার প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেন। অজয়ের পলি শুধু চাষরবাসে নয় মনজমির উর্বরতাও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। বিশু আমাদের দলের প্রধান। আমাদের একটা কো অপরাটিভ সংস্থাও আছে।আমরা সকলে সদস্য এই সংস্থার।বিশু বলে, অজয় নদের জল বাড়লেই আমাদের কাঁদরের জলও বাড়ে।এই কাঁদরের নাম ঈশানী নদী। এঁকেবেঁকে গঙ্গাটিকুরী, বেলুন,কেতুগ্রাম ভুলকুড়ি প্রভৃতি অসংখ্য গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত। এই কাঁদরে আমরা মাছ ধরি, চান করি, চাষের জমিতে জল দিই। ভারতবর্ষের নদ নদীগুলো আমাদের মা। তাই আমাদের দেশ নদীমাতৃক। বিরাজুল আমাদের প্রিয় বন্ধু। সে বলে, ম্যাক ক্রিন্ডল সম্পাদিত ভারতের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী মেগাস্থিনিসের যুগে অম্যস্টিস নামে একটি নদীর উল্লেখ আছে যা কাটাদুপা শহরের কাছে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আরেকজন ইতিহাসবিদ উইলফ্রেড মনে করেন সেই অম্যস্টিস হল বর্তমান অজয়ের কোন প্রাচীন নামের অপভ্রংশ।  সাম্প্রতিক খননকার্যের ফলে অজয় নদের উপত্যকায় পাণ্ডু রাজার ঢিপিতে সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে অজয় নদে কম করে ২০ টি বন্যার লিখিত নথি আছে। নদের নিম্নভাগের বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ রয়েছে। তেরশ শতকে গীতগোবিন্দর লেখক কবি জয়দেবের জন্মস্থান বীরভূম জেলার কেঁদুলি গ্রামে ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের অজয় নদীর ধারে।বার’শ শতকের  সংস্কৃত কবি জয়দেব। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অজয়নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে তাঁর জন্ম। কেউ কেউ তাঁকে মিথিলা বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলেও মনে করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ভোজদেব, মাতা বামাদেবী এবং  স্ত্রী পদ্মাবতী।জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম; অপর চারজন হলেন  গোবর্ধন আচার্য,  শরণ,  ধোয়ী ও  উমাপতিধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপন্ডিত ছিলেন।গীতগোবিন্দম্-এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে চরণশেষে অন্তমিল অনুসৃত হয়েছে, যা সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রায়শই দুর্লভ। এর ভাষা সহজ-সরল এবং প্রায় বাংলার কাছাকাছি। সংস্কৃত ও বাংলার যুগসন্ধিক্ষণে রচিত বলে গ্রন্থটির ভাষা এরূপ সহজ ও বাংলার অনুগামী হয়েছে।বিশু বলে, শ্রীধরদাসের কোষকাব্য সদুক্তিকরণামৃতে গীতগোবিন্দম্-এর ৫টি শ্লোক ব্যতীত জয়দেবের নামাঙ্কিত আরও ছাব্বিশটি শ্লোক পাওয়া যায়। শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে  জয়দেবের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। নাভাজি দাসের ভক্তমাল, হলায়ুধ মিশ্রের  সেখশুভোদয়া প্রভৃতি গ্রন্থে এবং প্রচলিত জনশ্রুতিতে জয়দেব ও পদ্মাবতী সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। বৈষ্ণব সহজিয়াগণ জয়দেবকে আদিগুরু এবং নবরসিকের অন্যতম বলে মর্যাদা দিয়ে থাকেন। বীরভূমের কেন্দুবিল্বতে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেব উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘জয়দেব মেলা’ নামে পরিচিত। এ মেলায় এখন বাউলদের সমাবেশ এবং বাউল আখড়াসমূহ বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিহারের জামুই জেলা চাকাই ব্লকের বাটপার অঞ্চলের ৩০০ মিটার উচু পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে এটি দেবীপুরের নিকটে ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করে (দেওঘরের প্রস্তাবিত শিল্প অঞ্চল) দিয়ে গিয়ে অজয় নদ ঝাড়খণ্ডের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার চিত্তরঞ্জনের নিকট শিমজুড়িতে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং এটি প্রথম পশ্চিম বর্ধমান জেলা এবং ঝাড়খণ্ড হয়ে এবং পরে পশ্চিম বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া ঘাট, বীরকুলটি ঘাট, দরবারডাঙা ঘাট ও সিদ্ধপুর ঘাট হয়ে এবং বীরভূম জেলার বড়কোলা, তামড়া, বিনুই ও নবসন গ্রামের সীমানা হয়ে পূর্বে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রাম থানার নারেং গ্রামের প্রবেশ করে কাটোয়া শহরের কাছে ভাগীরথী নদীর সংগে মিলিত হয়েছে। অজয় নদের মোট দৈর্ঘ্য ২৮৮ কিলোমিটার  তার মধ্যে শেষ ১৫২ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। অজয়ের প্রধান উপনদীগুলি হল ঝাড়খণ্ডের পাথরো ও জয়ন্তী এবং বর্ধমানের তুমুনি ও কুনুর।অজয় নদের ধারা থেকে অনেকদুর অবধি পার্বত্য অঞ্চলের ল্যাটেরাইট মাটির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বর্ধমানের আউশগ্রামে এসে পাললিক সমভূমিতে প্রবেশ করে। অজয় নদের উপত্যকায় শাল,  ও পলাশের ঘন জঙ্গল ছিল। কিন্তু অধুনা খনিজ নিষ্কাষণ ও অন্যান্য মনুষ্যজনিত উপদ্রবে বেশিরভাগ জঙ্গল সাফ হয়ে গেছে।সম্প্রতি, ভারত সরকার  অজয় নদকে জাতীয় নৌপথ আইন, এর আওতায় জাতীয় জলপথ সাত, হিসাবে ঘোষণা করেছে।আমি জানি  কাটোয়া মহুকুমা ও কেতুগ্রাম থানার গ্রামগুলিতে বাস করি আমরা। কাটোয়া মহুকুমার মধ্যে প্রতিটি ব্লকের অন্তর্গত গ্রামগুলিকে  নিয়ে  পথচলা আমাদের । তাছাড়া অজয় নদের ধারে ধারে অনেক কবি সাহিত্যেকের জন্মস্থান। কবি নজরুল ইসলামও অজয় নদের ধারে অবস্থিত চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিশু বলে, চুরুলিয়ার অবস্থান ২৩.৭৮° উত্তর ৮৭.০৮° পূর্ব] সমুদ্রতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ৯৪ মিটার।  চুরুলিয়া অজয় ​​নদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত।আসানসোল ঢেউ খেলানো ল্যাটেরাইট অঞ্চল দ্বারা গঠিত। দামোদর এবং অজয় ​​এই অঞ্চল দুটি শক্তিশালী নদীর মধ্যে অবস্থিত। এ অঞ্চলে উপর দিয়ে একে অপরের সাথে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়, দুটি নদীর মাঝখানের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলটিতে প্রচুর বনভূমি সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে ডাকাত এবং খুনীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কয়লার আবিষ্কারের ফলে এই অঞ্চলটি শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু. এরফলে বেশিরভাগ বনভূমি সাফ হয়ে গেছে।এখন পশ্চিম বর্ধমানে অবস্থিত। পূর্বে বর্ধমান জেলা হিসাবে পরিচিত ছিল।অবশ্যই আমাদের গর্ব এই কবির কথা বিশুর কাছে জেনে আমরা গর্বিত।আমদের গ্রামে তাঁতিপাড়ায় তাঁত বোনা হত। কুমোরপাড়া, কামারপাড়া,ছুতোরপাড়া,মুড়ি আর চিড়া তৈরির পাড়া ছিল। আশেপাশে আঠারোপাড়া গ্রামে বিভিন্ন জীবিকা ছিল তখনকার মানুষের। কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল লাঙ্গলের ফলা, কাস্তে, নিড়ানি, খুন্তি ইত্যাদি।কামারদের কারখানা ক্ষুদ্রশিল্পের আওতায় পড়ে। কামারের কর্মস্থলকে বলে কামারশালা। কামারশালায় হাপর দিয়ে কয়লার আগুন-কে উস্কে রাখা হয়। এই আগুনে লোহা গরম করে তাকে পিটিয়ে বিভিন্ন আকারের জিনিস তৈরি হয়।বাংলাদেশের অধিকাংশ কামারই বৈষ্ণব হলেও কিছু শাক্তধর্ম ধর্মালম্বী কামারও দেখা যায়।কুম্ভকার বা কুমোর একটি পেশা। এই পেশার মানুষ মৃৎশিল্পী - মাটি দিয়ে পাত্র, খেলনা, মূর্তি ইত্যাদি তৈরি করে। কুম্ভকার শব্দটির অর্থই হল কুম্ভ অর্থাৎ কলসি গড়ে যে শিল্পী। কুমোররা মিলে যে পাড়ায় থাকে তাকে বলে কুমোরপাড়া বা কুমোরটুলি। কুমোররা গোল আকৃতির জিনিস বানাবার জন্যে একটি ঘুরন্ত চাকা ব্যবহার করে।বিভিন্ন সাজে মানুষকে আনন্দ দেয়,বহুরূপী সম্প্রদায়।বীরভূম থেকে এক দাদু সেজে আসতেন মেয়েদের সাজে। ঘুঙুর বাজিয়ে বলতেন, খিচাক দম, আলুর দম, আমার বাড়ি বীরভূম। সিউড়িতে করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে দেখা গেল বীরভূমের বহুরূপী সম্প্রদায়ের মানুষদের। সিউড়ির ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে করোনা ভাইরাসের সাজে পথে বেরিয়ে আসা মানুষদের সচেতনতা করেন তাঁরা। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এতদিন এদের দেখা গেছে কালী, কৃষ্ণ, শিব, হনুমান, রঘু ডাকাত, দৈত্য ও ছিনাথ বহুরুপীর বেশে। এবার জেলার মানুষকে করোনা ভাইরাসের বিপদ থেকে সচেতনতা করার জন্য করোনা ভাইরাসের সাজে দেখা গেল বহুরূপী সম্প্রদায়ের এই মানুষদের। বীরভূমের লাভপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ছোট্ট গ্ৰাম বিষয়পুরের ব্যাধ পাড়ায় এই বহুরূপী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন।বাংলার পটচিত্র পট বা বস্ত্রের উপর আঁকা একপ্রকার লোকচিত্র। এটি প্রাচীন বাংলার (বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল) অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিলনা তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের বাহক ছিল। যারা পটচিত্র অঙ্কন করেন তাদেরকে সেযুগে এবং এযুগেও পটুয়া বলা হয়। এরা পট দেখানোর সাথে সাথে গান করেন। লোকে খুশি হয়ে এনাদের পুরস্কৃত করেন। চিনির গোল্লা তৈরি করে চাকা ঘুরিয়ে শোনপাপড়ি বিক্রি করত কানাইদা।কত রঙ বেরঙের ফাঁপা শোনপাপড়ি। বড় গোল ফুটবলের মত। খেলেই মিলিয়ে যেত নিমেষে।আমরা বলতাম, দিল্লি কা লাড্ডু।বড় মোটা বাঁশের ডগায় চিনির লেই পাকিয়ে জড়িয়ে রাখত রঙ বেরঙের লাঠি মিষ্টি। মনাদা এলেই আমরা ভিড় করতাম পয়সা হাতে।মনাদা রঙীন চিনির লেই দিয়ে পুতুল বানাতেন। কাউকে দিতেন খরগোশ, আবার কাউকে দিতেন হরিণ বানিয়ে। বড় সুন্দর ছিল দিনগুলি।
রমেনের বাবা ছিলেন ছুতোর। তিনি বলতেন আমাদের,  ছুতোর বঙ্গ অঞ্চলের একটি পেশাজীবি শ্রেনীর নাম। ছুতোররা কাঠ মিস্ত্রি নামেও পরিচিত, অর্থাৎ এরা কাঠের কাজ করে। ছুতোর বা কাঠ মিস্ত্রি শব্দের ইংরেজি Carpenter। সংস্কৃত সূত্রধর শব্থেকে ছুতোর শব্দটির উত্তপত্তি। বর্ণাশ্রয়ী হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় যে জনগোষ্ঠী কাঠের কাজ করে জীবিকা নিবার্হ করতো তাদের সূত্রধর বা ছুতোর বলা হতো। একটি হিন্দু জাতি বিশেষের পদবি হিসেবেও সূত্রধর শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
বেলুনগ্রামে চিড়া তৈরি হত। আমরা ধান দিয়ে আসতাম। তারপর পনের দিন পর চিড়া,নিয়ে আসতাম।ধান কেটে ঝাড়াই-মাড়াই করে রোদে শুকিয়ে ধানের আর্দ্রতা ১০–১২ শতাংশের মধ্যে আনতে হবে। শুকনো ধান কুলোয় ঝেড়ে অথবা ব্লোয়ার চালিয়ে জোরে হাওয়া দিয়ে চিটে মুক্তো করতে হবে। চিটেমুক্ত শুকনো ধান ঠান্ডা জলে ২৫–৩০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। তবে ধান ভেজানোর আগে জল উষ্ণ উষ্ণ গরম করে নিতে পারলে চিঁড়ে দীর্ঘ দিন মজুত করা সহজ হয়। উল্লিখিত নির্দিষ্ট সময় ধরে ধান ভেজার পর ধান তুলে জল ঝরিয়ে ফেলা হয়।এর পর ভিজে ধান ঢিঁকেতে ফেলে পেটানো হয়। বর্তমানে চিঁড়ে তৈরির কল বেরিয়েছ। চিঁড়েকলে রোলারের চাপে ধান চ্যাপ্টা হয়ে যায়। ধানের খোসাও রোলার ঢেঁকির চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চাল থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসে। ঢেঁকিতে অথবা চিঁড়েকলে ধান চাপানোর আগে বালি খোলায় অল্পক্ষণ ভেজে নিতে পারলে চিঁড়ের গুণমান বর্ধিত হয়।অতঃপর ঢেকির খোল অথবা চিঁড়েকল থেকে খোসামিশ্রিত চিঁড়ে বের করে নেওয়া হয়। এবং তারের জালের বড়ো চালুনিতে ফেলে উত্তম রূপে চালা হয়। গুঁড়ো চালুনির তলায় পড়ে যায়। চালুনির উপরে চিঁড়ে আলাদা হয়ে জমা হয়।বর্তমানে অবশ্য অধিকাংশ চিঁড়েই ভাঙানো কলে তৈরি হচ্ছে। কেননা ঢেঁকির প্রচলন কমে গিয়ে তলানিতে এসে পৌছেছে।উপরোক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত চিটেমুক্ত শুকনো ধান লোহার কড়ায় বালির ওপর ফেলে ভাজা হয়। ভাজার সময় গরম বালি-সহ ধান অনবরত নাড়তে হয়। নাড়তে নাড়তেই ধানের খোসা সরিয়ে বেরিয়ে আসে খই। তবে খইয়ের নীচের দিকে তখনও ধানের খোসা আলগা ভাবে আটকে থাকে। খোসা সুদ্ধ খইয়ের পর তারের চালুনিতে ফেলে বেশ কয়েক বার নাড়াচাড়া করলে খোসা ও খই আলাদা হয়ে যায়। চালুনির ফাঁক গলে খোসা নীচে পড়ে। চালুনির ওপরে থেকে যায় খই। বর্তমানে খই তৈরির মেশিন বেরোলেও রাজ্যের অধিকাংশ খই এখনও গাঁয়েগঞ্জে বালি খোলাতে ভেজে তৈরি করা হয়। সব ধানের খই ভালো হয় না। উত্কৃষ্ট খই বানানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধানের জাত চাষ করা হয়ে থাকে। যেমন সুগন্ধি খইয়ের জন্য চাষ করা হয় কনকচূড় ধান।ধান সিদ্ধ শুকনো করে যা চাল তৈরি হয় সেই সিদ্ধ চাল থেকেই মুড়ি বানানো হয়। মুড়ি বানানোর প্রথম ধাপে জল ঝরানো ভেজা চাল আগুনে বসানো শুকনো কড়ায় ফেলা হয়। এর পর চালের ওপর মাপমতো নুন/খাবার সোডা ফেলে কড়া চাল ততক্ষণ নাড়াচাড়া করে যেতে হবে যতক্ষণ না আঠালো হয়। চাল আঠালো হয়ে গেলে কড়া থেকে নামিয়ে বস্তায় মুখ বেঁধে ১ – ২ দিন ফেলে রাখা হয়।দ্বিতীয় ধাপে বস্তা থেকে চাল বার করে আগুনের ওপর বসানো শুকনো কড়ায় ভাজতে হবে। শুকনো কড়ায় নাড়াচাড়া করতে করতে ততক্ষণ ভাজতে হবে যতক্ষণ না চাল লাল হয়ে ঠিকমতো শক্ত হয়। যাতে দাঁতে কাটলে ‘কট’ করে শব্দ করে দু’ খানা হয়ে ভেঙে যায়, গুঁড়ো হয়ে বা চেপ্টে যায় না।তৃতীয় দফায় এই ভাবে ভাজা চাল কড়ায় জ্বাল দিয়ে গরম করা বালির ওপর ফেলতে হবে। ফেলে বালিশুদ্ধ চাল নাড়াচাড়া করতে হবে। বালি ঠিকমতো গরম হলেই চাল ফুটে মুড়ি তৈরি হবে। বালিশুদ্ধ গরম মুড়ি চালুনিতে চেলে নিলেই বালি তলায় পড়ে গিয়ে মুড়ি আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসবে।সব ধানের মুড়ি সুস্বাদু না হলেও বর্তমানে জাতের বাছবিচার না করে যে কোনও ধানের চাল থেকেই মুড়ি তৈরি হচ্ছে। এবং বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কেবলমাত্র গাঁয়েগঞ্জে নয়, শহরের উপকণ্ঠে এখনও আগুনের আঁচে শুকনো খোলায় ও বালি খোলায় মুড়ি ভাজার কাজ চলছে বাণিজ্যিক ভাবে। তবে মুড়ির চাহিদা বাড়ার যান্ত্রিক কলে মুড়ি বানানো ক্রমশই বাড়ছে।সিদ্ধ শুকনো ধানের বদলে শুকনো চাল সরাসরি ধান কলে ভাঙিয়ে যে চাল পাওয়া যায় সেই আতপ চাল থেকেই চালভাজা বানানো হয়। খই, চিড়ে, মুড়ির তুলনায় চালভাজার চাহিদা নগণ্য। তবুও শহর ও শহরতলিতে হামেশাই রাস্তার পাশে বালতি উনুনে লোহার কড়ায় বালি খোলায় চালভাজা তৈরি হতে চোখে পড়ে। খই, মুড়ি অথবা চিড়ে অপেক্ষা চালভাজা তৈরির পদ্ধতি অনেক সহজ। কড়ার এক তৃতীয়াংশ বালি ভরে উনুনে বসানো হয়। বালি গরম হলে শুকনো চাল ফেলে নাড়া চাড়া করতে করতে ততক্ষণ ভাজা চলে যতক্ষণ না চাল পট পট করে ফাটতে শুরু করে। পট পট করে চাল ফোটার ৫–১০ মিনিটের মধ্যেই চালভাজা তৈরি হয়ে যায়।আমাদের দলে বিশু ওরফে দিলীপ ছিল ক্যাপটেন।আমরা ওকে বিশু বলে ডাকি।  তাছাড়া রিলিফ, বাবু, রমেন, বিরাজুল,বিশ্বরূপ, মিলু, অধির,পিনু,রমেন, নোটন, আশীষ,অপরূপা,টুম্পা,পুমণি,মনু,বুড়ি কত সঙ্গি ছিল।  সকলে আমরা তার কথামত চলতাম। কবি নজরুলের জন্ম জয়ন্তী পালন করতাম আমরা প্রতিবছর।ছেলেমেয়েরা গান করত,আবৃত্তি করত।আমরা পরপর সকলে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতাম। প্রথমে উদ্বোধনী সংগীত হল।তারপর ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি করল। এরপরে গ্রামের মাষ্টারমশাই কবি নজরুল সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, কবি নজররুল  স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন এবং লিখতে শুরু করেন পরপর বিদ্রোহী কবিতা গুলো। কবি নজরুল ছাড়া অন্য নামগুলো কাল্পনিক হলেও তাঁর জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রেম ও প্রকৃতি র  আবেগপূর্ণ কবিতা বড় একটা চোখে পড়ে না এমনভাবে। মানব প্রেমের গজল তার অনবদ্য এক সৃষ্টি। কবি নজরুলের জীবন ও কাব্য দুইই বিস্ময়কর অভিনব উৎকেন্দ্রিক। কন্ঠে সুরে রেশ নিয়ে তিনি মানবপ্রেমে ডুবে যেতেন। বন্ধুবৎসল নজরুল বন্ধুদের আড্ডায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হতেন। ঠোঁটেপানের লাল রঙ আর  সুরের কন্ঠ নিয়ে তিনি মানুষকে আজীবন ভালবেসে গেছেন। যৌবন ধর্মের অতি রেকে   সারা দেশটাকে তিনি চষে বেড়াতেন।বিদ্রোহের কবিতা ও গান লিখে তিনি বিদ্রোহী উপাধি পান দেশের জনগণের কাছে। স্বয়ং কবিগুরু যৌবন মূর্তি নজরুলকে অতিশয় স্নেহ করতেন এখন পাঠকসমাজের নয়নতারা স্বরূপ গণ্য হয়েছিলেন। বিদেশি সরকারের রক্তচক্ষু অবহেলা করে দুরন্ত কবি, কবিতা গান ও প্রবন্ধের সাময়িকপত্রে আগুনের ফুলকি ছড়াতে লাগলেন। সামান্যতম স্পর্শে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুরু হতে পারত। এর জন্য কিছু কলকাতায় কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল বোধ হয় রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে ইদানিং আর কোন কবি ও লেখক এতটা উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারেননি। তাঁর কাব্য ও গানে যে বীর্যবান বর্তমান জাতীয় জাতি সম্প্রদায়ের উপলব্ধি ব্রীটিশ  বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি করেছে।যে কবিতাসমূহ বিদ্রোহ জোড়া  অস্থিরতা বোধ করে সর্ববিধ শাসক,  যৌবনকে বরমাল্য দিয়েছে তার সঙ্গে কোনো দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না হিন্দু-মুসলমানের স্বাভাবিক বিচার কে অবহেলা করে উপেক্ষা করে তাদের মিলনের  এক  ছাতার তলায় এনেছিলেন। কবি নজরুলের অগ্নিবীণা ও হয়তো সেই ভাঙ্গার গান বিষের বাঁশি প্রভৃতি কাব্যসংগ্রহ সংগীত সংকলনের প্রচুর রসের আমদানি করা হয়েছে।বাবু বলে,বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। আমরা তাঁকে প্রণাম জানাই।এই বলে মাষ্টারমশাই চুপ করলেন।তারপর বিরাজুল আমাদের শোনায় কবির গল্প। কবি নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক  সম্মানিত ময়াজ্জিন  হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন লেটো দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। সেনাাাবিভাগে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতায় থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে শোষক বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল  তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট মুক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল   গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন  "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়ও পরিচিত হন।চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল ১৯১৪ সালে  ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। রমেন আলোচনায় অংশ নেয়। সে বলে, এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল ১৯১৫-১৭ সালে একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি  বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন। করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’  নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি, এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, যেমন:  প্রবাসী,  ভারতবর্ষ,  ভারতী,  মানসী, মর্ম্মবাণী,  সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই। আমরা এখন আলোচনায় মগ্ন জোয়ার সংস্থার নির্দিষ্ট ক্লাবঘরে।এখানে লাইিব্রেরীও আছে।বিশু আবার বলে, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল দেশে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে  বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি-র অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। শুরুতেই  মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা  প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্যোরচিত বাঁধন-হারা  ও আরও নানা  কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে। কবি-সমালোচক  মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বাংলার সারস্বত সমাজে তাঁকে স্বাগত জানান। নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজালুল হক,  কাজী আবদুল ওদুদ,  মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ সমকালীন মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। অপরদিকে কলকাতার তৎকালীন জমজমাট দুটি সাহিত্যিক আসর ‘গজেনদার আড্ডা’ ও ‘ভারতীয় আড্ডা’য়  অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর,  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর,  সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ,  প্রেমাঙ্কুর আতর্থী,  শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য,  সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু দশক বাংলার দু প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।এ.কে ফজলুল হকের  সম্পাদনায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক  নবযুগ প্রকাশিত হলে তার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধের জন্য ওই বছরেরই আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের দৃষ্টি পড়ে। নবযুগ পত্রিকার সাংবাদিকরূপে নজরুল যেমন একদিকে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক জগতের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা নিয়ে লিখছিলেন, তেমনি মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে ও ছিলেন। আমাদের সব বন্ধুরা পড়াশুনা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে উপস্থিত থেকে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হচ্ছিলো সকলে। পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া আসর ও অনুষ্ঠানে যোগদান এবং সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তরুণ ছাত্রদের  সংস্কৃতিচর্চাও অগ্রসর হচ্ছিল। 
এরপরে মিলু বলে,কবি  নজরুল তখনও নিজে গান লিখে সুর করতে শুরু করেন নি, তবে তাঁর কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে তার স্বরলিপিসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা, যেমন: ‘হয়ত তোমার পাব দেখা। আমরা কবি নজরুলের জন্মদিনে অনাথ ছেলেমেয়েদের পেট ভরে খাওয়াতাম আমাদের জমানো টাকা খরচ করে।সকাল থেকে শুরু হত জন্মদিনের আয়োজন। ছেলেমেয়েরা ফুল আনত।প্রভাতফেরী হত। তারপর সমবেত ভোজনের আয়োজন হত। অধীর স্টেজে উঠে বলে, , ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাস নজরুলের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ সময়। এ সময় তিনি মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে পরিচিত হন পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে এবং তাঁর সঙ্গেই নজরুল প্রথম কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। এখানে তিনি প্রমীলার সঙ্গে পরিচিত হন এবং এ পরিচয়ের সূত্র ধরেই পরে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।বিশু আবার বলে, কবি নজরুল বিভিন্ন শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গাইলেন সদ্যোরচিত ও সুরারোপিত স্বদেশী গান।এ কোনো পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, ‘আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে, মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে’ প্রভৃতি। এভাবেই কলকাতার সৌখিন গীতিকার ও গায়ক নজরুল কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে জাগরণী গান রচনা ও পরিবেশনার মধ্য দিয়ে স্বদেশী গান রচয়িতা ও রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হন।১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে নজরুল আবার কুমিল্লা যান। ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল। নজরুল পুনরায় পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন: ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ এ সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে মুসলমানরা  খিলাফত আন্দোলন করছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আর মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল ছিলেন না। স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল; তথাপি ভারতের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের জন্যই তিনি ওই দুটি আন্দোলনে যোগদান করেন।বিশু বলে যায়, এবার শোনো সকলে  মন দিয়ে কবির গল্প। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে  কলকাতা ফেরার পর নজরুলের দুটি ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত। এ দুটি রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল; ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত বা তুরস্কের সুলতানকে উচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজজীবন থেকে মোস্তফা কামাল যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেছিলেন, তা নজরুলকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তুরস্কে যা সম্ভবপর, ভারত ও বাংলায় তা সম্ভবপর নয় কেন? বস্ত্তত, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতা থেকে দেশবাসী, বিশেষত স্বধর্মীদের মুক্তির জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। নজরুলের  লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।১৯২২ সালে নজরুলের যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্প-সংকলন ব্যথার দান, কবিতা-সংকলন অগ্নি-বীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী। বাংলা কবিতার পালাবদলকারী কাব্য অগ্নি-বীণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়; কারণ এ কাব্যে নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’,  ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়েছিল।১৯২২ সালে নজরুলের অপর বিপ্লবী উদ্যম হলো  ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ । পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। বিশের দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের পুনরাবির্ভাবে ধূমকেতু পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। এক অর্থে এ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। অাঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ রবীন্দ্রনাথের এ আশীর্বাণী শীর্ষে ধারণ করে। ধূমকেতুর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২। একই দিনে নজরুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে যে জবানবন্দী প্রদান করেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্য-মর্যাদা পেয়ে আসছে। ১৬ জানুয়ারি বিচারের রায়ে নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন।নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য তাঁকে উৎসর্গ করেন।  এ ঘটনায় উল্লসিত নজরুল জেলখানায় বসে তাঁর অনুপম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ রচনা করেন। সমকালীন অনেক রবীন্দ্রভক্ত ও অনুরাগী কবি-সাহিত্যিক বিষয়টি ভালো চোখে দেখেন নি। এ ব্যাপারে কেউ কেউ অভিযোগ করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের নজরুল-কাব্যপাঠের পরামর্শ দেন এবং বলেন, ‘...যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। রাজবন্দিদের প্রতি ইংরেজ জেল-সুপারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ওই দিন থেকেই তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে নজরুলকে ’ অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষের বিরূপ মনোভাবের কারণে নজরুল টেলিগ্রামটি পান নি। এদিকে জনমতের চাপে ১৯২৩ সালের ২২ মে জেল-পরিদর্শক ড. আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী হুগলি জেল পরিদর্শন করেন এবং তাঁর আশ্বাস ও অনুরোধে ওই দিনই নজরুল চল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন। নজরুলকে বহরমপুর জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং এক বছর তিন সপ্তাহ কারাবাসের পর ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। হুগলি জেলে বসে নজরুল রচনা করেন ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল’, আর বহরমপুর জেলে ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেল্ছে জুয়া’ এ বিখ্যাত গান দুটি।নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতির কবিতার প্রথম সংকলন দোলন-চাঁপা  প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের অক্টোবরে। এতে সংকলিত দীর্ঘ কবিতা ‘পূজারিণী’-তে নজরুলের রোমান্টিক প্রেম-চেতনার বহুমাত্রিক স্বরূপ  প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যবয়সে তিনি  আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সরকারি আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।"হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র "তাঁর লেখা এই লাইনে প্রকাশিত হয়েছে মানবপ্রেম। সমস্ত জাতিভেদ ভুলে একতার বাণী শুনিয়ে ছিলেন এই বিদ্রোহী কবি। "ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়।’"আমার কৈফিয়ৎ নামে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। এর আগে তিনি তীক্ষ্ম হীরকখণ্ডের মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছেন। ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো ইসলাম সম্পৃক্ত কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’র মতো ক্রুদ্ধ কবিতা লিখেছেন—এতেই বোঝা যায় নজরুল বহুভাবে বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছেন। নজরুলের অনেক কবিতা যেমন-বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, আমার কৈফিয়ৎ অনেক গতিশীল কবিতা। প্রথমেই কবি নিজেকে বর্তমানের কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন।প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ;’কবিতার স্তবকে বর্তমানের কবি কথাটার বিশদ বিবরণ লক্ষণীয়। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছেন মানবপ্রেমিক নজরুল। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, মানুষের বেদনা, যাতনা, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক কথায় মানবপ্রেম।আমি জানি, নজরুলের ছোটগল্পে এক নতুন ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ গল্পে যেভাবে নিচতলার জীবনের কথা উঠে এসেছে তেমন রূপায়ণ বাংলা সাহিত্য ছোটগল্পে ছিল না। নজরুলের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মৃত্যু-ক্ষুধা; বস্তিবাসীর প্রকৃত ছবি এর আগে অন্য কোনো উপন্যাসে পাওয়া যায়নি। নজরুলের উপন্যাসে যে মানবপ্রেমী দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয়েছে তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই ফসল। অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু মুসলমানের মিলন, সমাজের নিচুতলার মানুষের উত্থান এসবই নজরুলের মানবিকতার অংশ। নজরুল মনে প্রাণে ব্রিটিশের উচ্ছেদ কামনা করেছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নজরুলের উচ্চারণে একতিল খাদ ছিল না। নজরুল শেষ পর্যন্ত ইংরেজ নয়-ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মানুষ চিরকাল মানুষের ওপর অত্যাচার করে এসেছে, তা পশুদের পক্ষেও অসম্ভব। নজরুল জীবনভর লাঞ্ছিত মানুষেরই জাগরণ কামনা করেছেন।নজরুলের কবিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিলে দেখি বহু আয়তনে বিস্তৃত তাঁর কবিতা। ব্যক্তি জীবনের উদার মানবিকতার চর্চাই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। ক্রোধ, ধার্মিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ, রাজনীতি, বাস্তব ও স্বপ্ন মিলে কখনো দেখা গেছে গভীর বিষাদে মগ্ন থেকে কবি কাজ করেছেন মাত্র দুই যুগ। সুস্থাবস্থার সময় মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস এই কবিদের চেয়ে অনেক কম পেয়েছেন কবি নজরুল।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে এক সঙ্গ বাস করতে থাকেন। ১৯২০ সালে নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমদ দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন প্রধান পরিচালক। মুজাফফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান।অপরূপা কবির সম্বন্ধে বলে, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থ সমাজতন্ত্রী বাংলা কবিতার দরজা খুলে দিল। ৩০ ও ৪০-এর দশকে সাম্যবাদী কবিতার যে প্রবাহ, তার পথিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলে ও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তাঁর ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে। নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তর আত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় মেলে। পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে। কাজী ফকির আহমেদের ঘরে সেদিন  খুশির আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর ঘরে জন্ম নিয়েছে ঘর আলো করা ছেলে। মা জাহিদা খাতুন খুব খুশি। তাঁরা ছেলের নাম রাখলেন দুখু। দুখুর  বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। তাঁর ভবঘুরে বাল্যকাল আর তাঁর স্কুল শিক্ষা বেশ ভালোই কাটলো। তারপর লেটো দলে গান গাইলেন তিনি। সৈন্যবিভাগেও কাজ করেন। কিন্তু তাঁর অন্তরে তো কবিতার জয়গান বাজে অন্তর জুড়ে। জাতপাতহীন এক সমাজ গঠনের স্বপ্ন ছিলো তাঁর মনে।দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'বল বীর বল উন্নত মম শির,...যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!'তাঁর নাম হলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যাঁর গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। আর মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাঝে ৭৭ বছর জুড়ে ছিল সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস। সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল - 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।' অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে তিনি মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন। কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে বাল্যকালে খানসামা ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেছেন।ভক্তি সংগীত ও প্রেম সংগীত যার কথা আগে বলেছি সেগুলো কিছুই স্থায়ী মূল্য আছে সে যাই হোক তাঁর প্রসিদ্ধ কাব্য কবিতা কালক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে যাবার আশংকা থাকলেও একদা ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা আবির্ভাব হয়েছিল এবং সে প্রয়োজনকে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের দ্বারা সার্থক করে তুলেছিলেন তার স্বীকার করতেই হবে বস্তুত রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা কণ্ঠে ধারণ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে।   কবি নজরুল ইসলামের শেষ সমাধি বাংলাদেশে শায়িত আছে।কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অবশ্য তিনি উভয় বাঙালি কবি। শুধু ভৌগোলিক বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ নয় পৃথিবীর যেখানে বাংলাভাষী রূপে যারা বাস করেন তিনি তাদের আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয় এবং স্মরণীয় কবিরূপে সম্মানীত।  অপরূপার বক্তব্যের পরে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তারপর নরনারায়ণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। সভার পাশে রান্না হত খিচুড়ি, তরকারি আর টক। পূর্ববর্ধমান জেলার লোকেরা টক খুব ভালবাসেন
আমাদের নবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পটুয়াপাড়া  গ্রামে কয়েকঘর পটুয়াশিল্পী  বাস করেন।মাথায় ঝাঁকড়া চুলের  বীরবাহাদুর বললেন, আমরা, পটুয়ারা অনেকে সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি।  গানের তালে তালে দর্শক-শ্রোতাদের পটচিত্রের আখ্যানভাগ বুঝিয়ে দিই।রামায়ণ,মহাভারত আর বেদ,উপনিষদের কিছু  কাহিনী নিয়ে রচিত আমাদের পটচিত্র। এখন সাময়িক ঘটনার কিছু ছবি আমরা আঁকি। 
পটুয়াপাড়া  গ্রামের একজন শিক্ষিত লোকের সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি বললেন,  যশোর ও খুলনা অঞ্চলে পটুয়াদের গাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। অবিভক্ত বাংলায়  ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভুমিতে দেশবিভাগের পর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। যারা থেকে যায় তাদের পেশায়ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভাটা পড়ে। বর্তমানে নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও জামালপুর অঞ্চলে কদাচিৎ দুএকজন পটুয়া বা গাইন শ্রেণীর শিল্পীর সাক্ষাৎ মেলে। পটুয়ারা বিভিন্ন মেলা, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান এবং গ্রামে-গঞ্জে পটচিত্র বিক্রয় করে। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন দেবদেবীর পট পূজা-অর্চনার জন্য সংরক্ষণ করে।পটুয়াদের একটি বড় অংশ  বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠান হিন্দু-মুসলিমরা একসাথে পালন করে। তাদের সামাজিক জীবনযাপন একইরকম।তিনি আরও বললেন, পটুয়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ যারা "পট" (ছবি) আঁকে। পট অঙ্কন গ্রামবাংলার প্রাচীন লোকশিল্প। এর কিছু নিদর্শন এখনো বেঁচে আছে ।  যামিনী রায় প্রাশ্চাত্যের অঙ্কনরীতিতে পারঙ্গম হলেও পটশিল্পকে নিজের অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসাবে তুলে নিয়ে পটশিল্পকে প্রাশ্চাত্যের কাছে বিখ্যাত করেন। কিন্তু যামিনী রায় পটুয়া নন। পটুয়ারা একটি পেশাভিত্তিক লোকগোষ্ঠী যাদের প্রধান পেশা বংশানুক্রমে নিজেদের বিশেষ রীতিতে পট অঙ্কন ও প্রদর্শন বা বিক্রয় করা।
আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বীরবাহাদুর কাকু একটা গোটানো দলিলের মত পটচিত্র বগলে বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। একটা বাড়িতে সুর করে তিনি রামায়ণের কাহিনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ছবি দেখাতেন গোল গোটানো বান্ডিল থেকে। নানরকম ছবি তাতে আঁকা।রাবণ ভিখারী সেজে সীতাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন লঙ্কায়। দুটো ঘোড়া সহযোগে পুষ্পকরথের ছবি। জটায়ু বাধা দিচ্ছে আর রাবণ তাকে তরবারি সহযোগে আঘাত করছেন। জটায়ুর ডানা কাটা দেখে আমার কান্না আসত। কখনও সখনও মা মাসিরাও কেঁদে ফেলতেন কাকুর করুণ সুরের আবেগে। বীরবাহাদুরের পটকাহিনীর  বিষয়গুলো ছিল,  রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ধমীয়, সামাজিকএবং পরিবেশগত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বিষয়নিরপেক্ষ পটগুলির মধ্যে যে কোনও ধরনের নর ও নারীর ছবি অথবা শিল্পচিত্র দেখা যায় এবং সামাজিক পট বলতে বোঝায় সামজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যে পটচিত্র গুলি অঙ্কণ করা হ্য় সেইগুলি। যেমন পোলিও টীকাকরণ অভিযান, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক সম্পৃতী, বৃক্ষরোপন, এইডস সন্মন্ধীয় সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবাধীকার ও নারীনিগ্রহ বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি সঙ্ক্রান্ত পটচিত্রগুলি। আমাদের গ্রামে চলতি সমস্যাগুলেো নিয়েও বীরবাহাদুর পট আঁকত। 
আমি বীরবাহাদুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পট কি গো? 
বীরবাহাদুর বললো,পট মানে কাপড় গো। ন্যাকড়া যাকে বলো।
আমি বললাম, কি কি বিষয়ের উপর তোমার পট আঁকা আছে কাকু?
বীরবাহাদুর কাকু বললো,পৌরাণিক বিভিন্ন গল্প ও গাথা এই পটের উপজীব্য। সেগুলি হল রাবন বধ, সিতা হরণ, রাজা হরিশ্চন্দ্র, কৃষ্ণলীলা, দুর্গালীলা, সাবিত্রী-সত্যবান, মনসা মঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, আনন্দ মঙ্গল, কালকেতু ফুল্লরা ইত্যাদি।

ঐতিহাসিক পটের উপজীব্য যা এর নাম থেকেই প্রকাশিত তা হল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আজাদ্ হিন্দ্ বাহিনী ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আণবিক বোমাবর্ষণ
আমি বললাম, আঁকার পদ্ধতি কি রকম?
 কাকু বললেন, কাপড়ের জমিন তৈরির পর অঙ্কনকাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়। মাটির হাঁড়ি উপুর করে কেরোসিন লম্ফের উপর ধরা হয়। কালো মোটা স্তর চেঁচে কালি করা হয়। 
পট দেখানোর পরে পটুয়া বীরবাহাদুর বাড়ি গিয়ে ঝোলা নামিয়ে বসেন। তিনি গিন্নিকে ডেকে বলেন, কই গো রাজুর মা এক গেলাস জল দাও কেনে। রাজুর মা বলে, আজ কতদূর যেয়েছিলে। পটুয়া বলেন, আজ ভাতারের পাশে শুষনা গেরামে গেয়েছিলাম গো। বড্ড খাটুনি হল।
বীর বলেন, গিন্নি একটা গামছা দিয়ে  পিঠ মুছিয়ে দাও না ক্যানে।
গিন্নি একটু পরে গামছা এনে ঘাম মুছে দেন আদরে।
বীরবাহাদুর কাকুর  ছেলে রামবাহাদুর  পটের ছবি আঁকা শিখছে। সে বড় তুলি দিয়ে এখন কাগজে ছবি আঁকছে রাজা, ঋষি আর রাক্ষসের। বীর বলেন, ভালো করে শিখে নে আঁকাটা।নিজে আঁকতে পারলে খরচ বাঁচবে। তা না হলি চিত্রকরের বাড়ি যেতে হবে। পয়সা লাগবে বিস্তর। ছেলে রাম বলে, দেকো দিকিনি বাবা এটা রামের ছবি বটে?  বীর বলে, একদিনে কি হবে রে? সময় লাগবে।এখন যতদিন বেঁচে আছি আমার কাছে শিখে লেগা। রাম বলে, তুমি রঙটা দাও গা। আমি চান করে আসি।গান গেয়ে রোজগার করা চাল আর আলু সেদ্ধ হতে বিকেল গড়িয়ে যায়। একবারে খেয়ে নেয় তিনজনে পেটভরে কারণ রাতে মুড়ি আর গুড় ছাড়া কিছু জোটে না। বীরবাহাদুর বলে, শিল্পীরা চিরকাল ভিকিরি কেনে গো গিন্নি। গিন্নি বলেন, তাই তো হয় গো।শিল্পিরা হল সাধক। সাধকরা কি কখনও টেকা পয়সার পরোয়া করে গো?
বীরবাহাদুর কাকু  বলেন, ঠিক বলেচিস  তুই। পটের কাহিনীগোলা তাই তো বলে গো। 
পট শব্দটি সংস্কৃত পট্টি  থেকে এসেছে। বর্তমানে এই শব্দটিকে , ছবি আঁকার মোটা কাপড় বা কাগজের খন্ড ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার করা হয়। পটের উপর তুলির সাহায্যে রং লাগিয়ে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলাই পট চিত্রের মূলকথা ।এতে কাহিনী ধারাবাহিক ভাবে চিত্রিত হতে থাকে । অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে পটচিত্র এ মহাদেশের শিল্প জনজীবনের আনন্দের উৎস, শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ।বাংলাদেশের পটচিত্রের মধ্যে গাজীর পট ও পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্রের মধ্যে কালীঘাটের পট উল্লেখযোগ্য । পট মূলত দুই ধরনের রয়েছে। যথা জড়ানো পট,  এ ধরনের পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা এবং ২-৩ ফুট চওড়া হয়।চৌকো পটগুলো আকারে ছোট হয়।কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে একটি জমিন তৈরি করা হয়। সেই জমিনের উপর তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়। আর এক রকমের চট দিয়ে কাগজের পেছনে আঠা দিয়ে আটকানো হয়। আমরা যখন ওয়াল ম্যাগাজিন, জোয়ার প্রকাশ করি তখন প্রথম ছবি কাকু এঁকে দিয়েছিলেন দয়া করে।
ছোট থেকে কাকুকে আমরা তুমি সম্বাধনে অভ্যস্ত ছিলাম। কাকু বলতেন, আপনি আপনি বলবি না। কেমন পর পর মনে হয় রে। তোরা আমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করবি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইতিহাস নিয়েও কি তোমাদের কাজ হয় কাকু? 
কাকু বলেন, ঐতিহাসিক পটের উপজীব্য যা এর নাম থেকেই প্রকাশিত তা হল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,   নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আণবিক বোমাবর্ষণ,ক্ষুদিরামের বিদায়। বাঘাযতীনের জাহাজ প্রভৃতি।
কাকু আরও বলেন, জমিন তৈরির পর অঙ্কনকাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়।
কাকুকে আমি আবার প্রশ্ন করলাম, তোমাদের শুরুর ইতিহাস তুমি জানো কি?
 কাকু বলেন, আমাদের কোন চাষের জমি নাই। আড়াই হাজার বছর আগে থেকে বংশ পরম্পরায় আমরা এই শিল্পে যুক্ত।পটুয়ারা কেবল চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার ও সুরকার। সাধারণত পারলৌকিক ও ধর্মীয়ভাব মিশ্রিত বিষয় নিয়ে পট নির্মিত হলেও পটুয়ারা বিষয় নির্বাচনে রক্ষণশীল ছিলেন না। কর্মে ও চেতনায় তারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, বলা যেতে পারে ধর্মনিরপেক্ষ। সমাজের নানা অন্যায় অবিচার পটুয়াদের পটে চিত্রিত হয়েছে দ্রোহের হাতিয়ার হিসেবে। গ্রাম-বাংলার হাট-বাজার, পথে-ঘাটে বিভিন্ন লোকালয়ে পট দেখিয়ে গান গেয়ে, গল্প বলে তারা মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ বিলাতেন, বিনিময়ে জীবনধারনের মতো অর্থ উপার্জন করতেন। সে-কারণে তাঁদের বলা হত ভবঘুরে চিত্রকর। তাঁদের নীতিজ্ঞান ছিল উঁচু পর্যায়ের। সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায়ে রাখতে পটশিল্পীরা ছিলেন সদা সচেষ্ট, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের ছবি ও গানে। পটুয়ারা কেবল লোকরঞ্জকই ছিলেন না, ছিলেন লোকশিক্ষকও।
পটুয়াপাড়ার আকাশে বাতাসে এক ধর্মীয় চেতনা সদা জাগ্রত। তারা এখনও বিশ্বাস করেন, ভগবান আছেন। তিনি অন্যায় মার্জনা করেন না, জাতিভেদ বা বর্ণভেদ করলে মানুষকে শাস্তি দেন। মৃত্যুর পর মানুষের অন্যায়ের বিচার করা হয় কিভাবে তার চিত্র পটশিল্পীরা এওনও আঁকেন। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরেও আর একটি জীবন আছে। তাই বেঁচে থাকতে জীবনে দান, ধ্যান,দয়া,ধর্ম করা উচিত। 
জীবনটা ঠিক ছবির মত। মনখেয়ালের তুলিতে রাঙানো যায় জীবনের ক্যানভাস। ইংরাজী ১৯২০ সাল।বৃটিশদের বিরুদ্ধেলড়াই চলছে জোর কদমে।তখনকার সময়ে রায় পরিবারের সুমনের জীবনের  ঘটনা।সুমন যাত্রাদলে বাঁশি বাজায়।আর গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করে নানারকমভাবে।   ঠিক একশো বছর আগে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল।গত শতাব্দীতে ভারতের বামপন্থী রাজনীতিও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে, আর তাতে অক্টোবর বিপ্লব তথা সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আগাগোড়াই।রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বা তার উত্তরসূরী স্তালিন একটা পর্বে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন, কিন্তু পরে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মাও জে দংয়ের আবেদনই যে ভারতের বামপন্থীদের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাতেও বোধহয় কোনও ভুল নেই।কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একশো বছর আগেকার সেই অক্টোবর বিপ্লব ঠিক কীভাবে ছায়া ফেলেছে?বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা মূল কথাই হল আন্তর্জাতিক সংহতি বা সলিডারিটি। সুদূর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়েই যে এদেশে কমিউনিজমের বীজ রোপিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। পাঁচ    ছেলের পরে   আবার পুত্রসন্তান হয়েছে রায় পরিবারে।খুব সুন্দর দেখতে  হয়েছে।কোনো লোকের যাতে নজর না লাগে তাই নাম রাখা হলো কালো। সুমনবাবু খুব খুশি।সুমনবাবুর বোন সুমিতাও খুব খুশি।সুমনবাবু খুব ভালো বাঁশি বাজান।যাত্রাদলে  রাতের পর রাত তাকে বাঁশি বাজাতে হয়।আড় বাঁশি।তাই বেশির ভাগ রাতে তিনি বাড়ি ছেড়ে থাকেন।যাত্রাদলের মেয়ে রূপসী সুমনকে ভালোবাসে।সুমন সুদর্শন।ভালো চিত্রশিল্পী।সুমনরা দুই ভাই।বিমল তার ছোটো ভাই।সুমনের বৌ খেনী আর বিমলর বৌ কুড়ো।একদিন খেনী,কুড়ো আর বিমল গঙ্গায় স্নান করতে গেলো।বিমল সাঁতার জানে না।তাই কুড়ো বললো,বেশিদূর  যাবে না। ভয় লাগে।

----ঠিক আছে যাব না।
কিন্তু জোয়ারের টানে ভেসে গেলো কুড়োর সিঁদুর।বিমলকে খুঁজে পেলো না কেউ।তারপর কুড়োর সুন্দর চুলের বেণী কেটে ঝুলিয়ে রাখা হলো বাড়ির মাচায়।কুড়ো বাল্যবিধবা হলো।চিরজীবন বয়ে বেড়াবে কয়েক দিনের বিয়ের জীবনের স্মৃতি।খেনীর ছেলে কালো।খেনী নিজেওযেমন সুন্দরী আবার ছেলেটিও তাই।মহিলামহলে খেনীর রূপের খুব সমাদ। সুমন বাড়ি এলে বলে,তো মাকে আর বাঁশি বাজা তে হবে  না।জমি জায়গা দেখাশোনা করার পর   আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না  । 
সুমন বললো,দেখো আমি শিল্পী মানুষ।জমি জায়গা নিয়ে আমি থাকতে পারবো না।
----পারবো না বললে হবে না। ছেলে মানুষ করতে হবে।জমি বেদখল হয়ে যাবে।

----আমাকে বোঝার চেষ্টা করো দয়া করে।আমি শিল্পী মানুষ।আমি বাঁশি ছাড়া মৃত।আমাকে রেহাই দাও।

খেনী চোখের জলে অন্য ঘরে চলে গেলো।তার সংসারের চিন্তায় মন খারাপ হয়ে গেলো।আজ রাতে গান নেই।তাই ছুটি। বাড়িতেই আছে।তবু রাতে বৌ এর কাছে না থেকে বাগানে বাঁশি বাজায় সুমন।তার সুর শুনে খেনীর ভয় হয়।এই আপদ বাঁশি তার সংসার ভেঙ্গে দেবে না তো? এই চিন্তায় খেনী রাত কাটায়। আর সুমন সারা রাত রূপসীকে মনে রেখে বাঁশি বাজায় ক্ষণে ক্ষণে।তারপর রাত পোহালেই চা, মুড়ি খেয়ে বেরিয়ে পরে সুমন।আজ যাত্রা আছে।মীরার বঁধুয়া।মুরা রী   বাঁশি মুখে ধরে থাকবে আর আড়াল থেকে বাজবে সুমনের  বাঁশি।আজ কৃষ্ণ সাজবে মুরা রী।     মীরা মুগ্ধ হবে সুরে।রূপসী আজ মীরা সাজবে।কত লোকে হাততালি দেবে।পুরষ্কার পাবে মুরারী।রূপসী জানে, দলের সবাই জানে বাহাদুর বংশীবাদকের বাহাদু। তবু মুরারী নামের কাঙাল সেজে কপটতা করে।সুমনের তর উপর রাগ হয় না। কৃপা হয়। রূপসীর পিছন পিছন ঘুর ঘুর করে মুরারী।কিন্তু রূপসীর মন পায় না।  রূপসী আড়ালে সুমনকে বলে,ডিম,দুধ খাবে।আমার কাছে আসবে।আমি দেবো।
---আমার বেশি খেলে বদহজম হয়।হাল্কা মুড়ি আমার প্রিয়।
----না না।মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।
----বেশি খেলে আমার বাজাতে কষ্ট হয়।
----ঠিক আছে।আমার কাছে এসে তুমি যখন   বাঁশি বাজাও আমার মনটা কেমন হারিয়ে যায়।
----জানি আমি।তোমার জন্য আমি বাঁশি বাজাই।তুমি আমার বাঁশি শুনলেই হবে।আর কাউকে চাই না।
সুমন বাঁশি বাজানোর সঙ্গে কোনো আপোষ করে না। তাতে না খেয়ে থাকতে হলেও থাকবে।কোনো আপত্তি নেই।অপরদিকে রাবণ অপেরা এদের প্রতিদ্বন্ধি।তারা সুমন কে নিজেদের দলে আনার জন্য নানারকম রাজনীতি করে। কিন্তু সুমন দল ছাড়বে না। মুরারী অপেরায় তার প্রিয়া রূপসী আছে। তাকে ছেড়ে কি করে সে বাঁশি বাজাবে।রাবণ অপেরার ম্যানেজার বললো  , তোমার খুব অহংকার। আচ্ছা তোমাকে আমরা দ্বিগুণ টাকা দেবো।আমাদের দলে এসো।
----না আমি পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। 
---আচ্ছা তোমাকে দেখে নেবো।

নিরহঙ্কার সুমনের লোভ নেই। সে সুরে সুরে মহাসুরের সঙ্গে মিলতে চায়।সুমনের ছয় ছেলের মধ্যে এখন শুধু বেঁচে আছে কালো।একবার গ্রামে ওলাউঠা হয়েছিলো।সেই মহামারিতে মরে গেছে সুমনের পাঁচ সন্তান। খেনীর এখন একমাত্র ভরসা এই কালো।সে ভাবে,তাকে মানুষ করতে হবে।বাবার মত বাউন্ডুলে যেনো না হয়।ভাগীদার গণেশ হাজরা জমি দেখাশোনা করে। সুমন ছমাসে,নমাসে একবার বাড়ি আসে। টাকা পয়সা মাঝে মাঝে পাঠায়। এইভাবে সময়ের তালে তালে কালো পড়াশোনা শিখে বড় হতে থাকে।কেতুগ্রামের মেনকা সম্পর্কে খেনীর আত্মীয়।রূপে,গুণে,সংগীতে মেনকার জুড়ি মেলা ভার।পড়াশোনায় তার সমকক্ষ    কেউ নেই।মেনকা গ্রামের আপদে বিপদে সকলের আগে এগিয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা খুব ভালোবাসে মেয়োটিকে।ক্ষ্যান্তবুড়ি মরে গেলে মেনকা চাঁদা তুলে পাড়ার দাদাদের নিয়ে তার শবদাহ করেছিলো।গ্রামের বয়স্ক লোকেরা তাকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন।মেনকা নিজে একজন স্বাধীনচেতা তরুণী। নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সমাজের মঙ্গল করাই তার লক্ষ্য।তার জন্য তিলে তিলে নিজেকে সে উপযুক্ত করে তোলে।এই গ্রামে এক সুদখোর লোক ছিলো।গরীবদের কাছে সে দশ শতাংশ হারে সুদ নিত।দেনা শোধ না করতে পারলে জমি জায়গা সোনাদানা কেড়ে নিত।মেনকা এই লোকটাকে দেখতে পারত না। তাকে দেখলেই রাগ হয়ে যেত।জব্দ করার ফন্দি আঁটত দিনরাত।মেনকা কৃষক পরিবারের সন্তান।সে হাঁস পুষত।তার হাঁসগুলো যখন ডানা ঝাপটে জলে নেমে ডুব দিত তখন সেও হাঁস হয়ে ডুব দিত অতল জলে।মক্ত খোঁজার আশায় তার ডুব। ডুবে ডুবে কখনও তার বেলা বয়ে যেত।কিন্তু মুক্ত তার অধরা রয়ে যেত।  রাতে সে শিক্ষা নিত চাঁদের বাগানে।তার শিক্ষক বলতেন,চাঁদের বুকে অই যে কালো কালো দাগ দেখছো অইগুলো কলঙ্ক।তবু একটা তৃণ অবধি পৌঁছে যায় তার আলো।কাউকে বাদ দেয় না সে।তিনি মেনকাকে বলতেন, জীবনে যতই বাধা আসুক। এগিয়ে যাবার পথ থেকে সরে আসবে না। একদিন ঠিক সফলতা তোমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে।তারপর সকালে উঠেই মেনকা বই হাতে যায়   শিক্ষকের বাড়ি। সঙ্গে ছাগল,ভেড়া, হাঁস।তাদের যথাস্থানে রেখে তারপর শিক্ষকের বাড়ি যায় । 
সুদখোর মহাজন মেনকাকে দেখে বললো,এই সুন্দরী শোন। এদিকে আয়। 
মেনকা বলে,কি বলছেন বলুন? 
-----একবার দুপুর বেলায় আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে দেখা করিস তো।
---কেন? আমার সঙ্গে কি কাজ?

---গেলেই জানতে পারবে।মহাজন এমনি ডাকে না। তোমার কপালে আজ প্রাপ্তি্যোগ আছে।  যেও বেশ।
---এমন আদরের ডাক কি আর ফেলতে পারি।যাব। 

ঠিক দুপুরবেলায় মেনকা তার দলবল নিয়ে হাজির হলো মহাজনের বাড়ি।সবাই ভূতের সাজে উঠে পড়েছে আম গাছে।পাকা আম। সব পেড়ে খাচ্ছে সকলে।মেনকা সাদা শাড়ি পরে কড়া নাড়লো মহাজনের দরজায়।মহাজন বাইরে বেরিয়ে মেনকাকে দেখে পাগলপ্রায়।গায়ে হাত দিয়ে বলে, আয় ভেতরে আয়।
----যাব,?আমরা ভূত পেত্নির দল তোর বাগানে থাকি।আজ মেনকার সাজে তোর কাছে এলাম। অই দেখ তোর বাগানে কত ভূত।
মহাজন খুব ভিতু।ভূতের ভয়ে সে রাতে বাইরে বেরোয় না। ভয়ে বললো,তোরা ভূত।ওরে বাবারে, আমার সব আম শেষ করে দিলো রে।
সঙ্গে সঙ্গে মহাজনের গালে এক থাপ্পড়।মহাজন জোড় হাতে ক্ষমা চাইছি।আমাকে ছেড়ে দাও।
----ছেড়ে দিতে পারি।একটা শর্তে।যত দলিল,সোনা তুই চুরি করেছিস সবাইকে ফেরত দিবি।তা না হলে আবার আসবো।
---না না। আমি সব দিয়ে দোবো।আমি আর সুদের কারবার করবো না।   

তারপর কিছুদিন পর সুদখোর মেনকার বাবার জমির দলিল ফেরত দিয়েছিল। হয়ত ভূতের   ভয়ে তা না হলে লোকবলের ভয়ে।মেনকার বাবা বলতেন,মনে রাখবি মা,জল জল গঙ্গাজল।আর নল,বল লোকবল। বল বা শক্তির মধ্যে লোকবল শ্রে। তার প্রমাণ মেনকা হাতেনাতে পেলো।সুদখোর মেনকার সামনা সামনি হয়নি আর কোনো দিন।মেনকা জানে,ওরা সবলের ভক্ত আর দূর্বলের যম।মেনকার সঙ্গে সবসময় বন্ধুরা থাকত।প্রায় বিশ পঁচিশজন গ্রামের ছেলেময়ে খেলা করত একসাথে।  দলবল নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজ করত নিঃস্বার্থভাবে।মেনকা এইভাবে বড় হতে লাগলো।তারপর সে গ্র্যাজুয়েট হলো।তার বাবা এখন খুব খুশিমনে কৃষিকাজ করেন।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।