আদর্শ বউ ।। আফছানা খানম অথৈ

 

ফাতেমার বিয়ে হয়েছে সাত বছর।সে এখন দুবাচ্চার মা।স্বামী নিরুদ্দেশ। কোন খোঁজ খবর নেই।তবুও সে স্বামীর ঘর ছেড়ে যাইনি।শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেবর জা এদের সঙ্গে পড়ে আছে।সংসার করে চলেছে।স্বামীর অবর্তমানে একজন স্ত্রীর সঙ্গে কি হতে পারে তা অনেকে জানেন।ফাতেমা এ বাড়িতে চাকরানীর মতো খেটে চলেছে।তবুও সবাই অসন্তোষ্ট।কারণ তার স্বামী নিরুদ্দেশ,কোন টাকা পয়সা দিচ্ছেনা।এজন্য তাকে প্রতিনিয়ত কটু কথা শুনতে হচ্ছে।শুধু তাই নয় ঠিকমতো খেতে পরতে দেয়া হচ্ছে না।তার সাথে কেউ ভালো ব্যবহার করছে না।এমনকি তার মাছুম বাচ্চা দুটোর সাথেও সবাই খারাপ ব্যবহার করছে।তাদের প্রতি কারো মায়া নেই।সবাই কেমনজানি।ফাতেমা কোন প্রতিবাদ করছে না।বাচ্চা দুটোর মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু হজম করে চলেছে।সব কাজকর্ম করে চলেছে।বিনিময়ে বাচ্চা দুটোকে দুমুটো খাওয়ার জন্য।কিন্তু সেখানেও বাঁধা।তার ছোট ছেলে অয়ন ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বলল,
মা আমার ক্ষুধা লেগেছে,খেতে দাও।
মায়ের অবুঝ মন প্রবোধ মানছে না।তিনি ছেলেকে খেতে দিলেন।অয়ন ভাতের লোকমা মুখে দিবে এমন সময় তার চাচী তার হাত হেকে ভাতের থালা কেড়ে নিয়ে বলল,
ভাবী আপনার এত বড় সাহস,সবার আগে অয়নকে  খেতে দিয়েছেন।?
এতটুকুন বাচ্চা ক্ষুধা লেগেছে,তাই খেতে দিয়েছি।এতে দোষের কী দেখলে।
দোষ হয়নি মানে,আপনার স্বামী কটাকা দেয়,যে অয়নকে সবার আগে খেতে হবে।আমি সাবধান করে দিচ্ছি।আপনারা মা ছেলে সবার পরে খাবেন।
ঠিক আছে রাহেলা তাই হবে।
ফাতেমা ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইলে।সে কেঁদে কেঁদে বলে,
মা আমার ক্ষুধা লেগেছে,খেতে দাও,খেতে দাও।
কে শুনে কার কথা।রাহেলার এক কথা অয়নকে এখন খেতে দিবেনা।মায়ের আর কিবা করার আছে।চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।ছেলেক মিথ্যে শান্তনা দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

সবাই খেতে বসল।ফাতেমা তার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে পাকের ঘরের এক কোনায় বসে রইল।সবাইর খাওয়া শেষ হলো।এমন সময় শ্বাশুড়ি বলল,
ফাতেমা এবার তোমরা খেয়ে নাও।
ফাতেমা পাতিলে হাত দিয়ে দেখে যে ভাত তরকারী আছে তা একজনের ও হবেনা।কি আর করা নিজে না খেয়ে ছেলে দুটোকে খেতে দিলো।বড় ছেলে নয়ন,তার বয়স ছয় বছর।সে কিছু একটা বুঝতে পেরে বলল,
মা তুমি খাবেনা?
সত্য বললে নয়ন কস্ট পাবে।তাই সত্যটাকে লুকিয়ে দু:খটাকে বুকে চেপে রেখে বলল,
বাবা তোমরা খেয়ে নাও।আমি পরে খাব।
কেনো মা?
সে তোমরা বুঝবে না।
নয়নের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলো।সে পাতিলে হাত দিলো।কিন্তু সেকি,পাতিল খালী।ভাত নেই।এবার সে বুঝতে পারল।মা পরে খাবে কেনো বলেছে।

এমনিভাবে অনাহারে অর্ধাহারে কেটে চলেছে ফাতেমার জীবন।কোনবেলা পেটে দানাপানি পড়ে,কোনবেলা পড়েনা।ছেলেদের ক্ষেত্রে ও তাই।সবার খাওয়া শেষে যা থাকে তা ভাগ করে খেতে হয় প্রতিনিয়ত।
শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটে চলেছে ফাতেমার দিনকাল।কাউকে মুখ ফোটে কিছু বলতে পারছে না।প্রতিবাদ ও করতে পারছে না।সংসার ছেড়ে আসতে পারছে না।যদি চলে যায় বাচ্চা দুটোর কি হবে।কে দেখবে ওদের।এখন খেতে দিচ্ছেনা। না জানি তার অবর্তমানে কি করে?হয়তো মেরে ফেলবে।না না এসব আমি কি ভাবছি।আমি ওদের ছেড়ে কোথাও যাব না।যত বড় বিপদ আসুক।কপালে যা আছে তাই হবে।আমি শেষ লড়াই করে যাব।বাচ্চা দুটোকে পেলে কোত্থাও যাবনা।

ফাতেমার ননদ লাবনী তার স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে।অন্ধর মহল থেকে ডাক পড়েছে।ফাতেমাকে চা নাস্তা নিয়ে যেতে হবে।ফাতেমা আর দেরী করলো না।ছুটে গেল রান্নাঘরে।দ্রুতগতিতে চা নাস্তা বানিয়ে মেহমানের সামনে হাজির হলো।শ্বাশুড়ি চোখ রাঙিয়ে বলল,
দাঁড়িয়ে আছ কেনো?লতিফকে চা নাস্তা দাও।
এইতো মা দিচ্ছি।
লতিফের হাতে চা দিতে,সে ফাতেমার দিকে কেমন জানি বাঁকা চোখে তাকাল।দৃশ্যটা ফাতেমার ভালো লাগল না।কারণ লতিফ ভালো না,দু:চরিত্রা।কখন কি বলে বসে কে জানে।তাই সে কেটে পড়লো।তখনি লতিফ বলল,
ভাবী চলে যাচ্ছেন কেনো, বসেন।একটু গল্প করি।
না ভাই,এখন বসতে পারবো না।রান্নাঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে।

ফাতেমা রান্নায় মনোযোগ দিলো।আর তার ছোট জা পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে গল্প করছে।আর ফাতেমার উপর খবরদারি করছে।ভালোমতো রান্নাকরার জন্য তাগিদ দিচ্ছে।যাক ফাতেমা রান্না শেষ করে সবাইকে খাওয়ালেন।মেহমানের উপলক্ষে বাসায় মাছ মাংস পোলাও রান্না হয়েছে।ফাতেমার ইচ্ছা আজ ছেলে দুটোকে ভালো খাওয়াবে।কিন্তু সে কী তাদের জন্য আছে,কিছু ঝোল আর তরকারী।কি আর করা মা ছেলে খেয়ে নিলো।

তারপর ধোয়া মোছার কাজ শেষ করে ঘুমাতে গেল।বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে পড়েছে।ফাতেমার চোখে এখনো ঘুম আসেনি।সেলিমের কথা ভাবতে মনটা খারাপ হয়ে গেল।মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে।এমন সময় লাবনীর স্বামী লতিফ তার ঘরে প্রবেশ করলো।কোনকিছু না বলে,তার পাশে বসে পড়লো।ফাতেমা চমকে উঠে জড়োসড়ো হয়ে বলল,
দুলাভাই আপনি এতরাতে আমার ঘরে?
ভাবী আপনি একা মানুষ তাই ভাবলাম,একটু গল্প...।
প্লিজ ভাই এখন গল্প করার সময় না।আপনি যান। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
ভাবী কেউ দেখবে না। এত বছর হয়ে গেল।ভাইজান নেই।আপনি একা..।
তো কী হয়েছে?
না বলছিলাম কি,আপনিতো এখনো ইয়ং।এভাবে কি একা থাকা যাই।চাইলে আমরা দুজন কিছু সময়...।
লতিফ ভাই আপনি কি বলতে চেয়েছেন বুঝতে পেরেছি।ভবিষ্যতে এ ধরনের নোংরা কথা আর বলবেন না।কারণ এসব গুনার কাজ।তাছাড়া আমি একজনের স্ত্রী।
কী যে বলেন ভাবী।ভাইজান আর আসবে বলে মনে হয়না।সে মনে হয় আবার বিয়ে করেছে।
তা সময় হলে দেখা যাবে।আপনি এখন যান।
যাবতো।যাওয়ার আগে আসুন না,আমরা একটু...।
বলতে না বলতে সে তার গায়ে হাত দিলো।তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। ফাতেমা তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
"ডোন্ট টাচ্ মি" 
ভালো ভালো চলে যান।তানা হলে আমি চিৎকার করব।লাবনীকে সব বলে দেব।
কেউ আপনার  কথা বিশ্বাস করবে না।কারণ আমি বলব আপনি আমাকে আসতে বলেছেন।
বললেই হলো।

এদিকে লাবনী স্বামীকে কাছে না দেখে খুঁজতে শুরু করে।ভাবীর ঘরের কাছে আসতেই উচ্চ শব্দ কানে আসে।তারপর আঁড়িপেতে সব শুনে।দরজায় নক করে।ফাতেমা দরজা খুলে দেয়।স্বামীকে দেখে কড়া ভাষায় বলল,
তুমি এখানে কী করছ?
না মানে ভাবী আমাকে আসতে বলেছে।
বিশ্বাস কর লাবনী, আমি ওকে আসতে বলিনি।ওহ মিথ্যে বলছে।শুধু তাই নয় আমাকে বাজে কথা বলেছে।
ভাবী আর বলতে হবেনা।আমি আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।ওর বিচার আমি করছি।

লাবনী তার স্বামীকে টেনে হেঁছড়ে নিয়ে গেল।তারপর ইচ্ছেমতো শাসন করলো।এদিকে ফাতেমার জ্যা সত্যকে লুকিয়ে মিথ্যা বাক্য প্রকাশ করলো।সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে লাবনীর স্বামীর সাথে ফাতেমার সম্পর্ক আছে।ফাতেমা কল তলায় পানি আনতে গেলে তার দু:সম্পর্কের চাচী শ্বাশুড়ি মুখ ভ্যাংচি কেটে বলল,
ছিঃ ছিঃ বউ তুমি এমন আকাম কেমনে করলা?
কী কন চাচী আমি কী করেছি?
ন্যাকা সাজ,না কাল রাইতে লাবনীর স্বামীর..।
আমি আর কইবার পারুম না।
চাচী আপনাকে এসব কথা কে বলেছে?
কে আর কইবে,রাহেলা কইছে।
চাচী সব মিথ্যে কথা।
কী কও?ওযে কইল সব সত্যি।
জ্বি না চাচী সব মিথ্যে বানোয়াট গল্প।রাহেলা সবার চোখে আমাকে খারাপ বানানোর জন্য,এসব বলে বেড়াচ্ছে।
এমনিভাবে আর ও কয়েকজন ফাতেমাকে অপমান করলো।সে কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছেনা।প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।নীরবে নিভৃতে শুধু চোখের জল ফেলছে।শারীরিক ও মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছে।আর সইতে পারছে না।এক সময় সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে।গাঁয়ে খুব জ্বর।শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে।এখন তার সেবা যত্নের খুব প্রয়োজন।পরিবারের লোকজনের উচিৎ তার পাশে দাঁড়ানো।

কিন্তু তারা তা না করে  তার উপর আরো কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়।দেবর, জ্যা, দুজনে ছাপ ছাপ জানিয়ে দেয় ,কাজ না করলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে।শ্বাশুড়ি ও তা সাপোর্ট করে।
ফাতেমা কিন্তু স্বামীর ভিটা ছেড়ে যেতে রাজী না।যত কস্ট হোক।দুবেলা দুমুটো ভাত আর থাকতে দিলে হবে।এর চেয়ে বেশি  কিছু সে চাইনা।বিনিময়ে সবকাজ করে দেবে। বাধ্য হয়ে সে অসুস্থ শরীর নিয়ে  কাজ করতে যায়।কাজ করতে করতে এক সময় সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
তাকে একটা সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু চিকিৎসা খরচ কে দেবে?পরিবার থেকে কেউ এগিয়ে আসল না।সরকারীভাবে কিছু মেডিসিন দেয়া হয়।মোটামুটিভাবে আল্লাহর রহমতে সে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে।

এদিকে সেলিম লায়লা নামের এক মর্ডান আনকালচার্ড  নারীকে বিয়ে করে রাজার হালে দিন কাটাচ্ছে।একটিবারের জন্য বউ বাচ্চা এদের কথা ভাবছে না।তার কোন টেনশন নেই।তাকে দেখে মনে হয়না,তার জীবনে আর কেউ আছে।
 একটা পার্টিতে লায়লার সঙ্গে সেলিমের পরিচয় হয়।তারপর ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা,তারপর বিয়ে। লায়লা কিন্তু ভালো মেয়ে না।তার আর ও চারটা বিয়ে হয়েছে। সংসার বেশি দিন টিকেনা। কিছুদিন থাকার পর টাকা পয়সা আত্মসাৎ করে আরেজ জনের হাত ধরে।এটা হলো তার কালচার। অবশ্য কোন স্বামী তাকে ডিভোর্স দেয়না।সে নিজ থেকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।সেলিম কিন্তু এসবের কিছুই জানেনা। সে ভাবছে লায়লা ভালো মেয়ে।তাকে খুব ভালোবাসে।লায়লা  ও তার সঙ্গে এমন ভালোবাসাবাসি করছে।তাকে দেখে মনে হয়না,এতে ছলচাতুরী আছে।যাক ভালোই কাটছে তাদের দিনকাল। ছুটির দিনে সেলিম তাকে নিয়ে বিভিন্ন জাগায় ঘুরে বেড়ায়,দামী রেস্টুরেন্টে ডিনার করে।খুব হ্যাপি তারা।
আজ ও অনুরুপ বেরিয়েছে।মার্কেটে ডুকতেই তার সঙ্গে দেখা হলো,ছোটবেলার গ্রামের বন্ধু আবিরের সঙ্গে। আবির শহরে এসেছে তার মাকে নিয়ে।তিনি খুব অসুস্থ,স্ট্রোক করেছেন।তাকে হাসপাতালে রেখে সে ঔষধ কিনতে বেরিয়েছে।তখনি সেলিমের সঙ্গে দেখা।কিন্তু তার সঙ্গে একটা মহিলা,সে কে?
আবিরের প্রশ্ন করার আগে,সেলিম তাকে আঁড়ালে ডেকে নিয়ে গেল।দুবন্ধু কুশল বিনিময়ের পর্ব শেষ করলো।তারপর আবির মহিলাটির পরিচয় জানতে চাইলে,সেলিম বলল,
আমার স্ত্রী লায়লা।
সেলিম ভাই তুমি পারলে ফাতেমা ভাবীর মতো ভালো মানুষকে কস্ট দিতে।তাকে ফেলে রেখে আবার বিয়ে করতে।
হুম পারলাম।এতে দোষের কী দেখলে?
সেলিম ভাই, দোষ নয়তো কী?ভাবীকে খোরপোশ দিচ্ছনা।ছেলেদের দেখভাল করছনা।ভাবী কি কস্ট করছে জানিস।চাকরানী মতো পড়ে আছে তোদের সংসারে।অথচ সবাই তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে।ভালোমতো খেতে পরতে দিচ্ছেনা।আর তুই স্ত্রীর অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছিস।কিন্তু কেনো তার কি দোষ ছিল?
এখনো সময় আছে,ভাবীর কাছে ফিরে যা।ক্ষমা চাও।তার টেককেয়ার কর।তানা হলে  ইহকালে ও পরকালে অশান্তি ভোগ করবে।
আবির এত জ্ঞান দিসনাতো?আমার কাছে যা ভালো মনে হয় তাই করব।
তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।আমি জ্ঞান দেয়ার কে?
তবে সবশেষে একটা কথা বলছি।তুই বেশি কিছু না পারলেও মাসে মাসে ভাবীর জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিস।তারা অন্তত দুবেলা দুমুটো খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
 এত কথার পরে ও সেলিমের দিল নরম হলোনা।সে কোন কথার জবাব দিলোনা।আবির তার গন্তব্যস্থলে ফিরে এলো। কিছুদিন চিকিৎসার পর মাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসল।তারপর ফাতেমার কাছে সেলিমের সব খবর প্রকাশ করলো।পরিবারের একমাত্র ভালো মানুষ ফাতেমার শ্বশুর। ফাতেমাকে তিনি খুব স্নেহ করেন,ভালোবাসেন।এই জন্য সে কথাগুলো শ্বশুরের সাথে শেয়ার করলো।শ্বশুরের পরামর্শে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।সময়মতো তারা গন্তব্যস্থলে পৌছে গেল।কলিংবেল টিপতেই সেলিম দরজা খুলে দিলো।ফাতেমাকে দেখে সে খুশি হলোনা।কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ফাতেমাও থেমে নেই ভিতরে ঢুকে পড়লো।ভাগ্যিস লায়লা বাসায় নেই।সে পার্টিতে গেছে। 
আর এই সময়ে ফাতেমার আগমন।সেলিম কিন্তু মানতে  পারলো না।কিছু টাকা দিয়ে বলল,

ফাতেমা তুমি বাসায় ফিরে যাও।
কী বলছ,তুমি এখানে থাকবে।আর আমি বাসায় ফিরে যাব?
হ্যাঁ যাবে।এটা আমার অর্ডার।
না গেলে কী করবে?
গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
জানি সেলিম তুমি সবই পারবে।কারণ তুমি এখন মানুষের কাতারে নেই।অমানুষে পরিণত হয়ে গেছ।
আমার ভাবতেও অবাক লাগছে, কেমন করে একজন পুরুষ ভালোবাসার পথে অতটুকু বদলে যায়। আমাদের সাত বছরের সংসার একটু ও মায়া হলো না।ভুলে যেতে পারলে আমাকে?আমার কথা নাইবা ভাবলে,বাচ্চা দুটোর কথাতো ভাবতে পার।নাকি সেটাও ভুল।
সেটা পরে দেখা যাবে।
পরে কেনো?
সে কৈফিয়ত কী তোমাকে দিতে হবে?
হুম হবে।কারণ আমি তোমার স্ত্রী।
ফাতেমা তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছ।লায়লা আসার সময় হয়েছে।
তার মানে তুমি লায়লার ভয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছ?তুমি বিয়ে করেছ,এতে আমার কোন অভিযোগ নেই।দুজনের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন কর।
আমি পারব না।
পারতে তোমাকে হবে।কারণ আমিও তোমার স্ত্রী।
এত প্যাঁচাল না করে বাসায় ফিরে যাও।
আমি যেতে আসেনি।থাকতে এসেছি।
তারা আর ও কিছু সময় কথা কাটাকাটি করে।কিন্তু কোন সমাধান হয়না।সেলিম ফাতেমাকে রাখতে রাজী হয়না।খুব মারধর করে বের করে দেয়।এমন সময় লায়লা বাসায় ফিরে আসে।ফাতেমাকে দেখে বলল,
সেলিম এরা কারা?

না মানে ইয়ে...।
ইয়ে ইয়ে করছ কেনো?বলো এরা কারা?
না মানে বলছিলাম কি,ওহ আমার খালাতো বোন।ঢাকায় এসেছে।তাই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।এক্ষণি চলে যাবে।এই তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেনো? যাও

কি লজ্জার কথা বউকে বলে বোন।এত বড় একটা সত্যকে গোপন করলো সেলিম। এত দু:খ রাখবে কোথায় ফাতেমা।অমানুষটা এত রাতে ফাতেমাকে বের করে দিলো।একটা রাত ও থাকতে দিলোনা।চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে ফাতেমার।বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।সেলিম এতট বদলে গেলো।আমাকে পর করে দিলো।লায়লাকে আপন করে নিলো।লায়লাকি সত্যি তাকে ভালোবাসে নাকি ছলনা?তাকে দেখেতো ভালো মনে হচ্ছে না।বাচ্চা দুটো কেঁদে কেঁদে বলে,
মা চলো ফিরে যাই।এখানে থাকলে বাবা আবার তোমাকে মারবে। 
কি আর করা ফাতেমা নাইটের গাড়িতে রওয়ানা করলো।তাকে ফিরে আসতে দেখে রাহেলার গাঁ জ্বালা করে উঠল।শ্বাশুড়িকে কানপড়া দেয়া শুরু করলো।ফাতেমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পরামর্শ দিলো।শ্বাশুড়ি তা সাপোর্ট করলো।এবং ফাতেমাকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো।এক প্রকার জোর করে তাকে বের করে দিতে চাইছে।তখনি শ্বশুর আব্দুল মোতালেব মিয়া বলল,
স্টপ থাম অনেক হয়েছে।ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
কোথায় আবার,বের করে দিচ্ছি।
কেনো?
বাবা আমরা উনাদেরকে খাওয়াতে পারবনা।ভাইজান কোন টাকা দিচ্ছেনা। তাকে খাওয়াবে কে?
রিজিকের মালীক একমাত্র আল্লাহ।তোমাকে খাওয়াতে হবেনা।আল্লাহ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন।তাছাড়া আমি যতদিন জীবিত আছি বড় বউ মা এ বাড়িতে থাকবে।এই নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করোনা।করলে হিতে বিপরীত হবে।বউ মা মন খারাপ করোনা। ভিতরে যাও।

শ্বশুরের কড়া ধমকে রাহেলা একটু থামল। কিন্তু মন থেকে জিলাপির প্যাঁচা গেলোনা।রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা ফাতেমার পেছনে লেগে থাকে।একটার পর একটা কাজের ফরমায়েশ দিয়ে চলেছে।ফাতেমা ও নাছোড় বান্দা সবকাজ করে দিচ্ছে।কোন প্রতিবাদ করছে না।প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে,
হে পরওয়ার দেগার,আমি পাপী বান্দার সকল দোয়া কবুল করে নাও।আমার স্বামীকে হেদায়েত দান করুন।ভালো পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন।ঐ ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করুন।আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।আমার স্বামী ভুল পথে হাটছে।তাকে সঠিক পথ দান করুন।তার মনে আমার প্রতি গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি করুন,আমিন।
ফাতেমা ফিরে এসেছে শুনে তার চাচাতো জ্যা এসে বলল,
ভাবী তুমি এতকিছু কিভাবে সহ্য কর বুঝি না।
কী করব ভাবী সহ্য না করে কি উপায় আছে?
আছে ভাবী অনেক উপায় আছে।
ভাবী বলেন কী উপায়?
ভাবী আমি বলি কি,আপনি মামলা করেন।পুলিশের মার খাইলে সেলিম ভাই ঠিক হয়ে যাবে।আপনার কাছে ফিরে আসবে।
না ভাবী,তা কখনো হবেনা।কারণ জোর করে, সংগ্রাম করে,মামলা করে, কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায়না।ভালোবাসা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়।এ ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি চলেনা।আল্লাহ যদি কখনো তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয় তবে সে আসবে।এর ব্যতিরেকে নয়।
ভাবী তুমি যে কি,মনে হয় মানুষ না, ফেরেশতা।তোমার কথা যত শুনি মুগ্ধ হয়।আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক।

এরফাঁকে কেটে গেল আরো তিন বছর।সেলিমের দ্বিতীয় স্ত্রী লায়লা টাকা পয়সা আত্মসাৎ করে আরেকজনের হাত ধরে পালিয়ে গেছে।শুধু কি তাই সেলিমকে ডিভোর্স দিয়ে দেনমোহরের টাকার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করেছে।বর্তমানে সরকার একটা নিয়ম চালু করেছে,স্ত্রীর পক্ষ থেকে ডিভোর্স হলেও স্বামীকে দেন মোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে।পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাই।দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে সেলিম পুলিশের হাত থেকে রেহাই পায়।অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়ে।নিজের ভুল বুঝতে পারে।ছুটে আসে ফাতেমার কাছে।এসে দেখে সে কল তলায় এক গাদা কাপড় ধুচ্ছে।শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি জমেছে।চেহারায় ফ্যাকাসে ভাব,তাকে চেনার উপায় নেই।বউকে এই অবস্থায় দেখে তার মন খারাপ হয়ে গেলো।সে করুণ স্বরে বলল,

ফাতেমা কেমন আছ?
ওগো তুমি এসেছ?
হুম এসেছি।আর তোমাকে কস্ট করতে হবেনা।আজ থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব।
সত্যি বলছ?
হুম সত্যি।
ফাতেমা আমি অনেক অন্যায় করেছি,ভুল করেছি,তোমাকে মারধর করেছি।আমাকে মাফ করে দাও।
সেলিম তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ,এটাই যথেষ্ট। তোমার উপর আমার আর কোন রাগ নেই।
সত্যি তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?
হুম করেছি।কারণ ক্ষমা হলো মহত্ত্বের লক্ষণ।
ফাতেমা তাহলে একটা শফথ হয়ে যাক।
আমি আমার "আদর্শ বউয়ের" হাতে হাত রেখে শফথ করিতেছি যে,আমি আর কখনো ভুল পথে পা বাড়াব না।তোমাকে কস্ট দেবনা।ভুল বুঝব না।শুধু তোমাকে  ভালোবাসব।পররনারীর দিকে তাকাব না।মৃত্যু পর্যন্ত দুজন এক সঙ্গে থাকব।সত্য ও সঠিক পথে চলবো।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো, ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তোমার প্রার্থনা কবুল করুক,আমিন।
সকল ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে তারা আবার সংসার জীবন শুরু করলো।

(আদর্শ বউ ।। আফছানা খানম অথৈ )

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।