আজ থেকে শতবর্ষ আগে কাজি নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট ও পরাধীন ভারতবর্ষে তার প্রভাব নিয়ে কম আলোচনা করা হয়েছে। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ের বাংলা সাহিত্যে,সংগীতে সর্বাপেক্ষা আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবি,গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, প্রাবন্ধিক নজরুল সম্পর্কে সকলেই কমবেশি জানেন ।তবে 'বিদ্রোহী'র মত জনমানস আলোড়নকারী কবিতার লেখক, দেশপ্রেমিক, সাংবাদিক নজরুল সম্পর্কে কমই চর্চা হয়েছে। পল্টন ফেরত সৈনিক নজরুল সে সময়ের ঘটনাক্রম, তুরস্কে কামালপাশার উত্থান বা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট আন্দোলিত হতেন । কামালপাশাকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি কবিতা লিখলেন, 'ঐ খেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই/অসুরপুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল,সামাল তাই'। কিন্তু সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়1922 সালের 6ই জানুয়ারির প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতায় মহাপ্রতিভাধর কবি নজরুল ব্রিটিশ শাসককে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানালেন। কবিতায় লিখলেন, 'মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে,রাজ রাজ-টীকা দীপ্ত জয়শ্রীর/বল বীর--/আমি চির উন্নত শির'। বিদ্রোহের তেজ তীব্রতর করতে লিখলেন, 'আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ'। অধিনতা না মানার শেষ কথা লিখলেন, আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন..'। সজনীকান্ত দাস ইত্যাদি ক'জন ঈর্ষাপীড়িত সমালোচক ছাড়া এ কবিতা বাংলার ঘরে ঘরে সমাদৃত হল,স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে দারুণ উৎসাহ জোগালো।আপ্লুত হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সাহিত্যিক এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। সাধারণ ধারণা আছে যে "বিদ্রোহী" কবিতা লেখার জন্য তিনি কারারূদ্ধ হন। নিশ্চয়ই সেটি অন্যতম কারন কিন্তু তারও আগে ও পরে নজরুলের বিপ্লবাত্বক লেখায় সন্ত্রস্ত হয়ে শাসক ইংরেজ তাকে কারারুদ্ধ করে।12ই জুলাই 1920 সালে প্রতিষ্ঠিত, মুজাফফর আহমেদের সাথে যৌথ সম্পাদনায় 'সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ' পত্রিকায় জ্বালাময়ী সম্পাদকীয়তে তিনি দেশবাসীর সম্মানের সাথে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার দাবী করতে থাকেন। এর মধ্যে একুশটি সম্পাদকীয় নিয়ে 1922 সালে যুগবাণী নামে বই প্রকাশিত হয়, এই বইটি রাজরোষের কারন হয়।
1921 সালে নজরুল শান্তিনিকেতন যান রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ নিতে। বিশ্বকবি,'কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন', তাঁর ইপ্সিত কবিকে পেয়ে গেলেন।এই স্নেহের বন্ধন কবিগুরুর মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল। 1922 সালের 11 ই আগষ্ট কাজি নজরুল নিজের সম্পাদনায় 'ধুমকেতু' পত্রিকা বের করেন, যাতে দেশবাসীর মনের কথা স্পষ্টভাবে নিজের কলমে তুলে ধরতেন।ধুমকেতুর সম্পাদকীয়তে তিনি লিখলেন, 'সর্বপ্রথমে ভারতবাসী পুর্ণ স্বাধীনতা চায়'। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল এই পত্রিকা। প্রতিটি 'ধুমকেতু' পত্রিকার মাথায় লেখা থাকত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাণী,''কাজি নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েসু,
আয় চলে আয়রে ধুমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন''। 26 শে সেপ্টেম্বর 1922 সালে ধুমকেতু পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় বিপ্লবাত্বক,' আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা সম্পাদকীয় হিসাবে প্রকাশিত হলে রাজরোষে পড়ে। 8 ই নভেম্বর 1922 ঐ সংখ্যাটি নিষিদ্ধ হয়। 23 শে নভেম্বর 1922 সাল, তার যুগবাণী বইটি নিষিদ্ধ হল। ঐ দিনই কুমিল্লা শহরে কংগ্রেস এর মিছিলের মধ্য থেকে তাকে বন্দী করে কোলকাতার জেলে আনা হয়। 7ই জানুয়ারি 1923 সালে বিচারপতিকে লেখা তার চিঠিটি 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' নামে ধুমকেতু পত্রিকার শেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, তার শেষ লাইনগুলি ছিল,.......'আমার হাতের ধুমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...........'।
শিখা সেনগুপ্ত
64, আদর্শপল্লী, বিরাটি
কোলকাতা--700051।