বিজয়, এই বিজয়, তুই এখনো তৈরি হোস নি? দেরি হয়ে যাবে যে স্যারের বাসায় যেতে। সাজু কথাগুলো বলতে বলতে বিজয়দের বাড়িতে ঢুকলো। বিজয় বলল, ওহ্ তোকে তো বলতে ভুলে গেছি। আজ ৭ই মার্চ না? জ্যাঠার সাথে আমাকে রমনা পার্কে যেতে হবে। তোরা তো জানিস, প্রতিবছর মার্চ মাস আসলে জ্যাঠার মানসিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। তখন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ চলে। কিন্তু ৭ই মার্চ উনাকে ঘরে আটকে রাখা সম্ভব হয়না। সাজু বলল, আচ্ছা তাহলে তো তুই যেতে পারবি না। রাস্তায় জাহেদ আর পিন্টুও দাঁড়িয়ে আছে একসাথে যাবে বলে। বিজয় বলল, তোরা চলে যা, আমি তোদের থেকে পড়া বিকালে তুলে নেব। আজ তো আবার স্কুলে অনুষ্ঠানও আছে। আমি জ্যাঠার সাথে কিছুক্ষণ ওখানে থেকে তারপর স্কুলে চলে যাব। সাজু বলল, তবে একটা কাজ করি, চল, আমরা সবাই জ্যাঠার সাথে যাই। স্যারকে ফোন করে বলে দেব আমরা আজকে না এসে কাল পড়তে যাব। বিজয় বলল, তাহলে তো ভালো হয়।
ওরা নবম শ্রেণীতে পড়ে। বিজয়ের জ্যাঠা কিশোর থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছিলেন। যুদ্ধও করেছেন। নিজের চোখে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন। কোনদিন তিনি ভুলতে পারেননি সেই দিনগুলোর কথা। জীবনে সংসারও করেননি। তারপর '৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি ধীরে ধীরে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। যুদ্ধের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো দেশ এখনো হায়েনামুক্ত হতে পারল না এটাই তার মনে সারাক্ষণ তোলপাড় করে। প্রতিবছর মার্চ মাস আসলে তার পাগলামি বেড়ে যায়। এমনিতে সারাক্ষণ নিজের ঘরে লেখালেখি করেন, বিভিন্ন বই পড়েন, তেমন কারো সাথে কথা বলেন না, নিজে নিজে বিড়বিড় করেন।
বিজয়, সাজু, জাহেদ আর পিন্টু জ্যাঠাকে নিয়ে রমনা পার্কে আসল। এই সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। যেখানে '৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সকল বাঙালি একত্রিত হয়ে তাঁর ভাষণ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে পাকহানাদার মুক্ত করেছিল। কিন্তু '৭৫ এর ১৫ই আগস্ট সেই জাতির পিতাকে পরিবারসহ হত্যা করে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়। তারপরও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সফলতার দিকে এগিয়ে গেলেও এখনো সম্পূর্ণভাবে সোনার বাংলায় পরিণত হতে পারেনি।
জ্যাঠা বঙ্গবন্ধু যেখানে দাঁড়িয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন সেই জায়গাটা একবার ঘুরে ফিরে দেখলেন। তারপর নিজে নিজে বলতে শুরু করলেন, এই তো, এখানে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গায়, বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, "রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" হে জাতির পিতা, তুমি তো বলেছিলে, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। পারেও নি। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু সে স্বাধীন দেশে কেন ঘাতকরা তোমায় বাঁচতে দিলো না? কেন আজ এতো অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি, হিংসা, স্বার্থপরতা, নেই আন্তরিকতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান। বিপদে এগিয়ে না এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা। কেন? কেন? কেন? উত্তর দাও? জ্যাঠা বলতে বলতে কাঁপতে লাগলো। ওরা জ্যাঠাকে শান্ত করে এক জায়গায় বসালো। বিজয়ের এগুলো প্রতিবছর দেখা হয়। কিন্তু ওর বন্ধুরা জ্যাঠার কথাগুলো অবাক হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। উনি সব যুক্তির কথায় তো বলছেন।তবে বিজয় কেন বললো উনার মানসিক সমস্যা আছে। জ্যাঠা স্থির হয়ে বসলো না। আবার উঠে দাঁড়ালো। হাত নাড়িয়ে বলল, হে বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা, তুমি কি এই সোনার বাংলা চেয়েছিলে? তোমার সোনার বাংলায় আজ মাদকের ছড়াছড়ি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজ, ধর্ষণ। সব দেখেও তুমি কেন চুপ বল? কিশোররা বই ছেড়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে সব অরাজকতা চলছে। তুমি তো বীরঙ্গনাদের বলেছিলে তারা তোমার সন্তান। এখন দেখো, এই স্বাধীন বাংলায় কতো নারী ধর্ষিতা হচ্ছে, সমাজ তাদের কলঙ্কিত করছে। তুমি বলেছিলে, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে। আমরা তো তখন সবাই মিলে সবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি। কিন্তু এখন কেন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবে। কেন? কেন? কেন? কোথায় তোমার সেই বজ্র কন্ঠ? বলতে বলতে জ্যাঠা বসে পড়লো। বিজয় আর তার বন্ধুরা জ্যাঠাকে বলল জ্যাঠা, তুমি আর দুঃখ পেয়ো না। আমরা এই দেশে আর অন্যায় হতে দেব না। জাহেদ বলল, হ্যাঁ, আমরা আগামী প্রজন্ম যারা অনেকেই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন কিছু জানিনা। আপনারা কিভাবে এই দেশকে হায়েনামুক্ত করেছেন তার সম্পর্কে হয়তো বইতে কিছুটা পড়েছি। কিন্তু আজ আপনার যেই আকুতি দেখলাম, তাতে আমাদের মনেও দেশের প্রতি একটা কর্তব্যবোধ তৈরি হয়েছে। পিন্টু বলল, ঠিক তাই। আজ থেকে আমরা যেখানে অন্যায় দেখবো সেখানে প্রতিবাদ করবো। বিজয় বলল, আসলে আমরা জ্যাঠাকে অনেক বছর ধরে দেখছি। যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। চলো জ্যাঠা, এবার বাড়ি চলো। আমরা জাতির পিতার সোনার বাংলায় যতটুকু পারি পরের জন্য কাজ করবো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বো। সবার মাঝে একতা সৃষ্টি করবো। জ্যাঠা উঠে দাঁড়ালো, তারপর ওদের সকলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, পেয়েছি, পেয়েছি, সেই বজ্রকণ্ঠ শুনতে পেয়েছি। বলতে বলতে সেখান থেকে বের হয়ে এলো।