ফিরে এসেছে বাঙালির প্রাণের বৈশাখ ।। মো. সাজ্জাদ হোসেন


বঙ্গদেশের বাংলা ভাষা ভাষী আমরা সবাই বাঙালি। ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন-“ আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য,তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়,এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো-টি নেই।” 

বাঙালির হৃদয়ের আবেগ,অনুভূতির সাথে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার সংস্কৃতি। আমাদের শিল্পসাহিত্য আচার-আচরণ বেশভূষায় পুরোপুরি মিশে রয়েছে বাংলার সংস্কৃতি। নিজস্ব সংস্কৃতিতে আমরা সমৃদ্ধ। বাঙালি জন্মলগ্ন থেকেই নিজস্ব সংস্কৃতিতে স্ব-নির্ভর। মুঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীর সহযোগীতায় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। যদিও এটি সম্রাট আকবরের রাজ সিংহাসনের দায়িত্ব গ্রহণ ১৫৫৬ সাল থেকে ধরা হয়।  কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়। সৌরভিত্তিক সনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেই সময়ে প্রচলিত সন ছিল ‘হিজরী সন। যা চন্দ্রসন হওয়ার কারণে প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় করা সম্ভব হতো না। খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করার জন্য সৌরভিত্তিক সন গণনা শুরু হয়। নাক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের নামকরণ করা হয়। ৭৮ খিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শাকাব্দ থেকে বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়। ১. বিশাখা থেকে বৈশাখ ২.জাইষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য ৩.আষাঢ়া থেকে আষাঢ় ৪.শ্রাবনা থেকে শ্রাবণ ৫.ভাদ্রপাদা থেকে ভাদ্র ৬.আশ্বিনী থেকে আশ্বিন ৭.কৃতিকা থেকে কার্তিক ৮. পুস্যা থেকে পৌষ ৯.আগ্রৈহনী থেকে অগ্রহায়ণ ১০. মাঘা থেকে মাঘ ১১.ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন ১২.চিত্রা থেকে চৈত্র।

বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষ শত,সহস্র বছর ধরে একসাথে বসবাস করে আসছে। পোশাক পরিচ্ছদ,খাবার সবকিছুতে বাঙালির নিজস্বতা রয়েছে। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানে সবার অংশগ্রহণ বাঙালির চিরাচরিত নিয়ম। 

১ লা বৈশাখ আমাদের অস্তিত্ব,আমাদের প্রাণের ঠিকানা। পান্তা,ইলিশ,ভর্তা,পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ সবকিছুর সমন্বয়ে নিজস্ব খাবারের গন্ধ ও স্বাদ বাঙালিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে। গামছা,লুঙ্গি,ফতুয়া,মেয়েদের হলুদ শাড়ি। ঢাক ঢোল,একতারা,দোতারা মিষ্টি বাঁশির সুর মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েছি তাই  মানব জনম আমার স্বার্থক। চৈত্রকে বিদায় জানিয়ে শুভ হালখাতার মাধ্যমে ক্রেতা বিক্রেতার নতুন বছর শুরু। এ যেন এক মিলন মেলা। বৈশাখী মেলা,জারিগান,সারিগান,ভাঁটিয়ালি,ভাওয়াইয়া,যাত্রপালা দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি কাবাডি,গোল্লাছুটের মত দেশীয় খেলার আয়োজন বাঙালির অতীত ঐতিহ্য। বৈশাখী মেলায় শিশু কিশোরদের হৈ-হুল্লোড়, বৃদ্ধ,তরুণ,তরুণীর ঘোরাঘুরি,লোকজ সংগীতের আয়োজনে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণে অসাধারণ মিলনমেলা। দূর দূরান্ত থেকে সকল মানুষ একসাথে মিলিত হতে পারে বৈশাখী মেলায়। ধর্ম,বর্ণ,ধনী গরীবের ভেদাভেদ এখানে থাকেনা। এক সার্বজনীন উৎসব। তবুও এক শ্রেণির ধর্মান্ধ ব্যক্তি,যারা ধর্মীয় উগ্রবাদে বিশ্বাসী তারা ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ১ লা বৈশাখকে বিতর্কিত করার চেষ্টা অতীতে করেছে এখনও করে যাচ্ছে। বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বিতর্কিত করা হচ্ছে। বাঙালি ধর্ম ভীরু,ধর্মীয় রীতিনীতিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উৎসব আয়োজনে বাঙালির জুড়ি নেই। দেশীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি সকল উৎসব আয়োজনে বাঙালির সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। উৎসব আয়োজনে বাঙালি কখনও কার্পণ্য করেনা। ভিন্ন আবহে বৈশাখ আমাদের মাঝে এসেছে। করোনা মহামারির পর মাহে রমজানের পবিত্র মাসে ১ লা বৈশাখ ফিরে এসেছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সিয়াম সাধনার কারণে সকালে হয়তবা পান্তা ইলিশের আয়োজন থাকবে না। তাতে কি হয়েছে মাছে ভাতে বাঙালির ঘরে ইলিশ থাকবে না সেটা কি করে হয়। বৈশাখ বাঙালির অস্তিত্বে,শিরা উপশিরায়। মধ্য রমজানে ১ লা বৈশাখ। আগামী বছর আবার রমজান মাসেই ১ লা বৈশাখ আসবে। এরপরে হয়তবা আসবেনা। অনেক বছর পরে আসবে। মধ্য বয়সী অনেক মানুষের ১ লা বৈশাখ এবং রমজান একসাথে দেখার সুযোগ হয়তবা হবেনা। বৈশাখ মাসে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ঈদুল ফিতর  উদযাপিত হবে। এটি একটি বড় আনন্দের বিষয়। বৈশাখ মাসে ঈদুল ফিতর  উদযাপন দাদা দাদীর মুখে শুনেছি। আমাদের এই জেনারেশানের দেখার সুযোগ হয়নি। সুযোগ আসবে এটাও অনিশ্চিত। আমাদের প্রাণের বৈশাখ আবার ফিরে এসেছে এ ধরণীতে। উৎসবের আমেজে মেতে উঠব সবাই সহনশীল হয়ে। 

পানতা ইলিশ আর ভরতা ভাজি,বাঙালির প্রাণ,নতুন বছরে সবাই গাইবো বৈশাখের গান। এসো হে বৈশাখ এসো এসো। শুভ নববর্ষ।

প্রভাষক, লাউরফতেহ্পুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ

নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।