১
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো বলেই গেছেন আঁধারেরও এক অনির্বচনীয় অনাস্বাদিত রূপ আছে। সে রূপের কাছে পৃথিবীর অনেক রূপই তুচ্ছ।
শরৎচন্দ্রের বর্ণিত সেই রূপে প্রভাবিত হয়ে নয়। বাল্যকাল থেকে আঁধারের মধ্যে আমিও এক ধরণের রূপ দেখতে পাই।সেরূপ সাম্যবাদী।পৃথিবীর সকল রূপের বৈচিত্র্য এক আঁধারের মাঝেই বিলীন হয়ে যায়। যেখানে সপ্তবর্ণের সবকিছুকে গ্রাস করে একমাত্র আঁধার কালোই রাজত্ব করে।
চাঁদনী রাতে দূরে কোথাও কলার পাতাকে বাতাসে নড়তে দেখে পেত্নীর ধারণা মনে ভীতি সঞ্চার করতে পারে কিন্তু আঁধার রাতে সে সম্ভাবনা নেই।আঁধারে হাঁটতে হাঁটতে আমি নিজেও উপলব্ধি করেছি যেন আমি আঁধারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।আমি আঁধারের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছি।জগতের সকল শরীরী অশরীরী একধারায় এসে মিলিত হয়েছে। আঁধারের মাঝে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবার কোন সুযোগ নেই। তবে শ্যাওড়া বনে বা বাঁশ বনে নিকষকালো আঁধারের মাঝে ক্ষুদ্র জোনাকিগুলো বড় উজ্জ্বল দেখায়।হয়তো রঙের বৈপরীত্যের কারণেই রঙের জৌলুশ। অনেকটা সেই প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। মেঘদল গভীর কালো বলেই কি বক এত সাদা না কী বক অতি শুভ্র বলেই মেঘ তেমন নিকষকালো।
যা হোক আঁধারের সাথে বাল্যকাল থেকে এমন গলায় গলায় পিরিতের ফলে আমার মনে কখনও ভয় ঢুকতে পারে নি। ভাবতাম আঁধার কেবল কালো নয়, ভয়ও কালো।তাই কালো কালোয় মিশে যায়।
কিন্তু মানুষের কল্পনায় আবিষ্কার করা সমীকরণ সব সময়ই যে নির্ভুল তা হয় না। আমি জীবনে কোন এক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত, এবং অকল্পনীয় ঘটনার সম্মুখীন হয়ে আমাকে নতুন করে ভাবতে হয়েছে।
বাড়ি থেকে বহুদূর যাত্রাপালা দেখতে যাব। এমন সুখকর প্রদর্শনীতেও যে সঙ্গী মিলবে না তা আমি ভাবতেই পারি নি।তবু যাত্রাপালা বলে কথা। দেখতে তো যেতেই হবে।
সন্ধ্যার পর শীতের কাপড় গায়ে জড়িয়ে রওনা হলাম। বাড়ি থেকে মাইল দেড়েক যেতেই কৃষ্ণ পক্ষের আঁধার প্রকৃতির উপর তার চাদর বিছিয়ে দেয়া শুরু করল। ক্রমশঃ অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমিও নিঃসংশয়ে আঁধারের সাথে মিশে যাচ্ছি। আঁধারকে এই একাকী পথযাত্রায় বড় আপন মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে আঁধার পৃথিবীর বুক চিরে আমি এক যাত্রা পাগল চলেছি উদ্যামের পাখায় চড়ে।নিজের অস্তিত্বটুকু আঁধারের সাথে মিশে গেছে।নিজের ভিন্ন কোন সত্তার অধিকার আমি বিস্মৃত হয়েছি।আমার ডানে বায়ে সামনে পিছনে গন্ধহীন ছোপ ছোপ অন্ধকার আমার সাথে সাথে চলছে মুখে গদাই শিংয়ের জারি গেয়ে গেয়ে। সম্মুখে কোন বাধার কল্পনা নেই, মনে কোন ভীতি নেই।সুরহীন কণ্ঠে উচ্চস্বরে গান গাওয়াতে কোন সংকোচ নেই।
পৌষের শেষে বাদিয়াখালির এই জায়গাটায় হাঁটু পানি থাকে। বামে বিশাল ঝাউবন।বাতাসবিহীন কুয়াশাসিক্ত ঝাউবনে শন্ শন্ শব্দ হচ্ছে। মনে এক রকম অদ্ভূত ইচ্ছে জাগলো। মনে হল এই বালির স্তুপের উপর মরা কাশগুচ্ছ টেনে একটু না হয় বসি। ঝাউপাতার গায়ে বাতাস কেমন মোলায়েম স্পর্শ দিয়ে মন মাতানো সঙ্গীতের সুর তুলেছে।সমস্ত হৃদয় মন হরণ করে। মনে হচ্ছে একটু বসে এই অশ্রুতপূর্ব সঙ্গীতে আঁধারের বুকের ভাষা শুনি।
বামে ঝাউবন যেখানে বাদয়াখালির জল স্পর্শ করেছে সেখানে চাড়ালদের শ্মশান। মাঝে মাঝেই সেখানে শবদাহ করা হয়। শ্মশান সম্পর্কে মানুষের মনে অকারণ ভীতি আছে। আছে নানা প্রকার অবাস্তব, অবান্তর গালগপ্পো। তার উপর আবার নিচুজাতের চাড়ালদের শ্মশান।
আমি বসে আছি। আঁধার আমার একাকীত্বের সাথী।আর সাথী আমার ঝাউবনের শীতসিক্ত করুন কন্ঠের গান।খুবই মধুর লাগছে।আমি সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আঁধার সুন্দরীর বুকে যেন একচ্ছত্র কাল্পনিক উমের ঈষৎ উষ্ণতা পাচ্ছি।
এই অবর্ণনীয় সঙ্গীত সুধা হয়তো আরও কিছুক্ষণ সেবন করতাম কিন্তু হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে আমার আনন্দে ছেদ পড়ল। দক্ষিণ দিক থেকে একটা উত্তপ্ত দমকা বাতাস এলো। বাতাসের সাথে খানিকটা বালির ঝাপটা আর বাদুড় পোড়ালে যেমন একধরনের উৎকট গন্ধ আসে তেমনি একধরনের অসহনীয় গন্ধ।
আমি এটা স্বাভাবিকই মনে করলাম।এমন ধূলোর ঝাপটা তো আসতেই পারে। এসব নিয়ে আভাবনা কুভাবনা আমার মনেও উঁকি দেয় নি।আমি নির্বিকার বসে আছি।
এবার উঠব উঠব ভাবছি। ঠিক এমন সময় আবার সেই দমকা বাতাস।এবার ঝাপটার সাথে মনে হল কজনে একত্রে আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে উত্তর দিকে। ভাবছি বাতাসের তীব্র গতিতে হয়ত এমনটি হচ্ছে। আমি পতিত অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এখন আর কোন বাতাস নেই,গন্ধ নেই।
কিন্তু ঘটনাটি আমাকে ভাবাচ্ছে। এই পৌষ মাসের শীতের রাতে এমন দমকা বাতাস তো স্বাভাবিক নয়। না হয় হল স্বাভাবিক কিন্তু আমাকে যে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিল সেটা কী? আমি তো স্পষ্ট ঠাহর করতে পারলাম যে আমাকে কজনে ঠেলে ফেলে দিল।
এখান থেকে যাত্রার প্যান্ডেল পর্যন্ত পৌঁছতে বড়জোর ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। রাত বারোটার আগে তো যাত্রা পালা শুরু হবে না। তাই আবার বালিস্তূপের উপর বসে পড়লাম। বসে পকেট থেকে কিংস্টর্ক সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করলাম।অন্ধকারে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেটটা অধরোষ্ঠে চেপে দেশলাই জ্বালানোর উদ্যোগ নিচ্ছি অকস্মাৎ আমার মুখথেকে সিগারেট এবং হাত থেকে দেশলাই উধাও হয়ে গেল। আমি টের পেলাম কোন একটা হাতের কারসাজিতে ওগুলো আমার বেদখল হয়ে গেল।ঘন অন্ধকারে আমি কিছু দেখতেও পাচ্ছি না।
আমি কিছুতেই ঘটনার কারণ খোঁজে পাচ্ছি না। কেবলই ভাবছি এমনটা কী করে হতে পারে।বহুদিন বহুরাত এই রাস্তায় বাল্যকাল থেকেই চলছি ফিরছি। কই কোনদিন তো এমন তাজ্জব ব্যাপার ঘটেনি। নানা রকম ভাবনা মাথায় চেপে বসেছে।মনে মনে ভাবছি এবার উঠে পড়ি।
২
উঠতে গিয়ে আরেক চমকের সম্মুখীন হলাম। আমি উঠতে চেষ্টা করছি কিন্তু উঠতে পাচ্ছি না। আমার কটির নিম্নদেশ সম্পূর্ণ অবশ।আমি উঠার মত শক্তি পাচ্ছি না। কে কে যেন আমাকে উপর থেকেও ঠেসে ধরছে।গায়ের শক্তিসমূহ আমার সাথে বিরূপ আচরণ করছে।তবু আমি উঠার প্রাণান্ত চেষ্টা করছি।
পশ্চিম দিকে অদূরে সমবেত কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের হাসি শুনতে পেলাম।সে হাসি কোন মানব কণ্ঠের নয়।দানবিক হাসি কী না জানি না তবে প্যাঁচপ্যাচে বিরক্তিকর কণ্ঠ।
অনেক চেষ্টা করে আমি দাঁড়াতে সক্ষম হলাম কিন্তু আমার চলার গতি যেন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই।ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিম্ভূতকিমাকার কিছু দেখতে পেলে হয়ত মনে ভয়ের সঞ্চার হত। আঁধারের মাঝে আপন অস্তিত্বকে একাকার করে দিয়ে ভয় থেকে দূরে রয়েছি।
এবার আমি হাঁটতে চেষ্টা করলাম দক্ষিণ দিকে।যেহেতু আমার গন্তব্য সেদিকেই। আমাকে যাত্রাপালা দেখতে হবে।বন্দনার আগে কনসার্ট না শুনতে পারলে যাত্রা বিস্বাদ লাগে। আমি তাই ত্রস্তে পা চালাতে চেষ্টা করছি এবং আমার মত আমি সামনের দিকেই চলছি। আমি যে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছি সেটা তখন বুঝলাম যখন সামনের রাস্তা সম্পর্কে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি বলে স্পট হল। আমি যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছি না।অদৃশ্য কেউ আমার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করছে।
কে একজন পেছন থেকে বলছে, এবার ভিতরে ঢুকাও।সেই বিকৃত বিরক্তিকর কণ্ঠ। কোথায় ঢোকাবে আমি তার বিন্দু বিসর্গ ও মালুম করতে পাচ্ছি না। তবে পায়ের নিচে ঠাহর করতে পাচ্ছি কোন এক কঙ্করময় জায়গা এটা।পায়ের সাথে ইট পাটকেল লেগে ব্যথা পাচ্ছি।
এখানে অন্ধকারটা আরও ঘন,আরও গভীর।চারপাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে তবে তা মানুষের অস্তিত্ব বলে বোধ হচ্ছে না। মানুষের অস্তিত্ব থাকলে পরস্পর কথা কথা হত। জোরেশোরে না হলেও ফিসফিসিয়ে তারা কথা বলত। অনেক রকম চিন্তা মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে। লোকমুখে শোনা কথাগুলো মনে পড়ছে।চাড়ালদের এই শ্মশান থেকে না কি অনেক লোক ধরে নিয়ে গেছে।কাউকে পরদিন মুণ্ডহীন,কারোও কলিজা খাবলে খাওয়া, কারো বিকৃত রক্তাক্ত মুখ আবার কাউকে হাতপা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পরদিন বা তিনদিন পর তিনরাস্তার মাথায় পাওয়া গেছে। জীবিত অবস্থায় কেউ ফিরলেও সে আর কখনও কথা বলতে পারে নি।জীবনের তরে তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
এমন গালপপ্পোগুলোকে আমি কখনও বিশ্বাস করিনি।আমি সব সময়ই এগুলোকে মানুষের ভীত সন্ত্রস্ত মনের বিকৃত প্রলাপ বলেই উড়িয়ে দিয়েছি।
এখন আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়তো আছে।যা ই থাক বা না থাক সেটা আমাকে শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে।আমি মনে মনে স্থির প্রতিজ্ঞা করলাম যে, অন্ধকারে এই নাটকের শেষ আমার দেখতে হবে। আর তা দেখতে হলে আমাকে ভয় করলে চলবে না।
আমার দুপাশে কাউকে যেন অনুভব করছি। দুহাত প্রসারিত করে পরখ করতে চাইলাম।আমার হাত প্রসারিত হল না।বুঝতে পারলাম আমি যা করছি তা আমার ইচ্ছেয় করছি না।কেবল মনের ভাবনাটুকু নিজের মত করে ভাবতে পাচ্ছি।
বুঝতে পাচ্ছি কোন এক ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছি। নাড়িভুড়ি উল্টে আসার মত গন্ধ আমার নাকে আসছে।আমি মনে হয় এখনই বমি করে ফেলব।
ধারণা করছি এটা বহুপ্রাচীণ একটি পরিত্যক্ত দালান হবে হয়তো। এর মাঝে যেমন উৎকট গরম তেমনি শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার। এই অন্ধকার মুক্ত প্রকৃতির অন্ধকারের মত কাব্যিক সৌন্দর্যে ঋদ্ধ নয়। এটাকে নারকীয় আঁধারের সাথে তুলনা করা যায়।
হঠাৎ আলোর ছটায় চারদিক দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। দৃশ্যমান মানে ওই আট বারো পুরণো ঘরটিই। ঘরের এককাণে একটি আসন পাতা।আসনের চারিদিকে স্তুপীকৃত নরমুণ্ড। বিশাল একটি শানিত খড়গ। আর আছে লম্বা একখানা ত্রিশুল।
চোখের নিমেষে আসনে কোত্থেকে যেন উপবিষ্ট হল এক দীর্ঘ দেহী পুরুষ। খড়গটা কাছে টেনে নিয়ে আসনে বসল।বাম হাতে ত্রিশুলটা নিয়ে দাঁড় করে রাখলো। তার সারা শরীর ভস্মমাখা। মাথার চুলে জটার বাড়াবাড়ি। গোঁফগুলো পিঙ্গলবর্ণের,দাড়িগুলো আজানুলম্বিত। অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের বর্ণিত প্রেতোপাসকের মত। কোনভাবেই তার চোখ দেখা যাচ্ছে না।চোখ জোড়া জটায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে।
এক সময় সে দুহাতে করতালি বাজালো তিনবার।সাথে সাথেই মুণ্ডবিহীন দুটি নরকঙ্কাল এগিয়ে এলো। ওরা আসতেই সেই প্রেতোপাসক জটা সরিয়ে ফেললো।তার অগ্নিঝরা চোখদুটো বেরিয়ে এলো।সে চোখে চোখ পড়তেই আমার সাহসের পালে ভয়ের বাতাস কিছুক্ষণের জন্য প্রবল বেগে বইতে লাগলো। অস্বাভাবিক আয়তচোখ।মনে হচ্ছে চোখ তো নয় দুটো জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।
নির্মুণ্ড নরকঙ্কালকে দুর্বোধ্য ভাষায় সে কি জানি আদেশ দিল।ভাবে বুঝলাম সে কোনকিছু নিয়ে আসার জন্য আদেশ করল। নরকঙ্কাল দুটো বেরিয়ে যেতেই সে তার সামনে থাকা জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে দুহাত ঢুকিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগল।দেখতে দেখতে সারাঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। চোখ মুখে ধোঁয়ার ঝাপটা এসে লাগছে।আমি আর কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছি না। তবুও নাকে পাঞ্জাবির কোণা ঢুকিয়ে বেহুশের মত পড়ে রইলাম।
৩
ভয়ের কবলে পড়ার আগে ভয় সম্পর্কে আশঙ্কা থাকে কিন্তু ভয়ের সামনাসামনি হলে মন ভয়শূন্য হয়ে যায়। আমারও তাই হয়েছে। ভাবছি এই মৃত্যুগুহায় দাঁড়িয়ে ভয় পেয়ে আর লাভ কী।তারচেয়ে ভাল টিপু সুলতানের মত অসমসাহসিকতার সাথে লড়ে যাওয়া।
অনেকক্ষণ পরে চোখ খুলে যা দেখলাম তাতে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। নরকঙ্কাল দুটো জ্বলজ্যান্ত একটি মানব শিশু দৈত্যাকৃতি লোকটির সামনে বিশাল একটি কাঁসার থালায় রাখল। শিশুটি নড়াচড়া করছে না তাই বুঝতে পাচ্ছিলাম না সে মৃত না জীবিত।পুরুষটি তার ময়লাযুক্ত দাঁতগুলো কেলিয়ে হাসতে লাগল।খুব সম্ভব আয়োজনকারীদের প্রতি সে তার সন্তোষ জ্ঞাপন করল।
তার কেলানো দাঁত দেখে বুঝতে পারা কঠিন যে সে হাসছে না কাঁদছে।
বিস্ময়ের মনে হয় তখনও কিছু শুরুই হয় নি। সে থাল থেকে এক পা এবং এক হাত ধরে শিশুটিকে উপরে তুলে নিল।এবার শিশুটি কেঁদে উঠলো।আর ক্ষুধার্ত বাঘের মত সেই প্রেতোপাসক শিশুটির গলায় তার ময়লাযুক্ত লম্বা দাঁতগুলো বসিয়ে দিল।তার চোখে মুখে,গালে কপালে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। সে আস্তে আস্তে পরম শিশুটিকে চিবিয়ে খাচ্ছে পরম তৃপ্তির সাথে। তাজা রক্তগুলো।জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে খেয়ে ফেলছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটির অস্তিত্ব দানবাকৃতির এই রাক্ষসের উদর সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেল।আর সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে লাগল।
আমার ইচ্ছে করছিল এই দানবিক নিষ্ঠুরতা আমি ওর মুণ্ডপাত করে শেষ করে দিই।কিন্তু আমার সে ক্ষমতা নেই।আমি আমার ইচ্ছে মত চলতে ফিরতে পাচ্ছি না। আমার আশংকা হচ্ছিল সে না জানি আমাকেও আস্তা চিবিয়ে খায়।যদি চিবিয়ে খায় তবু আমার কিচ্ছুটি করার থাকবে না। এটাও ভাবছি যে আমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই এর কোন চিন্তা ভাবনা আছে। না হলে অযথা আমাকে এখানে নিয়ে আসবে কেন। আমি এখন মনে হয় একটুএকটু ভয় পাচ্ছি। যতদূর সম্ভব বুকে সাহস সঞ্চয় করতে চেষ্টা করছি।
এবার সমুণ্ড যুগল কঙ্কাল মাঝারি আকৃতির তামার একটি পাতিল নিয়ে হাজির হল। প্রেতোদর লোকটি তার ডান পাশের ভস্মস্তূপ থেকে ছাই নিয়ে নিজের শরীরে মাখতে লাগল।দুই কঙ্কাল খটখট শব্দে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় তাম্রপাত্র থেকে রক্ত ঢেলে দিতে শুরু করল।প্রেতোদরের জটা,শ্মশ্রু, গোঁফসহ সারা শরীর রক্তে ভিজে গেল।
স্নানরত অবস্থায়ই তার কঙ্কালদাসদের প্রতি ইঙ্গিত করতেই ওরা আমাকে হ্যাঁচকা টানে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে কোন আলো নেই।স্তূপীকৃত অন্ধকার। যারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তারা আমার কাছে অদৃশ্য অথচ আমি তাদের কাছে দৃশ্যমান। এ সেই অন্ধকার আমি যাকে ভালবাসি।জমাটবদ্ধ আঁধারের মাঝে কঙ্কালগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনবরত খটখটাখট শব্দ হচ্ছে।প্যাঁচপ্যাচে গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় পরস্পর কথা বললেও আমার কানে কেবল চন্দ্রবিন্দুর অ্যঁ এঁ ভেসে আসছে।
এটা কোন জায়গা তা বুঝতে পাচ্ছি না। ঠাহর করার চেষ্টা করি কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পাচ্ছি না। এত কিছুর মাঝেও আমার যাত্রা গানের কথা মনে আছে।
এটুকু বুঝতে পাচ্ছি যে ঝাউবন থেকে অনেকটা দূরে অবস্থান করছি।আর পোড়োবাড়িটা মনে হচ্ছে নীলকুঠিয়ালদের পরিত্যক্ত দালান।যেখানটায় দিনের বেলাতেও আলো প্রবেশ করে না।ঘন জঙ্গলে সারাটা দালান আবৃত।সাপ খোপ, বেজি,বাগডাশের অভয়ারণ্য।
এখন আমি নিজেকে নিয়ে ভাবছি। ভাবছি এ অবস্থা থেকে কী করে নিস্তার পেতে পারি।মাথায় কোন বুদ্ধিই আসছে না।
বাইরে আসার পর আমি নিজের উপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পাচ্ছি। চারদিকে কঙ্কালরূপী প্রেতদলের প্রলয়নৃত্যের মাঝে আমি বসে বসে নিজের মুক্তির উপায় খুঁজছি।যদিও তেমন কোন উপায় খোঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ওরা হয়তো ভেবেছিল শিকার অবরুদ্ধ, অনন্যোপায়। তাই হয়তো আমার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছিল।আমিও ভাবছি এই সুযোগটাই আমি কাজে লাগাব।এই মুহুর্তে আমার পকেটে চারটাকা বারো আনা পয়সা এবং কোমরের সামনের দিকে গুঁজে রাখা চার ব্যাটারির একটি এভারেডি টর্চ লাইট।
অনেকগুলো কণ্ঠের ফিসফিস কথাবার্তার শব্দ দালানের দিক থেকে ভেসে আসছিল।যদিও ওরা গলা ছেড়ে কথা বললেও ওদের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবে ভাষা না বুঝলেও ওদের মধ্যে একদল যখন বেরিয়ে আসছে তখন তুমুল অট্টহাসি হচ্ছিল। জগতে ভাষার ভিন্নতা আছে।এক জনপদের ভাষা অন্য জনপদে দুর্বোধ্য হতে পারে কিন্তু হাসি কান্নার ভিন্ন অভিধান নেই।স্থানকালপাত্রভেদে হাসিকান্নার স্বরূপ একই।
একদল লোক এসে পাজাকোলস করে দালানের ভেতরে নিয়ে গেল।আমিও কোন রকম ছটফট না করে নির্বিকার রইলাম। ওরা আমার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ টেপাটেপি করে হাসছিল।ওদের কঙ্কালসার মাংসবিহীন হাতের চাপে আমি প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম কিন্তু আমি নির্বিকার।
ওদের উল্লাস দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওরা আমাকে বলী দেবে। তারপর আনন্দভোজ করবে। আমিও নিজের জীবনের শেষ সীমানা সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম। তারপরও তো দেখা গেছে, হাতপা বেঁধে পানিতে ফেলে দিলেও মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে।এমন কি অলৌকিকভাবে বেঁচেও।যায়। আমিই বা হতাশ হব কেন।যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
প্রথমবারের মত এবার আর কোন আলো নেই।
দাদী নানিদের কাছে ছোটবেলা গল্প শুনেছি। রাক্ষসরা অন্ধকার পছন্দ করে। আলো সহ্য করতে পারে না।তাই প্রয়োজন হলে ওরা যাদুর নকল আলো ব্যবহার করে। অন্ধকারে যদি মানুষের জ্বালানো কোন আলো ওদের চোখে পড়ে সাথে সাথে তাদের চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। এই আলোর কৌশল ব্যবহার করেই অনেক অনেক রাজপুত্র রাক্ষসদের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে।তাই আমার কাছে লুকানো টর্চলাইটটাই শেষ ভরসা বলে ওটা আমি সযতনে কোমরে গুঁজে রাখছি।
আমি বুঝতে পাচ্ছি আমাকে ওরা সেই দৈত্যাকৃতি পুরুষ পিচাশের সামনে শুইয়ে দিচ্ছে। সে ভয়ংকর পিশাচটি বিশালাকৃতির খড়গ টি হাতে তুলে ধার পরীক্ষা করছে হয়তো।অন্ধকারে তো আমি কাউকে দেখতে পাই না।এমনকি।নিজেকেও না। তাই হয়ত আমাকে চেপে ধরার প্রয়োজনবোধ করে নি। মৃত্যুর নিচে শুয়ে আমি সাহসের সাথে আমার এভারেডি টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে দ্রুত সুইচ টিপলাম। আলোয় ঘর ভরে গেল।আর সাথে সাথে কঙ্কালরূপী প্রেতদল এবং নরপিশাচটি হুড়োহুড়ি করে বিচিত্র চিৎকার করে পালাতে শুরু করল।এ দৃশ্য আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
আমি ঝটকরে উঠে টর্চের আলোয় দৌড়ে বাইরে চলে এলাম। খানিকটা দৌড়ে পূর্বদিকে রাস্তায় এসে উঠলাম।
যাত্রাপ্রেমিক লোকজন পালা দেখে ফিরছে।তাদের সম্মিলিত কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে,
সাগরকে কোলেতে তুলে
ডাকো বাছা পুত্র বলে
একবার কোলে নাও সাগর ভাসা রে।
মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বর থেকে সিন্দাবাদের মত বেঁচে এসে যতটুকু পুলকিত হয়েছিলাম সেই পুলককে আচ্ছন্ন করে যাত্রাপালা না দেখতে পাওয়ার অতৃপ্তিটাই বেশি করে মনে বাজছিল। জীবন থেকে আনন্দঘন একটা রাত ঝরে পড়ে গেল।
০২/৪/২০২৩
ময়মনসিংহ