(এক)
প্রৌড় এক ভদ্রলোক, সেদিন অফিসের অনেক কাজ নিয়ে বেড়িয়েছে। সময়কাল ছিলো জৈষ্ঠ্য মাস। বাইরে প্রবল দাবদাহ। বয়স কম করে ষাঠের আশে পাশে। দেশের লোক তখন গরমের উত্তাপে দুপুর রোদকে শোলে সিনেমার গব্বরের মতো ভয় পাচ্ছে। আর সেখানে এক বেসরকারি অফিসের কর্ম কর্তা তাকে পাঠিয়েছে ধর্মতলায় এক বিশেষ কাজে। হাতে তিনটে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি তুলি। বিভিন্ন আকারের তুলি। ধর্মতলার এস. এন. ব্যানার্জির মুখে একটা দোকানে সেটা ডেলিভারি দিতে হবে। তারপর সেখান থেকে পার্ক স্ট্রীটের মুখে কিছু কাগজ দিতে হবে। তাঁকে ফোন করে বলা থাকলেও, সেই খাঁ খাঁ রোদ্দুরে এই মানুষটাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে। ফোনে বললে, এই তো আসছি। বরঞ্চ, তার ঠিকানাটা দিলে, দিয়ে আসলে প্রৌড় মানুষটার কাজ সহজ হয়ে যেতো। এই কাজ সেরে ডালহৌসি চত্তরে ব্যাঙ্ক শাল কোর্টের কাজ শেষ করে, অফিসে ফিরবে।
চ্যাটার্জি স্টোরস এ যখন এসে পৌছালো শ্যামল দত্তের নাম করে তুলিগুলো তারা নিলো। বয়স্ক মানুষটাকে এক বারো বলল না, আপনি বসুন। জলের কথা তো দুরের কথা। লজ্জা খুইয়ে প্রৌড় মানুষটা এক গেলাস জল চাইলো। কিন্তু প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেলো সেই মানুষটাকে এক গেলাস জলো এগিয়ে দিলো না। ইতিমধ্যে, তার সস্তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। অফিসের বড় বাবু তাকে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো, এখনো যদি আপনি এসপ্ল্যানেডে থাকেন, তাহলে বাকিঁ কাজগুলো শেষ করতে দিন শেষ হয়ে যাবে। এই বলে, সে ফোনটা কেটে দিলো। তারা হলেন অফিসের ঠাণ্ডা ঘরে বসে থাকা মানুষ। বাইরের তাপ প্রবাহ, উষ্ণতা সম্বন্ধে আভাস থাকলেও, লাঠি ঘোরানোর সময় লাঠি ঘুরিয়ে যাবে। আর কলকাতা শহরে এক জায়গা থেকে আরেক যেতেও যে সময় লাগে, তার ভাবনাও করে না। তাদের যখন বেরোতে হয়, হয় ওলা নয়ত বাবুর গাড়ি নয়ত ভাড়া করা ট্যাক্সি করে এদিক ওদিক যায়। পায়ে হেঁটে চলতে কি কষ্ট তারা বুঝবে কী করে?
তড়িঘড়ি করে প্রৌড় মানুষটা রওনা দিলেন সেখান থেকে। পার্ক স্ট্রীটের উদ্দেশ্যে। সামনেই মেট্রো। একটা মাত্র স্টপেজও নয়। মাটির তলায় স্টেশনে গিয়ে দেখলেন লম্বা লাইন। টিকিট কিনতে সময় লাগলো প্রায় দশ মিনিট। টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে আসতে একটু শান্তি হলও। যদিও জল পায় নি। পেলো একটু শীতল বাতাস। সেখানেও আবার সেই বড় বাবুর ফোন। এবার সুধীন বাবু, প্রৌড় ভদ্রলোকটা চটে গিয়ে বলল, যদি আমাকে অফিসে এতই প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাকে এতগুলো এত জায়গার কাজ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কেনো? কথাটা বলতেই, ফোনটা কেটে দেয় ওপাশ থেকে। শরীরের মধ্যে তখন তার চলছে পিপাসা জনিত একটা মারাত্মক কষ্ট। ট্রেনে করে, পার্ক স্ট্রীট আসতে, ফোন করলো সেই ছেলেটাকে, যার হাতে কিছু কাগজপত্র দিতে বলেছিলেন বড় বাবু, পিন্টু সরকার।
যথারীতি, তাকে ফোন করে, অপেক্ষা করতে করতে সময় কেটে গেলো আধা ঘণ্টা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় আড়াইটে। ইতিমধ্যে একটা দোকানে বসে চা পান করে কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন সুধীন বাবু। ছেলেটা আসতেই, ভদ্রতার খাতিরে সরি বলে তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিলো। সুধীন বাবু ছেলেটাকে একটা কথাই বলল, প্রতিবারের মতো এই কার্সিটা না দেখালেই পারতেন। আপনিও দেবেন না আপনার ঠিকানা, আর আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করে আমাকেও শুনতে হবে মুখ ঝামটানি। তাকে সে অনুরোধ করলো, তিনি যে কাগজটা পেয়েছেন, সেটা বলে দিতে। সে জানালো সে ফোন আনেন নি। সুধীন বাবু বড় বাবুকে ফোন করিয়ে জানিয়ে দিলো, সে কখন কাগজটা হাতে দিয়েছে।
পার্ক্স স্ট্রীটের মোড় থেকে সে ডালহাঊসির মিনি বাস ধরে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে এসে উপস্থিত হলো। প্রবল উষ্ণতা আমার তৃষ্ণাকে হরণ করে নিয়েছে। সেখনে এসে কোর্টের সকল কাজ শেষ করে বিরাটী ডালহাঊসির মিনি ধরে কাঁকুরগাছিতে এসে যখন নামলাম, তখন প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছে। সেখান থেকে সল্টলেকের এফ ডি ব্লকের সামনে এসে নামলাম তখন বিকেল পাঁচটা। অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই বড় বাবুর চামচা বণিক বাবু বলে বসলেন, সুধীন বাবু অফিসে আসে শুধু কলকাতা বেড়াতে। আর মাসের শেষে মোটা অঙ্কের টাকা মাইনে নিয়ে বেরিয়ে যান। কথাটা সুধীন বাবুর কাছে বেশ পুরনো। একটু মুচকি হেসে বলল, বাড়ির ঝিদের মতো রুটি বেলা ছেড়ে, যেদিন বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে যাবে, সেদিন বুঝবে, কাজ কাকে বলে। এখানে আমিও কর্মচারী, তুমিও তাই। আমাকে দিয়ে যে কাজ হয়, তাই দেওয়া হয়। এতে কম্পানি যদি বোঝে আমার কলকাতা ঘুরে দেখাটা আমার কাজ, তাই সই।
একটু বসে টেবিলে রাখা জলের বোতলটা থেকে ঢগ ঢগ করে জল খেতে খেতে, দেখলো বড় বাবু পিন্টু সরকার ঢুকে তার কেদারায় বসলো। বসতে না বসতেই জানালো, বড় মালিক এসেছিলেন। আমার খোঁজ করছিলেন। তিনি জানিয়েছেন বিভাগীয় কাজে তিনি পাঠিয়েছেন। পরের দিন তিনি এলে আমি যেন সেই কথাই বলি।
অফিসের পিওন মহাদেব এক কাপ চা দিয়ে গেলেন। বললেন, দাদা অফিসের জন্য কিছু জিনিষ লাগবে। পরের দিন সেগুলো লাগবে। বড়বাবু শুনতেই লাফিয়ে উঠে বললেন, তাহলে তার মেয়ের জন্যে অঙ্কের খাতা লাগবে। সেইগুল সে যেন দায়িত্ব করে নিয়ে আসে। সুধীন বাবু না করলেন না। তিনি ভালো করেই জানে, অফিসে থাকার চেয়ে বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকলে, অফিসের ভিতরের কাগজপত্র বেশি নাড়াচাড়া করতে হয় না। কুকুর থাকলে ঘেউ ঘেউ করবে। দীর্ঘকাল ধরে, যেমন চালিয়ে এসেছে, তেমনি করে কিছুদিন চলার পর ছুটির ঘণ্টা বেজে যাবে।
বৈশাখের তিরিশ তারিখে সুধীন বাবু একষট্টি বছর বয়সে পা দিতেই। তিনি অফিস থেকে দিন পনেরো ছুটি চাইলেন। তার দীর্ঘ কুড়ি বছর কালীন এক সাথে এক দু’দিনের বেশি ছুটি তিনি নেন নি। তিনি খলাখুলি জানালেন, একষট্টি বছরে পা দিয়েছেন। রিটায়ার করার সময় হয়েছে। দির্ঘদিন সে অফিসের পিওনের মতো সকলের ফর্মাস পুরণ করে এসেছে। এবার তার ছুটি নেবার পালা। অফিসের অনেক নিয়ম কানুন যা তার ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক বলে মনে হয় নি, অফিসের স্বার্থে সে করে এসেছে। এবার তার কাজ করার প্রয়োজন থাকলেও, সে এই কাজ আর করতে রাজি না। প্রবল গরমের দিনে, সে কোন কথা না বলে ওপরওয়ালার সকল কথা শুনে এসেছে। ঝড় জল বৃষ্টি শীত কোন দিনও সে একটা কথা মুখ ফুটে বলে নি। আজ সে ভীষণ ক্লান্ত, ছুটির তৃষ্ণায় পিপাসিত। অফিসের মজুর সুধীনের পরিচয় অনেকে না জানলেও, তার ব্যক্তিগত গুণাবলীর জন্য তার নাম অনেকেই জানে। সেই নামের পিপাসা তাকে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে দেয় না। অফিস তার কাছ থেকে কলম কেড়ে নিলেও দুনিয়া তাকে কলম ধরিয়ে দিয়েছে। হিসাবের খাতায় তার অফিসের সাথীরা আঁচড় কাটতে না দিলেও, সাহিত্য তাকে গুণীদের পাশে স্থান দিয়েছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান তাকে ডাকে তার সাহিত্যকে সকলের সামনে তুলে ধরতে। মাতৃভাষা ও বিদেশী ভাষাতে তার লেখার সফলতা, অফিস তাকে না দিলেও সমাজ তাকে দিয়েছে।
এই বলে সেদিনের শেষে অবসরের চিঠি নিয়ে পাড়ি দিলেন সেদিন বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেদিন সন্ধ্যে বেলায় নামলো তুমুল বর্ষা। সুধীন বাবু সেদিন বাদলের ধারায় ভিজতে ভিজতে জীবনের কুড়িটা বছরের দায়িত্ব পেছুনে রেখে এসে পৌছলেন লাবণীর মোরে। সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌছলেন।
(দুই)
সেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর, বেশ কিছুদিন ভালোই ছিলেন। এর পর সুধীন বাবুর জীবনে এলো বড় সড় বিপদ। তার স্ত্রীর ধরা পড়লো রক্তে কর্কট রোগ। সেই খরচ সুধীন বাবুর পক্ষে বহন করা অসম্ভম হয়ে পড়ে। তখন তিনি কিছু আয়ের জন্য আবার বেড়িয়ে পড়লেন কোথাও যদি একটা কাজ পায়। তারই এক পরিচিতির মাধ্যমে তিনি এক জায়গায় কম্পিউটার টাইপ করার কাজ পেলেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাকে সেই মেশিনে বিভিন্ন লেখকের লেখা টাইপ করতে হবে। যেহেতু তিনি নিজেও লেখালেখি করেন, প্রথম প্রথম তার বিষয়টা বেশ ভালো লেগেছিলো। কিন্তু আসতে আসতে সেখানে তার কাজের গুনগত মান দেখে কাজের চাপ বারতে থাকে। তাকে দিনে অন্তত তিরিশ থেকে চল্লিশটা পেজ টাইপ করতে হতো। ফলে বাড়িতে এসে, তার নিজের সৃষ্টিশীলতা একেবারে শূন্য হয়ে গেলো।
এদিকে তার স্ত্রীর যাবতীয় বাড়ির কাজ, তাকে দেখাশুনা করা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া সব নিয়ে তিনি পড়ে গেলেন দোটানার মধ্যে। এই প্রেস থেকে সুধীন বাবুর যা আয় হয়, সবই খরচা হয়ে যায় তার স্ত্রীর জন্য। কাজের জায়গায় তার একটা সুবিধে, তাকে অন্য কোথাও যেতে হয় না। সে যখন শোনে কোন কর্মচারীকে হয় ইনকাম ট্যাক্স বা প্রফেশানাল ট্যাক্স বা জি. এস. টি. র অফিসে যেতে বলছে, তাকে কাছে ডেকে বলতেন তার নাম করতে। এবং সত্যিই সেখানে তার পরিচিতি এতটাই ছিলো, সেখানে গেলে কারুক্ষে খালি হাতে ফিরতে হতো না। তাই প্রেসের মালিক কোন জটিল সমস্যায় পরলে, সুধীন বাবুকে নিজের গাড়ি দিয়ে পাঠাতেন। আসতে আসতে এই অফিসেও তার কাজের কদর হলো খুব।
টাইপিং ছেড়ে তিনি দেখতে লাগলেন হিসাব নিকাসের বিভিন্ন কাজ কর্ম।
সুধীন বাবুর একটা মস্ত বড় গুণ তিনি শিখতে পিছুপা হতেন না। নতুন অজানা বিষয় তিনি শিখতে ভালো বাসতেন। আসতে আসতে তার সাহিত্য প্রীতি অনেকটা হ্রাস পেয়ে গেলো। কিন্তু সময় পেলেই, তিনি টুকটাক লিখতেন। তাতেই তার নাম ডাক বেশ ছিলো। একদিন প্রেসের মালিক নন্দী বাবু, এক বিশেষ কাজের জন্য সুধীন বাবুকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে একটা জায়গায় সুধীন বিশ্বাসের নাম লেখা তিনটি কবিতা তাকে দেখিয়ে বললেন, এগুলো কি আপনার লেখা। কারণ সুধীন বাবুর নম্বর নন্দী বাবুর কাছে সেভ করা ছিলো। নন্দী বাবু সুধীন বাবুকে জড়িয়ে বললেন, আপনার এই প্রতিভা আমাদের কাছে লুকিয়ে খুবি ভুল কাজ করেছেন। এবং তিনি তার কাছ থেকে তিরিশটা কবিতা চাইলেন।
সেদিন সকালে সুধীন বাবু বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন চেয়ারের উপর। হাসপাতালে তার স্ত্রী ভর্তি। সকালে অফিসে আসার আগেই সেখান থেকে ঘুরে আসার সময় ডাক্তার সময় দিয়েছে আর চার পাঁচ ঘণ্টা।
বেলা ঠিক একটা দশ। একটা ফোন আসতেই, তাড়াহুড়ো করে ধরতেই, সে সব কিছু হারিয়ে ফেলল যেন। ঠিক তখনই, অফিসের সব স্টাফ এসে জমা হলেন সুধীন বাবুর কাছে। নন্দী বাবু তার হাতে তুলে দিলেন তার প্রথম কবিতার বই, “সত্তরে তিরিশ”। সকলে করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাতে, সুধীন বাবু হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। কারণ এই বইটা তিনি যার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, তিনি কিছুক্ষণ আগেই না ফেরার দেশে পারি দিয়েছেন।