সাধক রায়ের মন উড়ু উড়ু। আজ ফাগুনের সেই দিন,শুভক্ষণ আসন্ন। আনন্দের আতিশয্যে ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। তারপর থেকে একবারও ফোনে উঁকি মারার সময় করে উঠতে পারেনি। টিভিতে গান শুনেছে বটে তবে উড়ে উড়ে বেড়িয়েছে সারাটা বাড়ি। পিসিমা-কে ডেকে তুলেছে বিছানা থেকে। বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কি কি কেনা হবে বউকে ডেকে তার ফর্দ তৈরি করিয়েছে সকাল সকাল।আটটা বাজতেই উড়ন্ত পাখি হয়ে মনটাকে পৌঁছে দিয়েছিল বাদল কাকার গোলদারি দোকানে। ঘর ছেড়ে বের হওয়ার মুখে ওর বউ মিমি শরীরে সুগন্ধি ছিটিয়ে দিয়ে বলল, "সাবধানে যেও। মনে করে সবকিছু আনবে কিন্তু।"
হাতে ধরা দুটো থলি। পিসিমা বলেছেন তাঁর নির্দেশ স্মরণে রাখতে। তাই প্রথমেই শুদ্ধ চিনি কিনে নিতে হবে বাদল কাকার দোকানে। সবজির বাজারে ঢুঁ মেরে তুলে নেবে সজনে ফুল। থলি ভরে বাড়ি নিয়ে যাবে অনেক কিছু। আজ গলা অব্দি খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে আনন্দে। তারপর যাবে অফিসে। তার হৃদয় ছুঁয়ে রয়েছে বাড়ির অলিন্দে নিজেদের বেডরুমে। মন আজ উড়ু উড়ু।
ভোর বেলায় শোনা একটা নজরুল গীতি গুনগুন করতে করতে বাদল কাকার দোকানে ঢুকে আবিষ্ট গলায় বলে,"কাকা,এক কিলো শুদ্ধ চিনি দাও।"
বাদল কাকা ডাল ওজন করছিলেন। অন্য এক খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে শোকেসের সামনে। চশমার ফাঁক থেকে চোখ বার করে বললেন," এখানে শুদ্ধ চিনি পাওয়া যায় না।চিনি আছে নিয়ে যা।"
সাধক মিমির গলার কাছে মুখ গুঁজে দিয়ে প্রাণ ভরে ঘ্রান নিচ্ছিল বউয়ের শরীরের। জড়ানে গলায় বলল," পিসিমা শুদ্ধ চিনিই আনতে বলেছে গো।"
বাদল কাকার মনে হল ঢেঁড়সটার মগজে নির্ঘাত ছত্রাক আক্রমণ করেছে। ভুল বকছে সাধক। এটার শোধন হওয়া দরকার। একখানা নকশাদার চাওনি মেলে বললেন," পেয়ে যাবি। রুদ্র নতুন গোলদারি দোকান খুলেছে বাজারের মাঝখানে।আমার পাশের বাড়ির প্রাক্তন বক্সার রে। ওর কাছে যা,তোকে শুদ্ধ চিনি দেবে।"
সাধক মিমির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে গানের কলি আওড়াচ্ছিল, হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে....। রুদ্র কাকার দোকান কিছুটা দূরে।বাদল কাকার দোকান ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই ভাবল সবজির বাজার সারা হলে পরে গিয়ে ঢুকবে রুদ্র কাকার দোকানে।হাঁটতে হাঁটতে কানে এল ফোনের রিংটোনে গান বাজছে।
ফোন সোয়াইপ করতেই ওপাশ থেকে মিমির গলা ভেসে এল" ফুল কিনেছো?"
"এখনও কিনিনি সোনা। আগে সবজি কিনি। আর কি চাই বলো?"
"এখনও ফুল কিনলে না!রজনীগন্ধা নেবে। খুব সুন্দর করে সাজাব বেডরুমটা। ফোন রাখছি। আমি রান্নায় খুব ব্যস্ত।"
ফুলের দোকানের পাশে রুদ্র কাকার দোকান। সাধক ভাবে এক ঢিলে দুটো পাখি মারা যাবে। ফুল কেনা হবে সঙ্গে শুদ্ধ চিনি। এক তাড়া রজনীগন্ধা কিনে ঘড়িতে সময় দেখে। ন'টা বাজছে। অফিসের কথা মনে হতেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। রুদ্র কাকার দোকানে ঢুকে প্রায় হামলে পড়ে বলে," কাকা,এক কিলো শুদ্ধ চিনি দাও। তাড়াতাড়ি দাও।"
রুদ্র মিত্তির একটা পঞ্চাশ কেজির আটার বস্তা তুলে সেটা সরিয়ে রাখছিলেন অন্যত্র। হাতের মাসল দেখলে কে বলবে বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মুখ তুলে বললেন," কি চাইছিস?"
সাধক অস্থির হয়ে বলে,"বললাম তো, এক কিলো শুদ্ধ চিনি দাও। তাড়াতাড়ি করো। অফিসে যাব।"
বস্তা ফেলে রেখে রুদ্র মিত্তির শ্যেন দৃষ্টিতে আপাদমস্তক জরিপ করতে থাকেন সাধককে। পরক্ষণে বলেন," ফাজলামো হচ্ছে?"
সাধক ঘাবড়ে গিয়ে থম মেরে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক পল। তারপর রাগত স্বরে বলে, "শুদ্ধ চিনি তোমার দোকানে নেই বললেই পারতে। উল্টোপাল্টা কথা বোলোনা।"
রুদ্র মিত্তির দ্রুত সাধকের মুখের দিকে নিজের পাঞ্জা খানা তুলে ধরে আগুনে দৃষ্টি হেনে বলেন," বাইসেপস খানা দেখেছিস।একখানা এমন দেবো , গিয়ে পড়বি ঢেঁড়সের খেতে।"
সাধক এক লাফে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাজারের ভিড়ে। এটা কেমন হল? রুদ্র কাকা উন্মত্ত হয়ে উঠলেন কেন? মনটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না সে। শুদ্ধ চিনি এবার পায় কোথায়? পিসি আরও কিছু একটা কিনে আনতে বলেছিল। কিছুতেই মনে করতে পারছে না জিনিস টা কি। বাড়ি ফিরলেই তো পিসি চিৎকার জুড়বে।বুকে ভয় না জানি পিসি কি কয়। পিসিকে ফোন করা দরকার। চিন্তাটা মগজে সেঁধোতেই উদ্বেগে অন করে বসে ফোনের সুইচ।"ও পিসি, স্যরি, শুদ্ধ চিনি পেলুম নে। আর কি কিনে নিয়ে যেতে বলেছিলে গো?"
"তোর মাথা", বলেই ফোনের লাইন কেটে দিলেন আশালতা।
কানের ভেতর সারাক্ষণ তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে, হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে... সাধকের মনে হল পিসি মাছের মাথা নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। ভুল সে শোনে নি। মিমিও বলেছিল মাছের মাথা কিনে নিয়ে যেতে। মিমি বলেছে বাঁধাকপিতে যেমন মাথা পড়বে চচ্চড়িতেও পড়বে। হবে মুড়িঘন্ট। মাথা ভেঙ্গে দই মাখিয়ে হবে হেড-চিলি। এমন শুভদিনে কারও অভিলাষ অপূর্ণ রাখবে না। চারটে বড় মাছের মাথা, পাঁচ রকমের সবজি, মাংস-সন্দেশ-রসগোল্লা আর দই কিনে সটান গিয়ে হাজির হল নিজেদের শ্রীপল্লীর বাড়িতে। মিমি রজনীগন্ধার গোছা পেয়ে খুব খুশি। গোছাটা বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে তাকে আড়ালে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল," আজ শুধু তুমি আর আমি।"
পিসিমা কোত্থেকে উদয় হয়ে বললেন," চিনিটা দে সাধক। চাটনি হবে।"
সাধকের বিনম্র ভঙ্গি।ক্যাবলা হাসি ঠোঁটের কোণ ঝুলে নেমে আসতে শুরু করেছে নিচে। গলায় আদুরে ভাব ফুটিয়ে বলে উঠল" তোমাকে তো বললাম শুদ্ধ চিনি পেলুম নে।"
পিসি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। রক্তের স্রোত ছলাৎ করে চারিয়ে গেল তাঁর মাথার ভেতর। মুখের হাসি উধাও। বড় বড় চোখ করে বললেন,"শুদ্ধ চিনি মানেটা কি? তোকে শুধু চিনি আনতে বলেছিলাম। শুধু চিনি-কে শুদ্ধ চিনি শুনে নিলি!তুই সত্যিই ঢেঁড়স একখানা।তোর মাথাটা গেছে। তোকে বলেছিলাম সজনে ফুল আনবি বেশি করে।এনেছিস?"
চোয়াল শক্ত করে ফেলেছে সাধক। পিসির থমথমে মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। সজনে ফুল পিসির প্রাণ।মিমি চেয়েছিল রজনীগন্ধা। মিমির দু'চোখে নিজেকে সাজাতে গিয়ে সজনে ফুল আনার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। পিসিকে খুশি দেখতে চেয়ে বিগলিত গলায় বলে উঠল, "লাল দই এনেছি গো। আমি জানি তুমি দই খেতে খুব ভালোবাস। তোমার প্রিয় সন্দেশ এনেছি।"
আশালতার কথা বন্ধ হয়ে এসেছিল রাগে।লাল দইয়ের কথা কানে সেঁধোতেই আলতো হাসি ফুটে ওঠল মুখে। একমুখ এসে বললেন," তোদের আজ বিবাহ বার্ষিকী তা কি আমি জানিনে। বেশি করে সজনে ফুল আনতে হতো। আজ অর্ধেকটা রান্না করতাম। বাকিটা তোদের বেডরুমে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখত বৌমা। ওই ফুলের সুবাসে মম করত তোদের ঘর। ফুলদানিতে জল ভরে দিতিস। দু'দিন পরেও ওগুলো টাটকা থাকত। আরও একবার কেমন ফুলের তরকারি খেতে পারতিস ভাব। তা না নিয়ে এলি রজনীগন্ধা!"
২৭.৮.২০২৩