তেপান্নতম বিজয় দিবস ও আমাদের চাওয়া পাওয়া ।। তাহমিনা রহমান


বিজয় দিবস এই শব্দ দুটি এখন আর কোন আবেগমথিত শব্দ নয় বরং বায়ান্ন বছর বয়সী এই বাংলাদেশ নিয়ে আবেগবর্জিত মনোভাব নিয়ে ভাবার সময় এখন‌ই । কারণ বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে অভাবনীয় গতিতে এগিয়ে চলছে  । এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে ব্যপক পরিকল্পনা ও দেশকে এগিয়ে নেয়ার কোন বিকল্প নেই । এর‌ই মাঝে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ আমাদের কর্মসংস্থান এবং জীবনযাপন প্রণালীতে যে পরিবর্তন নিয়ে আসছে তার মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও নিবিড় হবে । অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে যা এখনও আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে চিন্তা করতে পারছিনা ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জাতিগত উন্নয়নের পথে পাহাড় সমান বাধা রয়েছে  । এর একদিকে যেমন বন্যা মহামারীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমনি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও প্রনিধানযোগ্য । এইসব সমস্যা এখন আর শুধু জাতীয় পর্যায়ে না বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে  অনেক বেশি প্রকট । নতুন করে দেখা দিয়েছে কোভিড -১৯ এর মতো ভয়ংকর মহামারী যা সারা বিশ্বের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতিকে থমকে দিয়েছে । প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় সংযোজিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ তবে এর পাশাপাশি এক‌ই সাথে খুলে যাচ্ছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার ।

এমনি এক নতুন দোলাচলের মাঝে তেপান্ন বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ কিন্তু এই পুরো সময় ধরে দেশে নিরবচ্ছিন্ন স্থিতিশীলতা বজায় ছিলোনা । ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এটি ছিলো বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাষ্ট্র। এছাড়া ১৯৭৪  সালে এটি দুর্ভিক্ষের‌ও সম্মুখীন হয়েছিলো । স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় চার নেতা হত্যার মতো ভয়াবহ ও নির্মম নিধনযজ্ঞ ঘটিয়ে দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা । পরবর্তীতে জিয়া হত্যাকান্ড এবং উপর্যুপরি ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতায় বিপর্যস্ত হয়েছে দেশ ও দেশের অর্থনীতি এবং উত্থান ঘটেছে অপশক্তির । পবিত্র সংবিধান কাটাছেঁড়া করে ক্ষমতা কন্টকমুক্ত করতে সমাজে অন্যায় অবিচারের চাষ করা হয়েছে ফলে অপরাধীরা নিরাপদে তাদের দূর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে  । এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সর্বনাশ সাধিত হয়েছে যা দেশের উন্নয়ন সবদিক থেকে বাধাগ্ৰস্ত হয়েছে শুধু নয় অর্জিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করে সৃষ্টি করা হয়েছে বিকৃত ভাবনার একটি বিশেষ শ্রেণী এবং এদের দ্বারা একধরনের অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে । বর্তমানে এর থেকে মুক্তি পেতে দেশকে দেশি-বিদেশি বহুমাতৃক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই এগোতে হচ্ছে । কাজেই একথা বলা যায় যে এই বায়ান্ন বছর বয়সে দেশের অগ্ৰগতি নিস্কন্টক হলে এই হিসেব নিকেশ হয়তো ভিন্নতর হতো ।

তথাপি বাংলাদেশ আজ সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে । বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে ।  বিশ্বের ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম শিল্প খাতের যুক্তরাজ্য ভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় মিডিয়া প্লাটফর্ম আই টি এস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচার এ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম আই টি এস ' র উপর "  বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে উদ্দীপক অবকাঠামো ও আই টি এস বাজার "  শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে । নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি বিষয়।
মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর জেমস ফস্টার এই প্রতিবেদনে আরও বলেছেন দেশটি গত এক দশক ধরে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে । কোভিড মহামারী সত্ত্বেও এর অর্থনীতি বার্ষিক ছয় শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল যা সেই সময়ে সকল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ।

বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা গেছে  এরই মাঝে বাংলাদেশ  শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মাসেতু নির্মাণ করেছে যা  বিশ্বের গভীরতম সেতু  । এই সেতু দেশের স্বল্পোন্নত দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলকে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করেছে । ঢাকা মেট্রোরেল ,  ৪৬  কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বহু উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নির্মাণ করে সমস্ত বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে । এইধরনের বহু কর্যক্রম এখনও সারা বাংলাদেশ জুড়েই সমান গুরুত্বসহ চলমান আছে এবং কর্মযজ্ঞ এগিয়ে চলছে।

সরকারের দূরদর্শী দায়িত্বশীল পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সাফল্য এখন সর্বজনবিদিত । পূর্বে যেমন হাতেগোনা কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিলো এখন আর তেমনটা নেই। বরং ' সবার সঙ্গে মৈত্রী কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় '  এই মূলমন্ত্র সামনে রেখে সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সফল ভাবে অগ্ৰসর হচ্ছে বাংলাদেশ । বাংলাদেশ একদিকে বিশ্বের বড় শক্তিধর দেশগুলোর সাথে যেমন যুক্তরাষ্ট্র , চীন , রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তেমনি তুরস্ক , সৌদিআরব , মেক্সিকোসহ  তুলনামূলক ভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি রাখছে ।

বাংলাদেশে ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে । বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রকল্প দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে সরকারকে দ্বিগুণের বেশি অভ্যন্তরীণ রিটার্ন দেবে । বিশেষজ্ঞদের এই বক্তব্য বাংলাদেশের নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের হতাশ করেছে এবং এই প্রকল্পটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে উৎপাদনে যাচ্ছে  । নব অর্জিত বর্ধিত সমুদ্রসীমায় রয়েছে নানাবিধ সমুদ্রসম্পদ। এই সম্পদ আহরণে  ব্যপক কর্মসংস্থানের হাতছানি লক্ষ্য করা যাচ্ছে । তবে এই সম্পদ এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রাপ্ত সীমানা নিরাপদ রাখাও সরকারের পক্ষে এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। 

এছাড়া বর্তমানে ওই অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা একটি বিষফোঁড়া হয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এদিকে সকল খাতে দুর্নীতি অর্থ পাচারের মতো নৈতিক স্খলনজনিত নানান সমস্যা সমাজে শিকড় গেড়ে বসেছে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে  অবক্ষয়। এসব  শুধু আইন করে বা আইনের প্রয়োগ দ্বারা নিরসন সম্ভব নয় বরং মানুষের নৈতিক চরিত্র উন্নয়নে প্রয়োজন পারিবারিক ও সংঘবদ্ধ শক্তিশালী নাগরিক উদ্যোগ । একাজে সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের এগিয়ে আসা  এখন সময়ের দাবী।

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং  ২০৪১  সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে । এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার টেকস‌ই ও কার্যকর সমাধানে প্রয়োজন জ্ঞান , দক্ষতা , মূল্যবোধ  ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দূরদর্শিতা সংবেদনশীলতা , অভিযোজনে সক্ষম, মানবিক , বৈশ্বিক এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমিক নাগরিক । 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।