তৃষ্ণার জল ।। স্নিগ্ধ নীলিমা


দাদন আলী মাঝি দুইযুগ ধরে কীর্তনখোলা  নদীতে ছৈলা নাও বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ঘরে দ্বিতীয় স্ত্রী  কমলা। কমলার মতই তার গায়ের রং।  বিশ বছরের তরুনী বউটি যখন বাড়ির উঠোনে হেঁটে বেড়ায় দাদন আলী মাঝির বুকের মধ্যে একটা অজানা শংকা গভীর নিশিথে ডেকে যাওয়া নিশাচর পাখির মতই ভয়ার্ত সুরে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে বেজে ওঠে।   বাবা মা মরা মেয়ে কমলা বিশটি বছর চাচার ঘরে খেয়ে নাখেয়ে অনাদরে বড় হয়েছে। চাচীর সংসারে গতর খাটিয়ে দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকাকেই সে জীবনের স্বপ্ন ভেবেছে। তার সপ্নের ক্যানভাস জুড়ে  কেবল একটি মাটির সানকি ভরা জুঁইফুলের মত  সাদাভাত। দাদন আলী মাঝির ঘরে আর কিছু না হোক দিনান্তে একবেলা ভাত পাবে এই আশা নিয়ে এক রাতে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ছৈলা নায়ে চড়ে  বউ হয়ে আসে  ভিন গাঁয়ে।  প্রথম স্ত্রী সাবিহা মারা যাওয়ার পর কিশোরী মেয়ে   ময়নাকে নিয়ে দিন ভালই কাটছিলো।  মেয়ের বিয়ে দিয়ে একা হয়ে যাওয়ায় কমলাকে ঘরে আনে। দাদন আলী মাঝি সারাদিন কীর্তনখোলায়  নৌকা ভাসায় আর ভাবে একা বাড়িতে কমলা নাজানি কোন নাগর নিয়ে রঙ্গ রসে মজে আছে। এক নির্জন দুপুরে তাই  ঘাটে নাও ভিড়িয়ে বাড়ি চলে আসে।ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সন্দেহের বসে কান পেতে থাকে। ভিতরে নারী পুরুষের হাসির শব্দ। দাদন আলীর হৃদয় ভেঙে খানখান হয়।  এক লাথি দিয়ে বাঁশের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। চাচাতো ভাই শুক্কুর আলী পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। উত্তেজিত দাদন আলী বউকে পেটাতে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে। খেজুরপাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু হু করে বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে মিশে যায় এক প্রেমিকের  বুকের দীর্ঘশ্বাস। তার ভালবাসা পরাজিত হয় অক্ষমতার কাছে। দ্রুতপায়ে ফিরে যায় ঘাটে। কীর্তনখোলার শান্ত জলে ভেসে মনকে শান্ত করতে নাও ছোটায় লক্ষ্যহীন কোন এক শান্তির নগরীতে। 

রাত গভীর হয়। গঞ্জের ঘাটে দাদন আলী একা। দুজন পুলিশের কনস্ট্রেবলের ডাকে নিজেকে ফিরে পায়। লাস নিয়ে থানায় যেতে হবে।  কোন আপত্তি টেকেনা। ওরা বলাবলি করছিলো স্বামীর পরকীয়ার কারনে অবজ্ঞা আর অবহেলায় বিশ বছরের উত্তাল যৌবনা মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। পোষ্টমর্টেমের জন্য লাস শহরে নিতে হবে। কনস্ট্রেবল দুজন ধরাধরি করে লাস নৌকায় নামালো। চাঁদের আলো মেয়েটির মুখে পরতেই  দাদন আলী চিৎকার করে উঠল। ময়না!  আমার ময়না! 

পোষ্টমর্টেম আর দাফন শেষে দুদিন পরে  ফিরলো নিজের ঘরে। কমলা দাওয়ায় উদাস চোখে বসে আছে। স্বামীকে ফিরতে দেখে অনুতপ্ত আর অনুশোচনায় নির্বাক কমলার চোখ  বেয়ে দরদর বেগে পানি ঝরছে।  দাদন আলী কমলার মাথায় হাত রাখলো। থুতুনিটা উঁচু করে মুখের দিকে চেয়ে বলল, আজ থেকে চিরদিনের জন্য আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।