আব্দুল খালেক ফারুক। জন্ম ১ নভেম্বর ১৯৭১। কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের শিবরাম গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের আঙিনায় তার হাঁটাচলা। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান ও নাটক নিয়ে কাজ করে গেছেন একের পর এক। প্রকাশিত হয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায়। শিল্প-সংস্কৃতির অনেক ক্ষেত্রে তার সরব বিচরণ। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা-১৩। লিখেছেন ১১টি নাটক। গীতিকার হিসেবে 'নাইওরী'সহ কয়েকটি ভাওয়াইয়া গানের অ্যালবামে তার লেখা গান শ্রোতা মহলে জনপ্রিয় হয়েছে। আধুনিক, ভাওয়াইয়া, গণসংগীতসহ বিভিন্ন গান লিখে চলেছেন। তার লেখা কুড়িগ্রাম জেলার ব্র্যান্ডিং গান 'হামার কুড়িগ্রাম' দারুণ জনপ্রিয়। তিনি রংপুর বেতারের আধুনিক গানের তালিকাভুক্ত গীতিকার। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত আছেন।
একজন সফল সংগঠক হিসেবে তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কুড়িগ্রামের মুক্তি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, দিশারী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, দিশারী পাঠাগার, তরুণ লেখক ফোরামসহ বেশ কিছু সংগঠন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা, কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি সম্মাননা, রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সম্মাননা, সলিডারিটি সম্মাননা, অরুণিমা সাহিত্য সম্মাননা ও দিশারী সম্মাননা। সম্প্রতি অনলাইনে আব্দুল খালেক ফারুকের মুখোমুখি হয়েছেন বর্ণপ্রপাত। নিম্নে পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
বর্ণপ্রপাত : আপনার শৈশব বা গ্রামের পরিবেশ কি আপনাকে লেখালেখিতে টেনে এনেছে? কীভাবে সেই প্রভাব আপনার লেখায় প্রতিফলিত হয়?
আব্দুল খালেক ফারুক: আমার জন্ম গ্রামে। বেড়ে ওঠা গ্রামেই। মাঝে অল্প কিছুদিন শহরে ছিলাম। মূলত লেখালেখির চর্চাটা আমার শৈশবের অনুসঙ্গ। অনেকটা সহজাত বলা যায়। যা হাসি কান্না বেদনা তথা প্রাত্যহিকতার সঙ্গে মিলেমিশে আছে। গ্রামের বিচিত্র মানুষের চরিত্র পর্যবেক্ষণ, রেডিও শুনে কিংবা বই পড়ে লেখালেখির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। সংগত কারণে গ্রামীণ পরিবেশ, ভাষা ও বিচিত্র সেই মানুষগুলো লেখার ভাষায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
বর্ণপ্রপাত : আপনি একাধিক সাহিত্যধারায় লিখেছেন-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক। এই ধারাগুলোর মধ্যে কোনটিকে আপনি আপনার প্রধান আত্মভাষ্য মনে করেন? কেন?
আব্দুল খালেক ফারুক: প্রথম জীবনে সবাই কবিতা লেখে। আমিও তাই করেছি। তবে কবিতার পাশাপাশি আমি স্কুল জীবনেই নাটক ও গল্প লেখায় ঝুঁকে পড়ি। ক্লাশ এইটে পড়ার সময়েই আমি কয়েকটি নাটক লিখি। মঞ্চায়নের চেষ্টাও করি। সেই দিক থেকে গল্প ও নাটকের প্রতি পক্ষপাত থাকতেই পারে। তবে উপন্যাসে একটা বড় ক্যানভাস ধরে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরার চেষ্টা করি। আর কবিতার প্রতি ভালোবাসা, সেতো চিরায়ত। কথা সাহিত্য, নাটক ও গান- এই তিনটাতেই আগামীতে বেশি ফোকাস দেয়ার ইচ্ছে আছে।
বর্ণপ্রপাত : আপনার লেখায় গ্রামীণ সমাজ, প্রান্তিক মানুষ ও বাস্তবতার এত জোরালো উপস্থিতির পেছনে কী অভিজ্ঞতা বা দায়বোধ কাজ করেছে?
আব্দুল খালেক ফারুক: অবশ্যই তুমুলভাবে দায়বদ্ধতা অনুভব করি। মনে হয় প্রান্তিক মানুষগুলোর এই গল্পগুলো সবার জানা দরকার। সেক্ষেত্রে আমি রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অবববাহিকার জীবনচিত্র তুলে আনার চেষ্টা করি। এভাবে ভাষা ও সময়কে ধরে রাখার একটা প্রবল দায়বদ্ধতার কথা মনে রাখি। তবে আফসোস, বেশিরভাগ পাঠকরা এসব গল্প না পড়ার কারণে রস আস্বাদন করতে পারেন না।
বর্ণপ্রপাত : আপনার সাহিত্যিক ভাষা-যেটি কখনো কাব্যিক, কখনো আঞ্চলিক,সেটা কীভাবে গড়ে উঠেছে? এই ভাষা নির্মাণে আপনি কাদের দ্বারা প্রভাবিত?
আব্দুল খালেক ফারুক: প্রত্যেক লেখক মনে হয় তার সমাজ ও সময় দ্বারা প্রভাবিত হয়। এক্ষেত্রে আমিও ব্যতিক্রম নই। সহজ সরল ভাষায়, ঝরঝরে গদ্যে লেখার চেষ্টা করি। কখনও কাব্যময়তা আসে অনিবার্যভাবে। আর আঞ্চলিকতা আসে দায়বদ্ধতা, যাপিত জীবনের অভ্যাস ও সমাজ ভাবনা থেকে; সহজে প্রকাশ করা ও সময়কে ধরে রাখার তাগিদ থেকে।
বর্ণপ্রপাত : গল্প বা উপন্যাস লেখার সময় আপনি কী আগে পটভূমি ভাবেন, নাকি চরিত্রগুলো নিজে থেকেই গল্প তৈরি করে?
আব্দুল খালেক ফারুক: কখনও পটভূমি ভেবে নিয়ে শুরু ও শেষ করি। মাঝখানে কিছু চরিত্র, কাহিনী ও বর্ণনা আসে লেখার তালে তালে। আবার কখনও লিখতে লিখতে আনন্দের সঙ্গে চরিত্র এসে উঁকি দেয়। কথা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে প্লট খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষ্ময়কর হলেও সত্য, কখনও স্বপ্নেও প্লট আসে। আবার লেখার সময় হঠাৎও ১০-২০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা দারুণভাবে পরম্পরা সৃষ্টি করে; অনেক সময় আমি নিজেই অবাক হই। কী করে মিলিয়ে দিলাম। লেখকের এই আনন্দটাই তাকে লিখতে বাধ্য করে।
বর্ণপ্রপাত : আপনার প্রবন্ধে ব্যক্তিগত মত ও সামাজিক বিশ্লেষণ খুবই ভারসাম্যপূর্ণ-আপনি কীভাবে এই দুইয়ের মধ্যে সীমারেখা টানেন?
আব্দুল খালেক ফারুক: তুলনামুলকভাবে প্রবন্ধ আমি কম লিখেছি। সম্পাদকীয়, উপ সম্পাদকীয় ও কলাম লিখেছি অনেক। আর প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যত বেশি তথ্য ও তত্ত্ব¡ দেয়া যায়, চেষ্টা করি। তবে লেখা দুর্বোধ্য না করে প্রাঞ্জলতার দিকে লক্ষ্য রাখি বেশি।
বর্ণপ্রপাত : নাটক লেখার সময় আপনি কি পাঠকের অনুভূতির চেয়ে মঞ্চের প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ব দেন, নাকি দুইয়ের সংমিশ্রন ঘটে?
আব্দুল খালেক ফারুক: নাটক লেখা ও পরিচালনা দুটো ভিন্ন কাজ। তবে আমি এ দুটো কাজ একসঙ্গে করেছি, যখন নিজের লেখা নাটক পরিচালনা করতে হয়েছে। অনেক সময় মঞ্চ পরিকল্পনা মাথায় রেখে নাটক লিখতে হয়। কী সম্ভব, কতটুকু সম্ভব-তার উপর ভিত্তি করে দৃশ্য সাজাই। যেমন আমার সংগঠন দিশারী যে এলাকায়, সেখানে নারী নাট্যকর্মী পাওয়া মুশকিল। তাই নারী চরিত্র বাদ দিয়ে লিখতে হয়। দর্শক ধরে রাখতে প্রচুর হিউমার রাখতে হয়। যেটা খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ।
মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, সমাজের অসঙ্গতি, অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো খুব তীর্যকভাবে আনার চেষ্টা করেছি। যা অনেকের কাছেই নন্দিত হলেও কেউ কেউ নাটকের চরিত্রের সঙ্গে নিজেদের মিল দেখে বৈরীতা তৈরী করেন। বাংলাদেশ বেতারের জন্যও নাটক লিখছি। প্রচারও হচ্ছে। সম্প্রতি নাট্যরুপ দিয়েছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোটগল্প ‘নিশীথে’।
বর্ণপ্রপাত : আপনার কোনো বই বা লেখা কি আছে যা লিখে আপনি নিজেও ভেঙে পড়েছিলেন বা নিজেকে নতুন করে চিনেছিলেন?
আব্দুল খালেক ফারুক: আমি হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত। তাঁর লেখা নাটক ও উপন্যাস আমাকে মুগ্ধ করে। আমার লেখা উপন্যাসে এমন একটি চরিত্র আছে, নাম ইতু। তার চোখ দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতাকে রম্যতার ছলে দেখাতে চেয়েছি। লেখার স্টাইল ও চরিত্র চিত্রন দেখে অনেকেই বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ করছি। সেটা পাঠকের বিবেচনা। তবে আমি আমার মতো করেই লিখেছি। এ ক্ষেত্রে অন্য কোন লেখকের প্রভাব আসতেই পারে। আর নিজের মনের মতো করে এখনও লিখতে পারিনি, এই অতৃপ্তি নিয়েই কাজ করে যাই।
বর্ণপ্রপাত : আপনি যেভাবে রম্য রচনায় সামাজিক ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও বুদ্ধিদীপ্ত পর্যবেক্ষণ ফুটিয়ে তোলেন-এই রম্যভাষা আপনি কীভাবে আয়ত্ত করেছেন? এতে কাদের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন?
আব্দুল খালেক ফারুক: আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি, বা আত্মীয়তার সুত্রে পাশের গ্রামে গিয়েছি- এই এলাকায় প্রচুর রসিক মানুষ ছিল বা আছে। তাদের কার্যকলাপ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। নিজেই সেই রসের স্রোতে ভেসে গেছি। রসিক মানুষদের ভক্ত হয়েছি। যাত্রা, নাটক, পালা দেখেছি। সঞ্জিব চট্রপাধ্যায়ের মত লেখকের লেখা বেশি পড়েছি। আমি রম্য লেখতে ভালোবাসি। নাটক, গল্প বা উপন্যাসে রম্য ধারাটাকে টেনে নিয়ে যেতে চাই। লেখা পড়ে দার্শনিক উপলব্ধি হোক না হোক, পড়ার সময়টা যেন আনন্দময় হোক সেটা চাই। আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ আর রম্য ছাড়া কঠিন কথা বলাতো সহজ নয়।
বর্ণপ্রপাত : আপনার জীবনের এমন কোনো ঘটনা আছে কি, যা আপনাকে লেখক হয়ে উঠতে বাধ্য করেছে বা লেখালেখির পথ বদলে দিয়েছে?
আব্দুল খালেক ফারুক: আমি অনেকবার ভেবেছি, আমার জীবনটাই একটা গল্পের ক্যানভাস। নানা উত্থান-পতন, আশা-নিরাশা, সাফল্য-ব্যর্থতা; জীবনকে দেখার দারুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে পুরোটা সময়। তবে আমি দক্ষ লেখক নই বলে সেসব অভিজ্ঞতার গল্প তুলে আনতে পারিনি। তবে যা লিখি, সেসবতো অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন।
বর্ণপ্রপাত : আপনার কিছু গান বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে কুড়িগ্রামকে নিয়ে আপনার লেখা বন্ধু ‘আইসেন বন্ধু হামার কুড়িগ্রাম’ দারুণ জনপ্রিয়। গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আব্দুল খালেক ফারুক: আমি আধুনিক, গণসংগীত, ভাওয়াইয়া ও বিষয়ভিত্তিক গান লিখে চলেছি। বাংলাদেশ বেতারে আধুনিক গানের গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছি। সামনে লক্ষ্য ভাওয়াইয়া গানে তালিকাভুক্ত হওয়া। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য মাধ্যমেও গানকে নিয়ে যেতে চাই। আমি কৃতজ্ঞ যে আমার লেখা বেশ কয়েকটি ভাওয়াইয়া গান শ্রোতারা পছন্দ করেছেন।
বর্ণপ্রপাত : আপনি যদি নতুন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের জন্য তিনটি পরামর্শ দেন, সেগুলো কী হতো?
আব্দুল খালেক ফারুক: অবশ্যই প্রচুর পড়তে বলবো। নবীন ও প্রবীন লেখকদের লেখা। বাংলা ভাষাভাষি যে কোন লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাদের ভাষা, ও স্টাইল লক্ষ্য করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রচুর লিখতে হবে। প্রচার না হলেও লিখতে হবে।
বর্ণপ্রপাত : আপনার চোখে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কেমন? আপনি কী ধরনের সাহিত্য চর্চা আগামী দিনে দেখতে চান?
আব্দুল খালেক ফারুক: প্রযুক্তির বিকাশের কারণে বইয়ের পাঠক কমে গেছে। পেশাদার লেখকদের যেখানে টিকে থাকতে সমস্যা হচ্ছে, সেখানে তরুণ ও নবীণ লেখকরাতো সংকটে আছেনই। যারা লেখালেখি করেন এর বাইরে পাঠকের সংখ্যা নগন্য। সামাজিক অস্থিরতা ও সোশ্যাল মিডিয়ার অতি ব্যবহারের কারণে এমনটি হচ্ছে। তবে হয়তো এক সময় আবার পরির্বতন আসবে। ক্লাসিক সাহিত্যের প্রতি নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হয়ে উঠবে। আর আগামীতে যারা লিখনে, তারা সমাজ বাস্তবতার আলোকে লিখলে সেটা অধিকতর গ্রহনযোগ্য হবে।
বর্ণপ্রপাত : ধন্যবাদ আপনাকে।
আব্দুল খালেক ফারুক: তোমাকেও ধন্যবাদ।

আব্দুল খালেক ফারুক ভাল মানুষ এবং বহুমার্তৃক গুনের অধিকারি। একাধারে লেখক,সাংবাদিক, শিক্ষক, সংগঠক ও গীতিকার। আমি সব সময় তার মঙ্গল কামনা করি।
ReplyDeleteইতিহাসে চোখ রাখলেই দেখা যায় পৃথিবীর বড় লেখকরা সমাজের দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ দ্বারা অযাতিথ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হয়েছে। তারা দমেনি। আরও সানিত মানুষ হিসাবে গড়ে তুরেছেন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
Deleteরম্য লেখক আব্দুল খালেকের কাছ থেকে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যত জানতে চেয়েছেন। হাস্যকর কে? রম্য লেখক নাকি ক্লাউন সম্পাদক?
ReplyDelete