সামাজিক অবক্ষয় রোধের এখনই উপযুক্ত সময় ।। মোঃ আইনাল হক

 


সমাজবিজ্ঞানী গিডিংসের মতে, সমাজ বলতে আমরা সেই জনসাধারণকে বুঝি যাঁরা সংঘবদ্ধভাবে কোন সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিলিত হয়েছেন। ( Society is a number of like-minded individuals who know and enjoy their like-mindness and are therefore able to work together for common ends.) 
সমাজ গঠনের মূল উপাদান মানুষ। সমমনা বা বিপরীত মনা কিছু সংখ্যক মানুষের সমন্বয়ে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মূলত সমাজ গঠিত হয়। সমাজে একসাথে বিপদে আপদে একে অপরের পরিপূরক হয়ে জীবন যাপন প্রক্রিয়াই সামাজিক জীবন। সমাজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে সমাজ বিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, "যে সমাজে বাস করে না, সে হয় পশু নয় দেবতা"। সমাজে বসবাসরত প্রত্যেকটি মানুষ কোন না কোন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পরিবার থেকে আগত শিশু সামাজিক পরিবেশে বেড়ে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে উঠে। আর একজন মানুষের সুনাগরিক অথবা এর বিপরীত হয়ে গড়ে উঠতে প্রধান ভূমিকা পালন করে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা।
বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ, সহনশীলতা, ধর্মীয় অনুশাসন এ বিষয়গুলো শিশু মূলত পরিবার থেকেই শেখে। পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে জনৈক এক মনিষী বলেছেন, পরিবার হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার বুনিয়াদ। অর্থাৎ যাবতীয় শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার থেকেই শুরু হয়। তাই এ কথা বলা যেতে পারে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত হবার স্বীকৃতি প্রদান করলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। শিক্ষা প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, "স্কুলে যা শেখানো হয়, তার সবটুকু ভুলে যাবার পর যা থাকে; তাই হলো শিক্ষা।"
শিশু যে পরিবেশে বেড়ে উঠছে তার উপর নির্ভর করে তার পরবর্তী দিনযাপন প্রক্রিয়া। ভালোই বলুন আর মন্দই বলুন সিংহভাগ নির্ভর করে শিশু এবং কৈশোরে কাটানো সময়ের উপর। বর্তমানের সমসাময়িক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সীমাহীন সামাজিক অবক্ষয় চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দূর্বিষহ ভবিষ্যৎকে নিরূপণ করছে। এক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতায় জাতি গভীর ভাবে শঙ্কিত। বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্দেশনাহীন লাইফ স্টাইল বিবেকবানদের দৃষ্টি এড়াতে পারে নি। জলের মতো মাদকের অবাধ বিস্তার, চিন্তা ও চেতনায় দেশপ্রেমের গভীর অনুপস্থিতি, ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের নীতিবহির্ভূত অপব্যবহার ও আসক্তি, লক্ষ্য নির্ধারণে অপারগতা, ঠুনকো জিনিসের প্রতি অতি মনোনিবেশ আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণদের কোন পথে পরিচালিত করছে? 
ছোট ছোট অপরাধ ও অপরাধীর শেল্টার পরবর্তীতে বড় অপরাধের জন্ম দেয়। আইনের ফাঁকফোকড় অথবা বাস্তবায়নের অপারগতাও অপরাধ প্রবণতাকে উস্কে দেয়। বর্তমানে মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠা কিশোর গাং আমাদের সার্বিক অব্যবস্থাপনার ফসল। অতি সম্প্রতি রাজশাহীতে প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র প্রদর্শন করে তাদের প্রদর্শিত মোহড়া শান্তিপ্রিয় মানুষদের শঙ্কিত করে। যদিও অনেক চিন্তাবিদ করোনার সাইড ইফেক্ট হিসেবে কিশোর গাং এর উৎপত্তি বলে মতবাদ ব্যক্ত করলেও রাষ্ট্র এখনও নির্বিকার। সামাজিক অবক্ষয়ের এ বড় উপাদানকে নির্দেশনা প্রদান করা না গেলে জাতিকে পস্তাতে হবে। মানুষের প্রতি সহমর্মিতার মতো বড় গুণ আর কি আছে? অথচ পৃথিবীর অর্থনীতি বলছে দিন দিন ধনীরা ধনী হচ্ছে আর গরীবরা আরো গরীব হচ্ছে। কোন্ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সমাজ এ বৈষম্য রোধের শিক্ষা প্রজন্মের মাঝে বিতরণ করছে, এ প্রশ্ন রেখে দেওয়া যেতেই পারে? সর্বসাকুল্যে বাস্তবতা হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ মানুষের জন্য হতে পারছে না। 
ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে অনুকরণ প্রিয় জাতি হিসেবে যে ভুল চর্চায় আমরা লিপ্ত হয়েছি তার শেষ কোথায়? অনুসরণ শ্রেয়; জগৎ বিখ্যাত মনিষী ও জ্ঞানীদের এবং বিশেষ করে জাতির সূর্য সন্তানদের অবদান অনুসরণ করে আমরা নিজেদের তৈরি করবো, দেশ ও দশের কল্যানে নিজেকে নিয়োজিত করবো তবেই তো মানব জীবনের আসল উদ্দেশ্য সাধন হবে, জন্ম সার্থক হবে। অথচ আমার প্রজন্ম মরিচীকাকে অনুকরণ করে ব্যক্তি জীবন সাজাতে গিয়ে না পারছে তার আইডল হতে, না পারছে নিজের হতে; মাঝখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় আমি। ফলশ্রুতিতে যে সংকর চরিত্র তৈরি হচ্ছে তা জাতির প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু অবদান রাখবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। 
বিশ্বাস ও ভক্তির তীব্র সংকটের দিকে কিভাবে জাতি ক্রমশঃ ধাবিত হচ্ছে এ চিত্র প্রদক্ষিণের জন্য আমাদের প্রখর দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন না হলেও চলবে। গভীর অনাস্থার সুপ্ত বীজ সংগোপনে প্রজন্মের মাঝে  যেভাবে রোপিত হচ্ছে তার দায়ভার কার উপর বর্তায়? নানান সামাজিক অস্থিতিশীলতা যেভাবে তরুণদের কোমল মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলছে তার ফলাফল জাতিকে মূল্য দিয়ে শোধ করতে হবে।
এখনই উপযুক্ত সময়; সাম্যের দৃষ্টিতে সমগ্র জাতি ও সার্বভৌমত্বকে উপলব্ধি করে নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থে মানবিক মানুষ তৈরি করা। সামাজিক অবক্ষয় রোধে 
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রবল সম্ভাবনাময় জাতি হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে দৃঢ় অবস্থানের জন্য আমাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার সার্বিক দীক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের প্রতি মনোনিবেশ আশু প্রয়োজন। যাদের হাতে আগামীর বাংলাদেশ তাদের তত্বাবধান রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।


মোঃ আইনাল হক
সহকারী শিক্ষক
তেঁতুলিয়া ডি বি উচ্চ বিদ্যালয়
মান্দা নওগাঁ

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post