তখন রাত্রি, ঘড়িতে তখন বারোটা বাজে। পূর্ণিমার চাঁদের কিরণ রায় ভবনের ছাদের উপর হীরার তৈরি বিশাল ত্রিশুল খন্ডে আলো বিকিরণ করছে। মনরম পরিবেশ। রায় এম্পায়ার ঢাকার সবচেয়ে বড় বিজনেস কোম্পানি। বাংলাদেশের ধ্বনিদের মধ্যে রায়রা অন্যতম। ঢাকার ধানমন্ডিতে বিশাল প্রাসাদ, ভবনের নাম "রায় ভবন"। চাকর কর্মী দিয়ে পূর্ণ বাড়ি। ঢাকার মতো শহরে প্রায় নব্বই বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই রায় ভবন। স্থানীয়রা এই বাড়িকে রাজবাড়ী বলেই চেনে। বাড়ির একপাশে দীর্ঘ বাগান, পুকুর। বিচিত্র প্রজাতির ফল, ফুল, সবজি চাষ হয়। বিচিত্র পাখির কিচির মিচির শব্দে বাগান সবসময় পূর্ণ থাকে। সন্ধ্যার পর পাখিরা তাদের বাসায় নির্ভয়ে ঘুমায়। এ যেন পাখিদের অভয়ারণ্য। বাগান পরিচর্যার জন্য ২০ জন মালি নিযুক্ত আছেন। রায় ভবনের খাওয়া দাওয়ার কোনো শাকসবজি ফলমুল, মাছ বাহির হতে কিনতে হয় না, সব নিজেদের চাষকৃত। রায়রা বেশ সংস্কৃতিমণা, যাকে বলে খাঁটি বাঙালি। পহেলা বৈশাখ, শারদীয় উৎসব সবই বড় ধুমধামে পালিত হয় এখানে৷ বিশাল পরিবার রায়দের। বিশজন সদস্য। বড় রায় সাহেব, তার চার ছেলে তাদের বউ এবং আরও অনেক আত্মীয় স্বজন বাস করেন এই রায় ভবনে। বড় রায় সাহেবের নাম সৌরিক রায়, বিখ্যাত বিজনেস ম্যান, দেশে বিদেশে তার সেই কি খ্যাতি। তাঁর চার ছেলে সৌমিক রায়, সাত্যকি রায়, সুহৃদ রায়, শান্তনু রায়। কিন্তু দু:খের বিষয় রায় সাহেবের নাতি নাতনী বলতে শুধু একজন আছে তিনি হলে তাঁর বড় ছেলে সৌমিক রায় ও তার স্ত্রী সুধা রায়ের একমাত্র ছেলে সুহাস রায়। অন্য ছেলেদের বাচ্চা হয় নি। এজন্য রায় সাহেবের বড় মনখারাপ থাকে। সুহাস রায় রায় বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারি। ছোটবেলা থেকে একজন বিজনেসম্যান হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন সুহাস। তার শৌর্যবীর্য এর প্রশংসা চারদিকে। একজন ইয়াং বিজনেস আইকন সুহাস রায়। সুহাসের বিয়ে হয় শর্মা ইন্ডাস্ট্রির রতন শর্মার মেয়ে রায়ার সাথে। বাংলাদেশের সবচেয়ে জাকজমক পূর্ণ বিয়ে ছিল এটি, তবে ছিল সবচেয়ে ব্যতিক্রম। অন্যান্য বড়লোকদের মতো লোকদেখানো সব বিজনেসম্যানদের ডেকে এই বিয়ে হয় নি। বরং বিশাল আয়োজন করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের সব দরিদ্র মানুষকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। পরম শ্রদ্ধার সাথে তাদের আপ্যায়ন করেছেন রায় পরিবার৷ সাধারণ মানুষ বলাবলি করছিল জীবনে তারা স্বর্গীয় ভোজ করল। দীর্ঘ ১০ দিন ধরে প্রায় ৩ কোটি দরিদ্র মানুষকে রাজভোগ খাইয়েছেন রায় সাহেব। সবার কাছে আশীর্বাদ ও দোয়া চেয়েছেন, "যেন তাঁর সংসারে এবার শিশুদের কলকলানিতে ভরে ওঠে।" সবাই অনেক আশীর্বাদ করেছে। রায় সাহেবদের এই পুণ্য কর্মে প্রকৃতিও বুঝি বেশ আনন্দিত। বিয়ের দিন একদল পাখি বায় ভবনের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল তাদের ঠোঁট থেকে পুষ্পের পাপড়ি নব দম্পতির উপর পড়েছিল। যেন স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি হচ্ছে। দেশ বিদেশের বড় বড় পত্রিকায় এই অভিনব বিয়ের সংবাদ ছাপা হয়েছে। এরপর সময় হেসে খেলে কাটতে লাগল। কিন্তু আবার নেমে আসল অন্ধকারের ঘন ছায়া। বছর বছর করে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলো কিন্তু রায়া ও সুহাসের কোনো সন্তান হয় না। রায় সাহেব দেশ বিদেশের বড় বড় ডাক্তার দেখালেন, বড় বড় উপাসনালয়ে মাথা ঠুকলেন তবুও কিছু হলো না। এরপর IVF পদ্ধতিতে কৃত্রিম ভাবে সুহাস ও রায়ার ডিম্বানু ও শুক্রানুর মিলন ঘটিয়ে এক ভিন্ন নারীর গর্ভে স্থাপন করা হলো৷ তাঁর নাম ছিল রুহী। রুহীর গর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল রায় বংশের বংশধর। রায় সাহেব দুনিয়ার সব সুযোগ সুবিধা রুহীর জন্য এনে দিলেন যেন সে কোনো দেবকন্যা এমন সুবিধা সে পাচ্ছিল। দিন যায়, রাত যায়, মাসের পর মাস যায়। কিন্তু রায় পরিবারের মনে হচ্ছিল যেন ঘড়ির কাঁটা নড়ে না, পৃথিবীর গতি বুঝি কমে গেছে। অত:পর নয়মাস পর রুহীর প্রসব বেদনা উঠল। রায় পরিবার একই সাথে আনন্দিত ও ভীত। তখন ছিল শীত কাল। সপ্তাহ খানিক থেকে রোদ ওঠে না। প্রচন্ড কুয়াশা। এমন এক সকালে রুহীর প্রসব বেদনা উঠেছে। কুয়াশা প্রচন্ড ছিল, চারদিকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ দেখা দিলো। যেন প্রকৃতি আজ আনন্দিত, কোনো সুখবর আসছে। রুহীকে নিয়ে যাওয়া হলো বাংলাদেশের বিখ্যাত ক্লিনিকে। হঠাৎ অপারেশন থিয়েটার থেকে বাচ্চার ক্রন্দন ধ্বনি শোনা গেল। ডাক্তার সাহেব বাচ্চা নিয়ে এলেন বিষন্ন মুখে। বাচ্চা দেখে সবাই খুশি হলেও ডাক্তারের মুখ দেখে সবাই আতঙ্কে জিজ্ঞাস করল "কি হয়েছে?" ডাক্তার সাহেব বললেন, "মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ। কিন্তু! "
রায় সাহেব বললেন, "কিন্তু কি বলুন।" ডাক্তার সাহেব বললেন, "এ সন্তান না ছেলে না মেয়ে, এ তৃতীয় লিঙ্গের একজন।" শুনে বাচ্চাকে কোলে নিতে হাত বাড়ানো রায়ার হাত নিচে পরে গেল। সবাই কাঁদছে। তারপর এই বাচ্চাকে পরিত্যাক্ত করে রুহীকে প্রচুর টাকা দিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ এ জানাজানি হলে বংশের নাম ডুববে! রায়া ও সুহাসও এই সন্তানের মুখ দেখতে চায় না। তখন হঠাৎ প্রকৃতির চারদিক অন্ধকার হয়ে আসলো। এই শীত কালে হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে গেল আকাশ, তীব্র বজ্রপাত হচ্ছে। যেন শিশুর এই প্রত্যাখানে কুপিত প্রকৃতি তার ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কিন্তু সারোগেট মা রুহী নিলেন বাচ্চার দায়িত্ব, একে সমাজের মুল ধারার একজন করে তোলার সংকল্প গ্রহণ করলেন। রায় পরিবারের দেয়া অনেক টাকা ব্যাংকে রাখলেন রুহী। তারপর সেই টাকা দিয়েই বড় করতে লাগলেন বাচ্চাটিকে। বাচ্চাটির নাম দিলেন, "বৃহন্নলা রায়"। গান্ডীব ধারী অর্জুনের মতো তেজী হবে এই শিশু, করবে বিশ্বজয়। প্রকৃতি যেন বৃহন্নলাকে বরণ করে নিলো। ঝলমলে রোদের কিরণ বাতায়ন দিয়ে বৃহন্নলার উপর পড়ল। বৃহন্নলা বড় হতে থাকে। সমাজের অনেক লাঞ্চনা সহ্য করতে হয় তাকে। সে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্ধিহান।৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাগজে নাম পুরোন করার সময় লিঙ্গের জায়গায় ছেলে বা মেয়ে ছাড়া আর কিছু লেখা নেই। বাধ্য হয়ে রুহী বৃহন্নলাকে ছেলে হিসেবে পরিচয় দেয়। কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় তার কাছে লুকিয়ে রাখে নি। ছোটবেলা থেকেই বৃহন্নলাকে তার পরিচয় জানিয়েছেন, আর শিখিয়েছেন, " সেও মানুষ, এই সমাজের মুলধারায় তাকে সংগ্রাম করে জায়গা করে নিতে হবে। অনেক বাধা আসবে তবুও যেন সে না থামে।" মায়ের অনুপ্রেরণায় বৃহনল্লা মাত্র আঠারো বছর বয়সেই স্নাতকোত্তর পাস করল। ছোটবেলা থেকেই সে বিজনেস আইডিয়ার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। শত বাধা পেরিয়ে বৃহন্নলা হয়ে উঠল বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের তরুণ বিজনেস আইকন। তাকে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে কিন্তু তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বৃহন্নলার কোম্পানির নাম দ্য থার্ড জেন্ডার কর্পোরেশন। এখানে চাকরিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রাধান্য দেয়া হতো। শীঘ্রই বাংলাদেশে বৃহন্নলার নেতৃত্বে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সমাজের মুলধারায় ফিরে আসতে শুরু করে। এইরকম শিশুদের অধিকার ও কাগজে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন রাখার দাবি আদায় করেন দ্য থার্ড জেন্ডার কর্পোরেশন। বাবা মায়েরা এখন তৃতীয় লিঙ্গের বাচ্চাদের নিয়ে সচেতন হতে শুরু করলেন। এইদিকে রায় বংশে যেন অমাবস্যা ঘনিয়ে এসেছে। উত্তরাধিকার সংকট ও বিজেনেসে লস দুই নিয়ে বড় রায় সাহেব অসুস্থ বিছানা শুয্যা। এর মধ্যে বৃহন্নলা রায় ইন্ডাস্ট্রি টেক ওভার করলেন। রায় সাহেবের সামনে গেলে রায় সাহেবের মনে পরে যায় তার সেই উত্তরাধিকারের কথা। রায় সাহেব অনুতপ্ত। তখন বৃহন্নলা তাঁর আসল পরিচয় দিলে বিস্ময়ে ও বিচিত্র অনুভুতিতে ভেঙে পড়ে রায় পরিবার। তারা বৃহন্নলাকে আপন করে নিতে চায়। সন্তানহীন রায়া ও সুহাস তার কাছে ক্ষমা চায়। বৃহন্নলা সবাইকে ক্ষমা করে দেন এবং তার মা রুহীকে নিয়ে রায় পরিবারে বাস করতে থাকেন। ব্যবসার ব্যাপক উন্নতি দেখে বড় রায় সাহেব ব্যাপক খুশি। তবে তিনি আবার ভেঙে পড়েন বৃহন্নলার পর এই বংশের কি হবে? বৃহন্নলা শোনান আশার বাণী, "শুনুন তবে, বিজ্ঞান উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। আমি অর্ধ নারী অর্ধ পুরুষ। দুই লিঙ্গের হরমোন আমার মধ্যে আছে। তাই আমি দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে আমারই শরীরের ভিন্ন দুই লিঙ্গের অর্ধ উন্নত হরমোনকে বিশেষায়িত করে এক সন্তানের জন্ম দিচ্ছি কৃত্রিম গর্ভে। আজ তার জন্ম হবে।" সব শুনে রায় সাহেব অনেক খুশি। এবার হাসপাতালে আবার কান্নার আওয়াজ এল। ডাক্তার বিষন্নমুখে এসে বললেন, "তৃতীয় লিঙ্গের সন্তান হয়েছে।" কিন্তু এবার আর রায় পরিবার বিষন্ন নয়। মহানন্দে তারা নতুন শিশুকে বরণ করলেন। বড় রায় সাহেব এই শিশুর নাম রাখলেন, "শিখন্ডী রায়"। তখন ছিল বর্ষাকাল। টানা কয়েকদিন থেকে প্রবল বৃষ্টি, আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘোষণা করেছে ঢাকায় আরও দুই সপ্তাহ প্রবল বৃষ্টি হবে, সূর্য ওঠার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু শিখন্ডীর জন্মের দিন প্রকৃতি যেন নিয়ম বিরুদ্ধ হয়ে গবেষকদের বাণীকে মিথ্যে প্রমাণ করে আকাশে সূর্যের দেখা মিলল। এরপর সুখে কাটল বছর খানেক৷ এর কিছুকাল পর বড় রায় সাহেবের মহাপ্রয়াণ হলো। প্রকৃতির নিয়মে শিখন্ডীও বড় হতে শুরু করল। বৃহন্নলার নেতৃত্বে শুরু হলো সমাজে নতুন পরিবর্তন।
লেখক: সেঁজুতি মুমু, শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

Golpo ta joss apu 🥺valoi laglo pore 🙂
ReplyDeleteইসলামবিরুদ্ধ লেখা ছাপাইলি জরিফ। কাজটা ভালো করলি না। তোর শাস্তি আল্লাহ করিম না দিলে আমরাই দিব। প্রস্তুত থাকিস।
ReplyDelete