নূর আল দ্বীন ইফ্ফাতের গল্প "শফিক চাচা"

 নূর আল দ্বীন ইফ্ফাত

প্রচুর শক্তির অধিকারী এক যুবক শফিক চাচা। হাতে অস্ত্র থাকলে বাঘকেও হার মানাতে পারবে সে। ভ্যান চালালেও , সবসময় ভারি ভারি খড়ির স্তুপ বয়ে চলায়, তার শরীরে প্রচুর শক্তি। এখন আমরা সবসময় মোটর চালিত যান /যানবাহন দেখে থাকি। তার গাড়িতে কোনো মোটর নেই। এ সম্পর্কে তাকে কিছু বললে সে বলে, ”এহন তো মানুষেরেও মোটর দিয়া চালানো হয়, তাইলে ‍কি আমি নিজেরেও মোটর দিয়া চালামু?”
 সে তার হতদরিদ্র অবস্থার কথা কাউকে বলেন না। আমরা তার মুখ থেকে শোনার জন্য অনেকবার চেষ্টা করার পরেও সে নিজ মুখে তার হতদরিদ্র অবস্থার কথা স্বীকার করেননি। রোগ-বালাই এর চিহ্নমাত্রও না থাকায় সে নিশ্চিন্তে ভ্যান চালিয়ে বেরাতেন। বস্তিতে থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে তিনি আমাদের সাথে দেখা করতে আসতেন। আমাদের পাড়ার এক লোক খড়ির ব্যবসা করেন। আগে শফিক চাচা নিয়মিত তার কাছ থেকে খড়ি নিয়ে যেতেন।

একদিন শফিক চাচা দ্রুত ভ্যান চালিয়ে আসছিলেন। বস্তির গলিতে শফিক চাচার বড় ভ্যান ঢোকানো যায় না। তাই সে বস্তির পাশে একটা খোলা জায়গায় ছোটখাটো একটা গ্যারেজের মতো ঘর বানিয়েছেন। নিয়ম মাফিক সেখানে ভ্যান রেখে শফিক চাচা নিজেদের ঘরে গেলেন। দরজা পার হতে না হতেই গলা ফাটিয়ে বলে উঠলেন, ”আরে! ফেফার আনছি রে !” কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেই স্ত্রী রহিমা ও ছেলে রহিম বেরিয়ে এল। প্রথমে পেপারটি হাতে নিলো রহিম, হাতে নিয়েই প্রথমে বাবাকে প্রশ্ন করলো, ”হেইডা কুনো খাওয়া?” শফিক চাচা হাসতে হাসতে বললেন, ”ফেফার কুনোদিন খাওয়া হয়?” বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন শফিক চাচা ও রহিমা চাচি।

পেপারটি ভালোভাবে নেড়েচেড়ে রহিমা চাচি বললেন, ”তাইলে নতুন একটা রুগ আইছে? কুরুনা নাম সুম্ভবত।” শফিক চাচা বললেন "হ, হেইডাই তো হুনলাম।খুবই নাহি ভয়ঙ্কর, সবসময় সাবধানে চলন-ফেরন লাগবো।” রহিমা চাচি বললেন, ”আইজ থেইক্কা প্রতিদিন ফেফার আনবা, তাইলে বালোবাবে সুস্ত থাকা যাইবো।”

শফিক চাচা দ্রুত ভ্যান চালিয়ে বইয়ের দোকানের দিকে যাচ্ছে। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে পেপার নিতে না পারলে পেপারের আশা ছাড়তে হয়। বইয়ের দোকানে গিয়ে শফিক চাচা বললেন, ”ফেফার আছে ভাই?” দোকানদার বললেন, ”আর একটু আগে আসলে পেয়ে যেতেন। এখন আমার কাছে কোনো পেপার নেই।” শফিক চাচা মনে মনে ভাবলেন, তাইলে ফোন কইরা কয়া দেই যে, আইজ ফেফার হবো না।

যখন শফিক চাচা রহিমা চাচির সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করলেন ঠিক তখনই দেখলেন শফিক চাচার ছোট ভাই রফিক চাচা তার দিকে হেঁটে আসছেন। সেটা দেখে শফিক চাচা বললেন, ”তোর সাতে তো দ্যাকাই হয় না আইজ-কাইল। ক, কেমন আছস?” রফিক চাচা বললেন, ”ভাইয়া, মন খারাপ করিও না। তোমার কাছে তো আমার নাম্বার আছে, তাইনা?" তুমি আমাকে রাতে ফোন করে বলে দিও আমি চলে আসবো।” শফিক চাচা বললেন, ”আচ্চা, টিক আচে, কিন্তু তুই আমার কাচে ক্যা?” রফিক চাচা বললেন, ”ওখানে একজন লোক আমাকে বলল, তিনি নাকি বিদেশ থেকে এসেছেন, তিনি এক জায়গায় যাবেন কিন্তু তিনি কোনো গাড়ি পাচ্ছেন না। তাই তোমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এলাম। ”শফিক চাচা বললেন, ”বিদেশিরা যাইবো গাড়িত কইরা, কিন্তু আমার কাচে গাড়ি তো দূরের কতা, অটো বা রিশকা পয্যন্ত নাই।” রফিক চাচা হাসতে হাসতে বললেন, ”সেটার ব্যবস্থাও করে রেখেছি। তিনি বলেছেন ঠেলাগাড়ি হলেও তিনি যাবেন।” শফিক চাচা নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ”তাইলে চল, লোকটারে দেখায়া দে।”

আজ শফিক চাচার কথা খুব মনে পড়ছে। কিন্তু এখন সে আর এদিকে আসে না। ভেবেছি বাবাকে বলবো, শফিক চাচার সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা। বাবাকে বলতেই বাবা রাজি হয়ে গেলেন। বস্তিতে ঢোকার পর আমি আর বাবা মিলে শফিক চাচার ঘর খুঁজতে থাকি। চাচার ঘর খুঁজে পাওয়ার পর আমরা দেখি ঘরে শুধু রহিমা চাচি আর রহিম মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমরা কারণ জিজ্ঞাসা করায় রহিমা চাচি যা বললেন তা বিশ্বাস করার মতো নয় ।
চাচি যা বললেন তা সংক্ষেপে এরকম-

সেদিন রফিক চাচা যখন শফিক চাচাকে বিদেশি লোকটার সাথে দেখা করিয়ে দিলেন, তখন কথামতো শফিক চাচা বিদেশি লোকটাকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিলেন।
সেদিন আসার পর থেকেই শফিক চাচার হঠাৎ জ্বর, কাশি, মাথাব্যাথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। যখন অনেক বেশি জ্বর হয়, তখন তারা শফিক চাচাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার বলেন, শফিক চাচা নাকি 'কোভিড-১৯’ [COVID-19]-এ আক্রান্ত হয়েছেন। তখন তারা বুঝতে পারেননি 'কোভিড-১৯’ আসলে কী। ‘করোনা’-ই যে আসলে ‘কোভিড-১৯’ ডাক্তার তাই বুঝিয়ে দিলেন। করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে ভয়ে ও আর্থিক সহায়তা না থাকায় শফিক চাচা মারা যান। কথাগুলো বলেই রহিমা চাচি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন।

যেদিন আমরা এখানে প্রথম আসি সেদিন হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়। যদি বর্ষাকালের মাঝামাঝি সময় হতো তাহলে কিছু যানবাহন পাওয়া যেত। কিন্তু সেদিনই নাকি সেখানে ঐ বর্ষার প্রথমবার বৃষ্টি হয়েছিল, তাই কেউ প্রস্তুত ছিল না। ফলে আমরা কোন ইজিবাইক কিংবা রিকশাও পাইনি। ধীরে ধীরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে থাকে, হঠাৎ দেখি একটা লোক দ্রুত ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তার ভ্যানে উঠে পড়ি। পরে শুনি সেদিন আসলে কালবৈশাখী ঝড় হয়েছিল।

যে লোক আমাদের আসার অপেক্ষায়, আমাদের সাথে দেখা করার আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, সেই লোক আজ নিজে চাইলে কিংবা আমরা চাইলেও তার সাথে দেখা করতে পারবো না। ইচ্ছে করছে শফিক চাচার সাথে একবার দেখা করি, বলি তোমার কথা খুব মনে পড়ে শফিক চাচা.......!

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।