আবদুুস ছাত্তার খান
একটার পর একটা ইট দিয়ে যেমন বিশাল আকারের ইমারত গড়ে উঠে যেমন গড়ে উঠে শরীর নামের প্রাকৃতিক যন্ত্রটা একটার পর একটা কোষ দিয়ে তেমনি রাষ্ট্র নামের এই বৃহৎ সামাজিক সংগঠনটিও গড়ে উঠে একটার পর একটা গ্রাম দিয়ে। শরীরের কোষগুলো হলো স্বাধীন, সয়ম্বু এবং স্বপ্রজননশীল। একেকটা যেন স্বাধীন ভূ-খণ্ড। তার শাসন পদ্ধতি, কার্যপরিধি সবই স্ব-নিয়ন্ত্রিত ঠিক আজকের দিনের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়। আমাদের শ্রী-ছাড়া, অভাবগ্রস্ত, বন্যা-খরা আক্রান্ত গ্রামগুলো দেখলে হয়ত বিশ্বাস হবে না এক সময় এই গ্রামগুলো ছিল কোষীয় গুণপ্রাপ্ত। অর্থাৎ স্বাধীন, স্বনিয়ন্ত্রিত। তাদের ছিল স্বাধীন পঞ্চায়েতী শাসন ব্যবস্থা, চাহিদামতো পণ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা, জল নিষ্কাষণ, খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সর্বোপরি একটা আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রের যা যা গুণাবলি থাকা দরকার তাই ছিল সেই সময়কার গ্রামগুলোতে।
আধুনিক যে তত্ত্বগুলো দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে তাতে শোষিত হচ্ছে গ্রামগুলো। মাড়াই কলের মতো রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে গ্রামগুলোকে নিংড়ানো হচ্ছে। ফলে আখের ছোবড়ার মতো নির্জীব হয়ে পড়ছে গ্রাম আর চাকচিক্যময় করে গড়ে তোলা হচ্ছে শহর।শহর নামের থার্মোমিটার দিয়ে বিদেশি বাবুদের বলা হচ্ছে আমাদের এত ডিগ্রি উন্নতি হয়েছে। শরীরের কোন অংশের ফুলে উঠা যেমন সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয় তেমনি গ্রামকে শোষণ করে শহরের উন্নয়ন করাও নয় সুষ্ঠু রাষ্ট্রচর্চা। অর্থাৎ আমারা বলতে চাচ্ছি রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন করতে চাইলে গ্রামের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। জীবদেহের প্রতিটি কোষ যেমন দেহ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তেমনি প্রতিটি গ্রামের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই আমাদের মতে আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের উপায়। গ্রামকে স্বাধীন, স্বনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজটাই করবে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন। গ্রামের চাহিদা, প্রয়োজন, ইত্যাদি নির্ধারণে কাজ করবে গ্রাম পাঠাগার। তারপর তৈরি করবে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা, হাতে নেবে কর্ম পরিকল্পনা, জরুরি হলে তাৎক্ষণিকভাবেই নেবে কর্মউদ্যোগ। কারো উপর ভরসা করে বা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে নয়। নিজস্ব শ্রমে, নিজস্ব অর্থায়নে সমাধান হবে সেই কাজ। আপনারা বলবেন এগুলো করতে সময় লাগে, অর্থ লাগে। হ্যাঁ লাগে, আমারা বলবো উদ্যোগ নিলে তাও হয়। কেস স্টাডিগুলোতে সে বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তবুও আলোচনার সুবিধার জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা যাক। ধরুন আপনি আপনার গ্রামের একটা তথ্যচিত্র করবেন। সেখানে থাকবে গ্রামের মোট জনসংখ্যা কত, নারী-পুরুষের সংখ্যা কত, পাঁচ বছরের নিচে বা পাঁচ বছর বয়সি কতজন, শিক্ষিত, অশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন কত জন, মোট জমির পরিমাণ, ভূমিহীনদের সংখ্যা, পেশা ইত্যাদি থাকবে সেই তথ্যচিত্রে। যা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে প্রয়োজন অনুয়ায়ী কখন কী করা দরকার। নমুনা জরিপ ফরম নিচে দেওয়া হলো:
জরিপ ফরম
গ্রামের নাম :লোকজ উৎসবের বর্ণনা : একক হিসাবে একটা ওয়ার্ডকে যদি আমরা একটা গ্রাম ধরে নিই তাহলে দেখা যায় প্রতি ওয়ার্ডে গড়ে ৫০০০/৬০০০ লোকের বাস। যদি পাঠাগারের ২০/২৫ জন সদস্য থাকে তবে তাদের পক্ষে এই জরিপ কাজটি পরিচালনা করতে ২/৩ দিন সময় লাগবে। এখন পাঠক আপনারা বলেন এই কাজটি করতে কত অর্থ লাগবে আর কত সময়ই বা লাগবে। অথচ সরকারের এই ধরনের একটি কাজ করতে কত অর্থ বা কত লোকবলেরই না অপচয় হয়। এরকম আরো হাজারো কাজ আছে যা গ্রামের লোকজন অল্প সময়ে অল্প পরিশ্রমে স্বল্প পুঁজি দিয়ে সমাধান করতে পারে।
ওয়ার্ড :
ইউনিয়ন :
উপজেলা :
জেলা :
পরিবার প্রধানের নাম :
জমির পরিমাণ :
মাসিক আয় :
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা :
মসজিদ/ মন্দির/ গির্জার সংখ্যা :
প্রাকৃতিক সম্পদের বিবরণ :
অর্থাৎ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের প্রথম কাজ হলো সমস্যা চিহ্নিত করা, স্থানীয় প্রযুক্তিতে সেগুলোর সমাধান করা।একদিনে বা হঠাৎ করে এই ধরনের মানসিকতা অর্জন করা সম্ভব নয় । ক্রমাগত চর্চার মাধ্যমেই একদিন তা অর্জন করা সম্ভব। এভাবেই একটা গ্রাম হয়ে উঠবে কোষীয় গুণপ্রাপ্ত। অর্থাৎ স্বাধীন ও স্বনিয়ন্ত্রিত। গ্রাম পাঠাগারের এই কোষীয় মডেলে নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করবে গ্রামের যুব সমাজ। মাইটোকন্ড্রিয়া বা পাওয়ার হাউজ হিসেবে কাজ করবে ইউনিয়ন পরিষদ, ক্লোরোফিল হিসেবে কাজ করবে গ্রামের পেশাজীবী মানুষ আর জিন হিসাবে কাজ করবে গ্রামের প্রত্যেকটি সদস্য। জিনোটাইপে প্রতিটি লোক থাকলেও ফিনোটাইপে কেবল প্রয়োজনীয় লোকই প্রকাশ পাবে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় যারা লাভবান তারা কখনোই এ আন্দোলনকে মেনে নেবে না। তারা নানাভাবে তুচ্ছ বা হেয় করার চেষ্টা করবে। তবুও যদি একবার মাভৈঃ বলে শুরু করা যায় তাহলে ঘুনে ধরা উপনিবেশিক মানসিকতার তল্পিবাহী এই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন একদিন হবেই।