ধারাবাহিক উপন্যাস : দিদার চৌধুরীর "হৃদয়ের কান্না" ০৪


এখানে বসুন ,বলেই ভদ্রমহিলা ভিতরে চলে গেল। একটু পরে দেখি একজন লোকসহ কিছু খানার পাত্র নিয়ে,কামরায় প্রবেশ করলো।
 অত্যন্ত বিনয়ী,রুচিকর লাজুক সুরে বলল,
: কিছু ডাল ভাতের ব্যবস্থা করেছি, গ্রহণ করলে বাধিত হবো ।
তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
: বিনয়ী হওয়ার অভিপ্রায়, নিজ প্রয়োজনে করছেন কি?
মহিলাটি এই কথার অর্থ বুঝতে না পেরে হয়তো কথাটি এড়িয়ে গিয়ে বলল,
: রাত অনেক হয়েছে বসে পড়ুন।
আমাদেরও পেটে প্রচন্ড খিদে থাকার কারণে, আমরাও বসে পড়লাম।
ভদ্রমহিলা নিজ হাতেই খানা পরিবেশন করলেন। সে কি আতিথেয়তা! ভদ্রমহিলার আদর-যত্নে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
রাত চারটার গত হওয়ার সংকট শুনা গেল। আমি আর উৎপল খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে আছি।
পৃথিবীতে নানা রকমের কর্ম কলাহল, এর মাঝে আজ এক নতুন মানুষের সাথে পরিচয়।

ভদ্রমহিলা হাতে দুই গ্লাস দুধ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। মহিলার হাতের বালাগাছি খুব সুন্দর মানিয়েছে। প্রদীপের আলোয় আরো ঝলমল করছে। উৎপল চোখ বুজে শুয়ে আছে বিছানায়।দুধের গ্লাস টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ভদ্রমহিলা বলল,
: গরম গরম দুধ টুকুন খেয়ে নিন, যা কষ্ট করেছেন আজ।
: জ্বী , কষ্ট অবশ্য হয়েছিল বটে।
কিন্তু আপনার মায়াবী আতিথিয়তার পরশে, সেই কষ্ট কিছুটা সার্থক লাভ করেছে।
ভদ্রমহিলা একটি চেয়ার কাছে টেনে -বসে বলল,
: প্রথমেই শুনেছি বেকার হয়ে বসে আছেন। তা শুনি চাকরি করার জন্য কতটুকু পাশ করেছেন।
: চাকরি আছে নাকি আপনার হাতে?
: কারো হাতে চাকরির থাকার দরকার হয় না, যোগ্যতা থাকলে চাকরি একটি তো পেতেও পারেন।
মহিলা আঁচলে ঘোমটা টানার ছলে ফিরে চায় পিছু পানে। মহিলা পুনরায় প্রশ্ন করল,
: ঐ যে জিজ্ঞাস করে ছিলাম, উত্তর তো পেলাম না।
: কোন প্রশ্নের কথা বলছেন?
: কথায় এত ছল ধরেন কেন? না ভুলো মন।
: কি যে বলেন ছল ? যার চাল নেই, চুলো নেই, সমাজে যার মূল্য নেই ,তার আবার ছল। এই কোনোমতে বি,এ টা পার করতে পেরেছি। ভদ্রমহিলা কিছুটা আশান্বিত হয়ে হেঁসে বলে উঠলেন,
: কিভাবে যে মানুষ সন্ন্যাসী সাজে তা বোঝা কঠিন।
: বুঝলাম না আপনার কথা?
: তত্ত্ব জ্ঞান বুঝতে হলে চিত্তশুদ্ধি দরকার বেশি।
: তাও তো বুঝলাম না।
: এত জ্ঞানীজন বুঝতে পারছেন না কেন ?
আচ্ছা বলুনতো মেঘনার গতিধারা কোন দিকে প্রবাহিত হয় বলতে পারেন?
এ ধরনের রহস্যময় কথার মাঝে আমিও সুযোগ খুঁজে নিলাম। আমিও হতচকিত ভাবে বলে দিলাম।
: কেন ঐতিহ্যবাহী বংশের বিদ্যমান জমিদার পরিবারের দিকে।
: এত গভীর ভাব বুঝতে পারলাম না ।একটু ছল ফেলে বলবেন কি?
: ছল ফেলার নাই কল , এই যে অতীব কুটিল।
: বুঝলাম , কথায় আপনার সঙ্গে কে পারবে?
: না না তেমন কোনো গুণ নেই আমার । বলতে পারেন একরকম অপদার্থই।

কিছুক্ষণ আগেও দুজন দুজনার কত অপরিচিত, কেউ কাউকে চিনতো না, অথচ এই স্বল্প পরিসরের পরিচয়ে দুজনের কেমন যেন আপন আপন মনে হল,
মনে হল অনেক দিনের চেনা জানা।
মহিলা কি যেন ভেবে বলল,
: রাত অনেক হয়েছে শুয়ে পড়ুন। সকালে না হয় গুণীজনের সেবা করব। এই বলে মহিলা চুপিচুপি চলে গেলেন।
টেবিলের উপর তখনো প্রদীপ জ্বলছে। ভোর হয়ে আসলো বলে। উৎপল ঘুমে চেতনাহীন। কিছুক্ষণ আগে এই আমি এখন কোথায়? কে এই মহিলা? কেন তাকে এত চেনা চেনা মনে হয়। হঠাৎ করে এই মহিলার জন্য মনের মাঝে শূন্যতা কেন অনুভব করছি।
বুঝলাম মায়াবী ইন্দ্রজালে কে না অভিভূত হয়?
শুক্লপক্ষের একাদশীর রাত্রি ,নদীভরা আধখানা চাঁদ শোভা পাচ্ছে। চাঁদের আলোয় এক নয়ন অবিরাম দৃশ্য অঙ্কিতা হয় নদীর জলে।
সেই রাতেই আমি রাত কাটাচ্ছি এক নব পরিচিত সাহেবের ঘরে।
বাহ ! একেই তো বলে মানব জীবন ,কি যে রহস্যময় এই অনুভূতি,
কাজ আর সময়ের বিন্দুমাত্র মিল নেই। আজকের এই ক্ষণকাল স্মরণীয় হয়ে থাকার তো কথা। মানুষের জীবনে কিছু কাল কিছু মুহূর্ত মানুষ ভুলে কি করে?
 ভুলে যাওয়া তো- মানুষেরই অপমান ।

সকালে দরজার কড়ার খট-খটানিতে ঘুম ভেঙে গেল। উৎপল কে ডেকে তুললাম ,দরজাটা খুলে দেখি -সেই মহিলা। হাতে মুখ ধোয়ার জল।অত্যন্ত বিনয়ী ভাবে বলল,
: কাল ঔষুধ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, শরীরে ব্যথা করেনি তো?
 মনে মনে ভাবলাম ,তাই একটু একটু করেছে তবে শরীরের চেয়ে মনের ভিতরেই বেশি।
ভদ্রমহিলা বললেন,
: বিড়বিড় করে মনে মনে কি বলছেন?
: না কিছুই না।
‌: কিছু তো বটেই!
: অযাচিত ব্যক্তির গায়ের ব্যাথাই বলুন, আর মনের ব্যথাই বলুন ,দুটি মূল্যহীন । কারো অন্তরে ঠাঁই পাওয়ার নয়।
: ব্যর্থতার গ্লানি মনে পোষণ করার চেয়ে, নিজ অবস্থানের কথা ভাবা উচিত নয় কি?
: তা ঠিক বলেছেন। যা পাওয়ার নয়,তা ভাবাও অনুচিত।
: আমি ঠিক এটা বুঝাতে চাইনি । বলছিলাম কি বেকার কিনা তাই ।
(চলবে)

1 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।