আবু সাঈদ মোল্লা'র গল্প মধ্যরাতের হুইসেল


" সউগ চোর চোট্টার জাইত, সউগ মুর্খের জাইত। দ্যাশটা কি তোমার গুইলার একলারে, নাকি সগারে ? যে লুটিপুটি খায়া ফ্যালাইবেন ! " একা একাই কথা গুলো বলতে বলতে চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যান পঞ্চাষোর্ধ সুরবালা দেবী । এই গাঁয়ের সবাই তাঁকে দেবী বলেই জানে, সন্মান করে তাঁর চারিত্রিক গুনাবলীর কারণে । সুরবালা নিঃসন্তান। তবু তাকে বাজা বা, বন্ধ্যা বলে কেই খ্যাপায় না। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে মাসীমা বলে ডাকে। এই গ্রামেরই শাক-সুক্ত সর্বস্ব ছোট্ট এই বাজারটির ভেতর দিয়েই সুরবালা রোজ দুইবার করে যাওয়া আসা করেন। কাকডাকা ভোরে হাতে একটা চটের থলে আর খাবারের শূন্য বাঁটি নিয়ে বেরিয়ে যান । সারাদিন শম্ভু মিত্রের বাড়ির এঁটো থালা বাসন মেজে, ফাই-ফরমাশ খেটে ঘরে পঙ্গু স্বামীর জন্যে কিছু খাবার নিয়ে শেষ বিকেলে এই বাজারের ভেতর দিয়েই সুরবালা ঘরে ফেরেন।

" সউগ চোর চোট্টার জাইত, সউগ মুর্খের জাইত। " সুরবালার মুখের এই খেদোক্তিটুকু চায়ের দোকানের টিভির সামনে বসা ডিপজল ময়ূরীর সিনেমায় শরীরের ভাঁজ দ্যাখা দর্শকদের কানে এসে বাজে। অষ্টধাতুর আঙটি পরা আঙুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে লাফ দিয়ে উঠে সুরবালার সামনে এসে দাঁড়ায় আজিজুল মৃধা অরফে আইজল ।
" -তোমরা এইটা কি কইলেন মাসীমা ? সউগ চোর চোট্টা আর মুর্খের জাইত মানে ? তোমরা এই গুইলা কাকে কবার নাইগছেন? "
আইজল সামনে আসতেই সুরবালা তিন ফিট দুরে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। একটুকরো কাপড়ে হাতে বানানো মাস্ক দিয়ে ঢাকা নাকে হাত দিয়ে দ্যাখে ঠিকমতো ঢেকেছে কিনা । সুরবালা দেবীর কপালের সিঁদুরের নিচে বিরক্তির গড়ল চিত্র।
" - বাহে আইজল, তোমরা একনা উত্তি সরি খাঁড়া হও, তোমার মুখোত টোপা নাই । "
আইজলের মেজাজটা আরও তিরিক্ষি হয়। মাস্ককে কেউ বলে মাক্স, কেউ বলে মাচ আবার কেউ বলে টোপা। তবে যে যাই বলুক, সুরবালা বিশ্বাস করেন নাকের উপর এক টুকরো কাপড়, সামাজিক দুরত্ব আর সচেতনতাই পারে এই অদৃশ্য ঘাতকের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। সুরবালার নির্দেশে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আইজল খানিকটা দুরে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। আইজলের পেটেও তেমন বিদ্যে নেই, তবে বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত জমিজিরাতের অহংকার অাছে। কালো বাজারে ত্রানের চাল আর সুদের ব্যবসার কড়কড়ে টাকা আছে। আইজল আবারও প্রশ্ন করে
- মাসীমা, তোমরা কইলেন না, কাইং চোর চোট্টার জাইত ?
-পাইসার অভাবে হামার বাপ মাও হামাক লেখা পড়া শিখায় নাই। তবে বিবেকবান বানাইছে। চুরি করা শিখায় নাই।
কথা গুলো আইজল মৃধার বুকে বিষ মাখা তীরের ফলার মতো বিদ্ধ হয়। রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে থাকে। কিন্তু অভাবি সুরবালার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কথা ভেবে সে রাগ পানসে হয়ে যায়। সুরবালা নিচু ও ভারী গলায় আবারও বলেন,

-মুই হইলং গিদালের সন্তানরে বাবা। বাচ্চাকালে বাপের মুখে গান শুইনছি-
ভাল্ কালাই হইলেরে তাইং
অল্প জ্বালে সেজে,
ভাল্ মাইনষের ছাওয়া হইলে
অল্প কথায় বোঝে.....

আইজল মাথা নিচু করে সুরবালা মাসীর কথা গুলো শুনতে থাকে। আর নিজের কাছেই নিজের কৃতকর্মের হিসাব মেলায়।

আজ সারাদিন সুরবালা দেবীর মন ভালো ছিলোনা। প্রবীণ রাজনীতিবিদ শম্ভু মিত্রের বাড়িতে টিভির পর্দার দু'টো সংবাদ আজকাল ভিষণ রকমের ট্রল হয়।

'একজন কর্তব্যরত ডাক্তারের মৃত্যু ও সারা দেশে ব্যপকহারে ত্রানের চাল চুরি '

এই নিয়ে শম্ভু মিত্র ও তার বড় ছেলে চপল মিত্রের সাথে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। চা পানের যোগান দিতে এসে সুরবালা সে আলোচনা শোনেন, বোঝেন। টিভির পর্দায় পৃথিবী ব্যপি মৃত্যুর মিছিল দেখে সুরবালার বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। খুব মন খারাপ হয় তাঁর। আট ভাইবোনের মধ্যে সুরবালা পঞ্চম। শুধু পঞ্চম নয়, অন্যদের ধেকে একেবারে আলাদা। বাবা বেঁচে থাকতে উচিৎ কথাটি তাঁর মুখের সামনেও বলতো। সুরবালার সাথে কথা বলে আইজলের বিবেকের উপর থেকে কালো পর্দাটি আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। অভাবি সুরবালার ধীশক্তি আর সততার কাছে আইজলের কিবেক নতজানু হয়। সে গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। মাটির নিচে পুতে রাখা সাত'শ বস্তা ত্রানের চাল এখন সে কি করবে ! আইজলের ছটফটানি লক্ষ্য করে সুরবালা বলে-

" এই দ্যাশটা মস্ত বড় একটা সংসার। আর এই সংসারের প্রধান হইলো হামার সরকার। আর দ্যাশের সউগ মানুষ ভাই- বইন। তোমরা ভাই হয়া অন্য ভাই-বইনের হক মারি খান না বাবা। তাইলে মানুষ গুইলা না খায়া মরি যাইবে। হামার দ্যাশের সরকার বিপদে পইড়বে। "
                     
কথা গুলো বলেই ঘনায়মান সন্ধ্যার বুক চিরে গ্রামের সরুপথ ধরে সুরবালা ঘরে ফিরে যান।
                                   
 মাসিমা চলে গেলে আইজল আর চায়ের দোকানে ঢোকেনা। সদ্য ক্রয়কৃত হোয়াইট এ্যাশ এপাচি বাইকে চেপে সোজা বাড়ি চলে যায়। বারান্দার উজ্জ্বল আলোটি নিভিয়ে দিয়ে গ্রিলের পাশে বসে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনে সে তার পাপাচার আর অহংবোধকে পুড়ে ফেলতে চায়। অস্থিরতায় ছটফট করে। স্ত্রী জাহানারা লক্ষ্য করে তার স্বামীর কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। স্বামীর কপালের ঘাম মুছে দিয়ে হাত ধরে নিয়ে এসে ফ্যানের নিচে শুইয়ে দেয়।

রাত আড়াইটা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ঘন কালো অন্ধকার। বাড়ির চারিদিকে ভারী বুটের শব্দ, হুইসেল, টর্চ লাইটের ক্রশ আলো। হ্যান্ড মাইকের ঝাঁঝালো আওয়াজ--

" আজিজুল সাহেব, পুলিশ আপনার বাড়ির চারিদিক ঘিরে ফেলেছে। পালাবার চেষ্টা করবেন না। বাইরে বেরিয়ে আসুন। আত্ন সমর্পন করুণ। "

স্ত্রী আর এগারো বছরের ফুটফুটে মেয়ে আসফিয়া'র নিষেধ উপেক্ষা করে আজিজুল কাঁপা কাঁপা হাতে বাড়ির সদর দরজা খুলে দেয়। দুইজন কনস্টেবল তাকে হাতকড়া পরায়। অপারেশন টিমের প্রধান অসি সাহেব আজিজুলের জবানবন্দি রেকর্ড করে। বাড়ির পেছনে মুরগীর খামারের পাশে পুতে রাখা সাত'শ বস্তা ত্রানের চাল উদ্ধার হয়। পুলিশের প্রিজন ভ্যানের উজ্জ্বল আলো নির্জন হাইওয়ের লেনমার্ক দীর্ঘ সাদা রেখাটিকে গিলে ফ্যালে। ক্রমশঃ গাড়ির গতি বাড়তে থাকে । প্রিজন ভ্যানের একটু খানি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আজিজুল মৃধা পেছনে তাকায়। গাঢ় অন্ধকারে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় স্ত্রী আর কন্যা আসফিয়া'র জলে ভেজা চোখ ।

২০ এপ্রিল ২০২০
রাজারহাট, কুড়িগ্রাম।

2 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

  1. খুব ভালো লাগলো সমকালীন প্রেক্ষাপটে দারুন চিত্র অংকিত হয়েছে। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো সমকালীন প্রেক্ষাপটে দারুন চিত্র অংকিত হয়েছে। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।