বিপুল রায়'র গল্প "সুখ-দুঃখের জীবন" ।। বর্ণপ্রপাত


“ভগবান বোধায় আর চোখু তুলি দেখিবে না রে!” .... কথাটা কয়া একটা হাপো-নিক্কাস ছাড়ি, গামছাখান ঘারোত নিয়া বকুল পিড়া বিছিয়া চালিখানোত বসি আছে। এমন সমায় উত্তরপাখের সুল্কিটা দিয়া উয়ার বনুস জলের বাল্টিংটা ধরি ফরফরাইতে ফরফরাইতে আঙিনা ঢুকেছে, “ক্যানে এলা ওংকোরি কন! পাছিলা গেইসে ফেলানি, তাও না ছাড়েন তেলানি!”.... কথাটা যুদি বকুল ধরে, তাহলে কিন্তু ঝগরাটার আকার বিশাল হয়া যাবে। কাজে উয়ায় চুপচাপ করি বসি নইল, আর উয়ার বনুসোক এক গিলাস জল আনির কইল।

          বকুলের বনুস জলের গিলাসটা আনি বকুলের হাতোত দিয়া কইল, “আজিকারটা তো হবে। কালি কি করিবেন, কালি ? ঘরোত একটা মুঠি চাউল নাই! কালি কি ওষা নাগি নবেন!”

          “গোকুলঘরেরটে থাকি ধার করি আনিস। পরে সেলা দেওয়া যাবে।”

          “তোমার ভাইয়ের গোলা উথুলি পড়েছে না, দিনাও দিনাও যাইম ধার করিবার।”

          “কালিকার দিনটায় তো। যেলা আনিমু, সেলা বদল দিয়া আসিস।”

          “মুই না পাইম যাবার। কালি বিসোদ বার, কায় তোমাক চাউল ধার দিবে কালি!”.... বিসোদ বারের কথাটা শুনি বকুলের মাথাটা পাঁও করি ঘুরিল। লক্ষ্মী বারে কাহ লক্ষ্মীক ধার দিবার না হয়।

          জলকেনা খায়া বকুল কাজের খোঁজত বিরি পড়িল।

          হাকিম পাড়ার দীনেশ ঠিকাদারেরটে কাজের কথা কোবার গেল। বকুল খুব ভালো রাজমিস্ত্রী বুলি দীনেশ ‘না’ করিল না। ইয়ার আগোত দীনেশের অনেক কাজ হ্যান্ডওভার করি দিসে বকুল। মানষিও বকুলের কাজের প্রশংসা করে। এই কথাটা ভাবিয়া দীনেশ বকুলের এক কথাতে রাজি হয়া গেল। বকুল কং না নাকং করিয়াও দীনেশোক কইল, “দীনেশ দা রে, কোনেক সমস্যা হইল রে।”

          “কি সমস্যা?”

          “অল্প কিছু টাকা নাগিল হয়।”

          “টাকা! পকেটোত তো এলা টাকায় নাই রে ভাই। কত টাকা নাগে তোক?”

          “হাজার মতন দিলেই চলিবে।”

          “হাজার! কিন্তু... টাকা তো এ.টি.এম থাকি অঠের নাগিবে। পরে দিলে হবার না হয়?”

          “হবে। কিন্তু মোর পকেটোত একটা নাল পাইসাও নাই রে! খরচ নিগির নাগিল হয়। বাড়িওলিও যে খ্যাচখ্যাচেবার ধরিসে, মাথায় খারাপ করি ছাড়ি দ্যাছে রে।”

          দীনেশ নিজের পকেটোত হাত ঢুকি দেখিল মাত্র পাঁচশো টাকা আছে। ....“পাঁচশো টাকায় হবে রে বকুল?”

          “হবে হবে, দে।”.... টাকাটা নিয়া বকুল খরচা-পাতি ধরি বাড়ি ফিরিল।
বকুলের এই অভাবটা হয়তো হইল না হয়। উয়ায় খুব সকিন্দার মানষি। মোটামুটি মাসখানেক আগোত নাম-কীর্তনের খবর আসিসে। উমার দলের সর্দার গোবিন্দ-- কথাও দিসে, কীর্তন করির যাবে। যেহেতু প্রতিবছর উমুরা ওটে কীর্তন করি আইসে, এইবার ক্যাংকরি মানষিগিলাক নিরাশ করে। আর উমার দলের নীলা দেখির বাদে মানষি কত আতি করি জাগি থাকে।

          গোবিন্দর এই কথা দেওয়াতে সমস্যাটা এটে আসি দাঁড়াইসে। হঠাৎ করি বকুলের বেটার জ্বর। হাতুরিয়া ডাক্তারের ঔষধ খায়া খায়া কমে, তারপর আরও জ্বর আইসে। সুখচন কবিরাজ আসি হাত নাড়ি কয়, “হুমম, দূষি আছে বৌমা। বাও নাগিসে। চেংরারঘর যেত্তি-সেত্তি বেরায়!”

          বকুলের বনুষ কয়, “তাহলে কোনেক ঝাড়া-ফোঁকা করি দ্যাও তে বাবা।”

          “হুটা না মুই করি দ্যাছোং বৌমা। বিষ-ঢেকিয়ার পাত আনো তোমরা।”.... বকুলের বনুস ফটাফট বিষ-ঢেকিয়ার পাত আনি দ্যায়। সুখচন কবিরাজ ঝাড়া-ফোঁকা করিয়া, কাটানি-চিরানি কত কি-ই না করি দিয়া কয়, “কয়টা দিন ধৈয্য ধরো বৌমা, দূষি কাটি গেইসে। জ্বরটা এলা আস্তে আস্তে কমিবে।”

          বকুলের বনুস একটা স্বস্থির নিক্কাস ছাড়িল। এতদিনে বেটার জ্বর বেচারিক অস্থির করি ছাড়ি দিসে।

          পাঁচ-ছয় দিন বিতি গেল, কিন্তু বকুলের বেটার জ্বর কমিল না। বকুলের বনুস আরও সুখচন কবিরাজের বাড়িত যায়া কয়, “বাবা, জ্বরটা তো কমিলকে না। তোমরা আর একবার যায়া ভাল করি দেখি আইসোতো।”

          “এলাও‌ কমে নাই!”

          “কোটে আর কমিল! দিন দিন বেশি হছে ক্যানেবেলা!”
          
          “আচ্ছা, বুঝিসুং এইবার বৌমা। তোমরা আগাও। মুই সইন্ধ্যার সমায় যাইম এলায়। তোমরা ততক্ষণে এক জোড়া পারো, একখান সাদা নিশাণ, দুই ঝুঁকি কলা, এক জোড়া গুয়া-পান, জবা ফুল আর ধূপ-ধূনা যা কিছু নাগে সবে জোগার করি থন। একটা পূজা করির নাগিবে।”

          “পূজা করির নাগিবে!”

          “হুমম। পূজা না করিলে হবার না হয়-- মুই বুঝিসুং।

          “ঠিক আছে তে, মুই যায়া জোগার-যান্তনা করেছোং, তোমরা আইসেন ফির।”.... কথাটা কয়া বকুলের বনুস চলি গেল। 

           জ্বরটা তো দিন দিন বাড়িতেই আছে বেচারার, কিন্তু হাতুরিয়া ডাক্তারের ঔষধ আর কবিরাজের ঝাড়া-ফোঁকা ছাড়া হাসপাতালের মুখখান পর্যন্ত দেখির পায় নাই। বকুলের কথায় বা কি কবেন, সকালে উঠি কাজোত যায়, আর সইন্ধ্যার সমায় বাড়ি আইসে। বেটার জ্বরটা কমিল না নাই-- ওইপাখে ত্যামন একটা ধ্যান দ্যায় না।
বকুলের বনুস বাড়ি আসি, হিদি-হুদি দৌড়া-দৌড়ি করি সব জিনিসে জোগার করি থুইসে। সইন্ধ্যার সমায় সুখচন কবিরাজ আসি পূজা করিয়া কয়, “এইবার দোষ-দূষি ছাড়ি পালাইতে দিশা পাবে না বৌমা। তোমরাও আর চিন্তা না করেন।”

          “এইবার জ্বরটা সারিবে তো বাবা ?”

          “হামার কর্ম তো হামরা করিলি বৌমা, ফল এলা উপরওয়ালার হাতোত।”.... এই কয়া, চা খায়া সুখচন কবিরাজ উঠি চলি গেল।‌

          আরও চাইর-পাঁচ দিন বিতি গেল, কিন্তু বকুলের বেটার কুনো উন্নতি দেখা গেল না। বরঞ্চ অবনতিটা খুবই বেশি হইসে। বেচারার জ্বরটা এতটায় বেশি হইসে যে মাথার বিষে চোখু মেলি দেখির পায় না। জলকেনা বাদে মুখোত আর কিচ্ছু নিবার পায় না।

          গোকুল এই কয়দিন হাতে উয়ার বৌদির অং-ঢংগিলা দেখি আইসেছে।... “ এতদিন হয়া গেল, এলাও জ্বর কমিল না! হাসপাতাল তো নিগিবার দরকার ছিলো। এই মতন একটা সিরিয়াস রুগি ধরি ক্যাংকরি বাড়িত থাকির পায় দাদা!”.... একেলায় একেলায় বারবার কয়। বকুলোক যে কথাটা কবে, তারও উপায় নাই, কারণ ‘ভাই-ভাইয়ে ছিল গালার খাটি, ঝগরা নাগাইসে তাহইর বেটি’-- এই অবস্থা হইসে। আর সেলা থাকি দুই ভাইয়েরে কথা কওয়া বন্ধ। মাঝে মাঝে দুই যাওয়ে তাও কথা-বার্তা কয়।

          ভাতিজার এই মতন অবস্থা দেখি গোকুলের মনুষ্যত্ববোধ জাগি উঠিল। কি হইসে না-হইসে সব ভুলি যায়া সেদিন সকাল সকাল রাগ দ্যাখেয়া বকুলোক কইল, “তোর কি কাজটায় বড়ো হইল রে! ছাওয়াটার অবস্থাটা কি ভাল করি দেখসিস একবার! ক্যামন মানষি রে তোমরা! হাসপাতাল নিগা যাছে না?”

          গোকুলের কথা শুনি, কাজ বন্ধ করি শ্যাষ-ম্যাস বকুল উয়ার বেটাক ধরি হাসপাতাল চলি গেল। ডাক্তার বকুলের বেটাক খুব তাড়াতাড়ি ভর্তি করাইল। ওঝা-কবিরাজের ঝাঁড়-ফোকের কথা শুনি ডাক্তারের যুনি মাথায় নষ্ট! মিষ্টি কথায় জুতার বারির মতন করি ডাক্তার বকুলোক অনেক কিছুই ভাল-মন্দ শুনি দিল। ডাক্তার বকুলোক কয়, “তোমার বেটার রক্ত পরীক্ষা করির নাগিবে। এমনিতেই তোমরা খুব দেড়ি করি ফেলাইসেন। ওঝা-কবিরাজ দিয়া ঝাঁড়া-ফোঁকা করিসেন ঠিক আছে। কিন্তু যেলা দেখিলেন যে জ্বরটা কমেছে না, ফটকরি হাসপাতাল ধরি আইসো। তা না করিয়া বাড়িতে যে কি কি করির ধরিসেন তোমরায় জানেন!”
রক্ত পরীক্ষা করা হইল। ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়িসে। সাথে জন্ডিসও। কাজে তো বেচারার অবস্থাটা নেহাল হয়া গেইসে। ঔষধ-পাতিও কিনিবার টাকা নাই! কি করে সেলা ? বাইধ্য হয়া বকুলের বনুস সোনার মালাখান ব্যাচেয়া বেটার চিকিস্যা করিল।

          মোটামুটি বেশ কয়েকদিন হাসপাতালোত ভর্তি নইল বকুলের বেটা। ততদিনে উয়ার কাজ-কাম সবে বন্ধ-- একেবারে হাত ফাঁকা। জাগা-জমি যা ছিলো-- বেটির বিয়ার সমায় ব্যাচেয়া শ্যাস। এলা হাতের উপর খায় বেচারা। গোকুলের মানবিক বোধ তো আগোতেই জান্মিসে, কাজে পুরানা কথা ভুলি যায়া বকুলের বেটাক হাসপাতাল নিগিবার উপদেশ দ্যায়। হাসপাতালোত গোকুল-বকুল দুই ভাইয়ে অদল-বদল করি রুগির বগোলোত আতি কাটাইসে।

          হাত শূন অবস্থায় রুগি বাড়ি আনি আর এক সমস্যা। উয়ার বেটাক এলা যেই-সেই জিনিস খাবার না মনায়। খাবার রুচিটায় নষ্ট হয়া গেইসে। কাজে ভাল ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু... কি দিয়া কি করে! জ্বালায়-চিন্তায় বকুলের মাথাত হাত। মাঝে মাঝে রাগ উঠিয়া মাথা ঝাড়ি গরীব হওয়ার দুঃখটা প্রকাশ করে।

          বকুলের বনুসের মুরগী বেচা পাইসাকেনাও এইবার বিরি আসিল। অনেকদিন থাকি অল্প অল্প করি জমাইসে। মুরগী ব্যাচা পাইসা আর কি জমা হবে-- এংকরি সংসারের ভুলুং মঞ্জাইতে শ্যাস!

          তারে কিছুদিন পর নাম-কীর্তন। হাসপাতাল থাকি বাড়ি আসিবার আট-দশ দিন হইসে মাত্র। কাজ-কাম করি বকুলোক ধার-দেনা সুজির নাগিবে, বন্ধন চালের নাগিবে আরও ফির সংসার চালের নাগিবে। একটা মানষি কুন পাখে কি করে!

          সেদিন সইন্ধ্যাত নাম-কীর্তন করির যাবে বকুল। খবরটা শুনি বকুলের বনুসের ঠ্যাঙের রক্ত মাথাত চড়িল। “সংসারটার ভিত্তি না দেখিয়া উমার সখ-আমোদ”--- এই কয়া শুরু, তার পর সেই স্লোগান সারাদিন ধরি চলিসেই। বেচারিরও কুনো দোষ নাই। সংসারের যা পরিস্থিতি, তাতে যুদি বাড়ির মালিক চাইর দিন, চাইর আতি বায়রাত যায় সখ করিবার, কার মনটা ঠিক থাকিবে।
বকুল যাবেই, আর উয়ার বনুস যাবার দিবে না-- এই নিয়া সারাদিন তো কেচাল চলেছেই। তারে মাঝোত বিকালে দলের সর্দার গোবিন্দ বকুলের বাড়ি আইসে, বকুল যাবে না নাই-- তারে খবর করির। গোবিন্দক দেখিয়া বকুলের বনুস আরও বেশি করি কবার ধরিল, “ ছাওয়াটা যেলা জ্বরত ভুগিল, সেলা কয়টা মানষি আসি উদিস করিসে! আজি যে এই অবস্থা কাহ তো পাঁচটা পাইসা দিয়াও সাহাইয্য করিল না। সখ কি তোমার চ্যাতেয়া উঠেছে!”.... গোবিন্দও একেবারে নির্লজ্জ মানষি। উয়ায় বকুলের বনুসের কথা না শুনার ভান করিয়া, দাঁত ক্যাল্টে হাসিতে হাসিতে “বকুল ? বকুল ?” করি ডেকাইতে ডেকাইতে সোজা বাড়ি ঢুকিল। বকুল চেয়ারখান আগে দিয়া কইল, “বইসো।”

          চেয়ারখানোত বসিয়া গোবিন্দ কইল, “কি খবর বাহে, যাবেন তো?”.... বকুল উত্তরটা দিবার আগোত কথাটা উয়ার বনুস টপ করি কাড়ি নিয়া কইল, “যাবার পাবে না বাহে। অসুবিধা থাকিলেও কি এলা যাবার নাগিবে!”

          “মাত্র চাইরটা দিনেরে তো ব্যপার মাও।”

          “সখটায় কি বড়ো হইল বাহে! সংসারটা তাহলে ওষাতলে যাউক।”.... আরও কত কি যে কইল, শুনিয়া গোবিন্দ খালি উঠি পালেবার পাইলেই বাঁচে। বেচারা চেয়ার থাকি উঠিয়া বকুলোক কইল, “মুই গেলুং বকুল। সাঞ্ঝেরক্ষণ গাড়ি আসিবে, রেডি হয়া থাকেন।”

          গোবিন্দক বকুলের বনুস দুই চৌক্ষে দেখির পায় না।

          বিতা দুই বছর আগোত বকুলের একজোড়া বড়ো খাসি ছাগল ছিলো। সারা বছর ছাড়া খায়া ছাগল দুইটার চেহারাও বেশ দলদলা হইসে। যায়ে দ্যাখে তারে নজর নাগে। ওইবাদে বকুল ছাগল দুইটার গালাত নজরকাটাও বান্দি দিসে। সেই বছরে বকুলের কাকা-শ্বশুড়ের বেটার বিয়াও ছিলো। শালার বিয়াও বুলি কথা, বকুলোক সপ্তাখানেক আগোতে যাবার কইসে উয়ার কাকা-শ্বশুড়। কিন্তু বকুলের হইল অভাবি সংসার, যাবার কইলে কি আর ফটকরি যাবার পায়। কাজে বিয়ার কয়েকদিন আগোত বকুল উয়ার বনুসোক প্যাঠে দিসে, আর নিজে বিয়ার একদিন আগোত যাবে, ঠিক করিসে।

          শ্বশুড় বাড়ি যাবার আগোত বকুল গোকুলের বেটিক ড্যাকেয়া কইল, “হামার ছাগল দুইটা দেখিসতো মাই দুইটা দিন। নাড়াচাড়া তো করির নাগিবে না, খালি কোনেক নজর দিস। আর মুরগীগিলাক চাইরটা খাবার দিস।”.... এই কয়া বকুল শ্বশুড় বাড়ি চলি গেল।

          তিন-চাইর দিন পর উমুরা বাড়ি ফিরিল। বাড়ি ঢুকিবার কিছুক্ষণ পরে গোকুলের বনুস আসি বকুলের বনুসোক কইল, “দিদি হায় তোমার খাসি দুইটা নাই হায়!”.... কথাটা শুনিয়া বকুল আর উয়ার বনুস যুনি আকাশ থাকি মাটিত পাড়িল।
“কি হইসে হায়!”

           “কি আর হইসে-- কালি বিকালে মুই খালি বাজার গেলুং আর আসিলুং। যাবার সমায়ে ছাগল দুইটাক দেখি গেলুং, আর আসিয়া দ্যাখেছোং নাই!”

          “নাই মানে! ছাগল দুইটা‌ হইল কি তে হায়?”

           “হামার মাই কইল, ওই‌ গোবিন্দ বুড়ায় নাকি ছাগল দুইটাক পিট্টা-পিট্টি করিসে। আর মাইও ভাল করি নজর দ্যায় নাই, খেলাতে ব্যস্ত ছিলো, ছাওয়া মানষি।”

          বকুল আর উয়ার বনুসের কলিজাখান যুনি ভাঙি-ছিঁড়ি চুরমার হয়া যাছে। কত কষ্টের ধন দুইটা। আশা করিসে ছাগল দুইটা ব্যাচেয়া বাড়ি-ঘরলা কোনেক ঠিক করিবে। কিন্তু গোবিন্দ হাবাতিয়া উমার আশার মুখোত ছাই দিসে।

          পরের দিনে গোবিন্দর সাথে বকুলের কি ফাটাফাটি ঝোগড়া। প্রধান-পঞ্চাইত আনি বিচার পর্যন্ত হইল। বিচারে গোবিন্দর হার হইল। স্ব-ইচ্ছায় সেলা ছাগল দুইটার উপযুক্ত জরিমানাও দিল।.... সেই সেলা থাকি গোবিন্দ বকুলের বনুসের চোখুর কাঁটা হইসে, আজি পর্যন্ত্য দেখির পায় না উয়াক। আর সেই লোকটারে সাথে এক সাথে বকুল যাবে নাম-কীর্তন করির। এই বিষয়টা কুনোমতেই মানি নিবার পাছে না বকুলের বনুস।

          কার কথা কায় শুনে-- সইন্ধ্যার সমায় বকুল সাজি-গুজি নাম-কীর্তন করির চলি গেল।

          চাইর দিন পরে ফিরি আসি বাড়ির অবস্থা দেখি আর স্থির হয়া থাকির পাছে না বকুল। যেলায় শুনিসে যে উয়ার বনুস পাওতোরা ব্যাচেয়া সেই সপ্তায় বন্ধন চালাইসে। নিজেকে যুনি কুনোমতেই আর ক্ষমা করির পাছে না উয়ায়। কি দিয়া কি করে-- কুনোয় উপায় নাই।

         অবশ্যাসে জলকেনা খায়া দীনেশ ঠিকাদারেরটে টাকা ধার করির চলি গেল বকুল। আসির সমায় খরচা-পাতি ধরি বাড়ি আসিলে উয়ার বনুসের মনটা কোনেক ফরফরা হয়।

         যা হবার তা তো হয়ায় গেইসে-- এই ভাবিয়া বকুলের বনুস বকুলোক কয়, “এলা সখ-আমোদ না করিয়া কাজোতে কোনেক মনটা দ্যাও।”.... বকুলের কুনো জবাব নাই। নিজানিজি মনে মনে যে কি কি ভাবে, কাহকে কয় না। আজ-কাল আর কথাও খুব একটা বেশি কয় না। কিন্তু আগোত য্যাংকরি মানষির সাথে মিশিসে, এলাও ঠিক ওই মতনে মিশে।

          পরের সপ্তা থাকি বকুল সকাল সকাল আরও কাজোত বিরি পরে।

          সপ্তার শ্যাসে বকুল কাজের টাকা পায়া, বাড়ি আসি উয়ার বনুসোক কয়, “হ্যাঁ, টাকালা থো তো।”.... উয়ার বনুস টাকা হাতোত নিয়া গনি দ্যাখে, হিসাবের থাকি কিছু টাকা কম আছে। সেইটা নিয়া অবশ্য কিছু কয় নাই বকুলোক।
দুই দিন পরে সকাল সকাল কাজোত যায়া অনেক আতি করি বাড়ি ফিরিলে শুরু হয় বকুলের বনুসের খেচখেচি। বকুল কুনো কয় না, চুপচাপ শুনি থাকে। গাও-পাও ধুইয়া, খায়া-দায়া চুপচাপ থাকি আছে উয়ায়। উয়ার বনুস আসিয়া বগোলোত বসি আস্তে করি কয়, “কি হইসে তোমার? আজ-কাল চুপচাপ করি ক্যানে যে থাকেন তোমরায় জানেন!”

          বকুল কুনো জবাব না দিয়া পকেট থাকি একখান রূপার পাওতোরা নিকিলি উয়ার বনুসের হাতোত দিয়া কয়, “দ্যাখতো এইখান কি তোর পাওতোরাখান?”

          “হ্যাঁ। এইখান তো মুই বানিয়ারটে ব্যাচে দিয়া আচ্চুং। তোমরা কোটে পাইলেন?”
বকুল চুপচাপ করি দ্যাখেছে পাওতোরা পায়া উয়ার বনুস কতটা খুশি হইসে। আনন্দ যুনি উথুলি পড়েছে। এমন সমায় বকুল উয়ার বনুসের সোনার মালাখান নিকিলি হাতোত দিয়া কয়, “এইখান কি তোর মালাখান রে ? দ্যাখতো।”

          “হ্যাঁ, মোরে মালাখান তো। কিন্তু তোমরা এইলা কোটে পাইলেন!”

          “তোক নানায় শুনির রে।”

          “মোক শুনির নানায় মানে! কার বাদে আনিসেন এইলা?”

          “তোরে বাদে না আনিলুং রে।”

           “মোরে বাদে আনিয়া মোকে কবেন না! নানাগে তোমার জিনিস। তোমার জিনিস তোমরা কি করেন করো।”.... বকুল উয়ার বনুসের রাগ দেখিয়া গোটায় ঘটনাটা খুলি কয়।

          ঘটনাটা হইল-- সপ্তার শ্যাসে বকুল যেলা হিসাবের থাকি কম টাকা উয়ার বনুসোক, সেলা বাকি টাকাটা গেল কোটে, উয়ার বনুস কিন্তু একবারও পুছে নাই উয়াক। পুছিলে হয়তো সেদিনেই উত্তরটা পাইল হয়। যেকিনা টাকা কম ছিলো, বকুল ওকিনা টাকার লটারি কাটিসে। আর তাতে উয়ার কয়েক হাজার টাকা আটকিসে। সেই টাকারে এত কিছু ধরি বাড়ি ফিরিসে বেচারা। কিন্তু, উয়ার বনুস যুদিও মনে মনে খুব খুশি, তাও বকুলোক কয়, “ব্যাচাসুং তে ব্যাচাসুং, তোমাক কায় এইলা আরও কিনি আনির কইল! টাকাটা হামরা ওইন্য কাজোত নাগের পালি না হয়?”.... বকুলের কুনো উত্তর নাই। খালি দ্যাখেছে যে উয়ার বনুস মালাখান আর পাওতোরাখান পায়া কত্তটা খুশি হইসে।

          বকুল উয়ার বনুসোক কতটা ভালোবাসে সেইটা হয়তো উয়ায় মুখে কুনোদিন প্রকাশ করির পায় না। কিন্তু উয়ার ভাব-ভঙ্গি থাকি স্পষ্ট বুঝা যায় উয়ায় উয়ার বনুসোক কতটা ভালোবাসে। আসলে বকুল জানে-- ভালোবাসা মানষিক ভাল করি বাঁচি থাকিবার রাস্তা দেখায়। ছোট-খাটো সাংসারিক ঝোগরা ভালোবাসার একটা অইন্য রূপ মাত্র।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।