হামীম রায়হান'র গল্প আসলাম মাস্টার ।। বর্ণপ্রপাত


 'শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ কবিতাটা পড়ে শিক্ষকতার পেশাকে জীবন, জীবিকার মাধ্যম হিসেবে নেন আসলাম মাস্টার। কত ছাত্রছাত্রী তার হাতে মানুষ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।
 স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন দু’বছর হল। আসলাম স্যারের কোন ছেলেমেয়ে নাই। দু’জনের সংসার। তারপরও সংসারে অভাব। কোন জমানো টাকাও নাই। স্কুল থেকে অবসরের পর কিছু টাকা পেনশন বাবদ পান। তা দিয়েই সংসারটা চলে। চলে বললে ভুল হবে, তা দিয়ে বুড়ো বুড়ির ঔষধ বাবদ খরচ হয়ে যায়। কিছুদিন বাসায় কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসত, এখন তারাও আসে না। আসবেই বা কেন, সপ্তাহের অধিকাংশ সময় তিনি অসুস্থ থাকেন। পড়াতে পারেন না। মাঝে মাঝে ভুল পড়ান। বয়স বাড়লে যা হয়।
 মাঝে মাঝে অনেক ছাত্রছাত্রী তার সাথে দেখা করতে আসে। তারা বাড়ি এসে সালাম করে কিন্তু সবাইকে তিনি মনে রাখতে পারেন না। না পারলেও সবাই তাকে অনেক সম্মান করে। আর তারা আসার সময় বিভিন্ন নাস্তা নিয়ে আসে। এই একটা জিনিসের লোভে তিনি চান দিনে তিন চার জন করে ছাত্রছাত্রী তার সাথে এসে দেখা করুক। এই নাস্তা তিনি আবার দোকানে বিক্রি করে চাল, ডাল নিয়ে আসেন। তা দিয়ে কয়েকদিন চিন্তামুক্ত থাকা যায়।
 অসুখটা বাড়ছে, টাকার প্রয়োজন। হাতে কোন টাকাও নাই। তাছাড়া বৌটাও অসুস্থ! আসলাম মাস্টারের অনেক ছাত্রছাত্রী আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আবার অনেকেই বেশ টাকা পয়সারও মালিক। তাদের কাছে গিয়ে বললে হয়ত অনেকেই সাহায্য করবে। কিন্তু তাদের কাছে গিয়ে হাত পাততে তিনি পারছেন না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রতিদিন একবেলা না খেয়েই থাকতে হচ্ছে। কাউকে তা বলতেও পারছেন না। রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার সময় অনেকেই সালাম দেয়। তিনি মনে মনে ভাবেন, যদি তারা সালাম না দিয়ে কিছু টাকা সাহায্য করত তাহলে একটু খেয়ে পরে বাঁচা যেত।
 এখন প্রতিদিন সকালে বাজারে আসাদের চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন। কারণ সেখানে অনেকেই আসে আর মাস্টারকে দেখলে তারা চা নাস্তা করাই। আবার কিছু তিনি বাড়িও নিয়ে আসতে পারেন। সেদিন গিয়ে শুনতে পান মাসুম ব্যাপারি আগামি শুক্রবার গরিব, অসহায়, দুস্থদের চাল, ডালসহ কিছু মুদির জিনিস এবং সাথে কিছু টাকা বিতরন করবে। এই মাসুম আসলাম মাস্টারের ছাত্র! শহরে গিয়ে অনেক টাকার মালিক হয়েছে মাসুম। লোকে বলে লোক ঠকানোর ব্যবসা মাসুমের। আদম ব্যাপারিও করে। আজ গ্রামের সবচেয়ে দানবীর সে। সবচেয়ে পয়সাওলা লোক গ্রামের। মসজিদ, মন্দিরে নিয়মিত দান খয়রাত করে।
 শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নেয় আসলাম মাস্টার। মাফলার পেচিয়ে হাঁটতে থাকেন গ্রামের দক্ষিণ দিক ধরে। গ্রামের সব ভিখারিরা ওদিকে যাচ্ছে। অন্যকেউ যাচ্ছে না। ওদিকে মাসুম ব্যাপারির বাড়ি। মাসুম ব্যাপারির সাথে গ্রামের লোকজন তেমন মিলমিশ নাই। লোক ভালো না তাই ভিখারি ছাড়া অন্য কেউ যাচ্ছে না। এক সময়ের কুঁড়ে ঘরটি আজ বিশাল অট্টালিকা! ব্যাপারির বাড়ি লোকে লোকরণ্য! আসলাম মাস্টার মাফলারটা ভালোভাবে পেচিয়ে তাদের ভীড়ে মিশে গেলেন। একটা লাইনে দাঁড়িয়ে আসলাম মাস্টার অপেক্ষা করছে কখন মাসুম ব্যাপারি আসবে, কিছু সাহায্য করবে! আর তা দিয়ে অসুস্থ বৌ টা রান্না করবে। কয়েকদিন একটু শান্তি পাওয়া যাবে।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।