থিয়েটার শিল্পের ভবিষ্যৎ : শুভ্রা রায় ।। বর্ণপ্রপাত


আজ আমরা খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি | বর্তমান পরিস্থিতি (COVID- 19) আমাদের এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে কিনা বা কত দিনে আসা যাবে তা নিয়ে সকলেই উদ্বিগ্ন | গোটা বিশ্ব যেখানে স্তব্ধ, সকলেই যেখানে একটা অনিশ্চয়তা মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সেখানে থিয়েটার শিল্পের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে, সেটা ভেবেই থিয়েটার শিল্পীরা আতঙ্কিত |
আমরা সকলেই জানি, থিয়েটার সম্মিলিত শিল্প | একটি থিয়েটার দাঁড়িয়ে থাকে অনেক গুলি খুঁটি ( Pillar) কে কেন্দ্র করে | সেখানে অভিনেতা - অভিনেত্রী সহ নেপথ্য মঞ্চের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত আলোক শিল্পী, মঞ্চ নির্মাতা, আবহ শিল্পী, রূপ-সজ্জাকার প্রত্যেকেই থিয়েটারের এক একটি অঙ্গ | দর্শন চৌধুরীর মতে --
"মঞ্চ, নাটক, নাট্যকার, অভিনেতা- অভিনেত্রী, পরিচালক, মালিক, মঞ্চের নেপথ্য কর্মী, সঙ্গীত, নৃত্য গীত এবং দর্শক সব নিয়ে গড়ে ওঠে একটা দেশের থিয়েটারের ইতিহাস |"
নাট্য শিল্পের সাথে যুক্ত শিল্পীরা , একদল যারা অ্যামেচার অর্থাৎ অন্য পেশার সাথে যুক্ত থেকেও থিয়েটারকে ভালোবেসে থিয়েটার করে চলেছেন | আর একদল পেশাদার অর্থাৎ যারা থিয়েটারকে ভালোবেসে থিয়েটারকেই পেশা করেছেন | বর্তমান পরিস্থিতিতে অসুবিধায় পরেছেন এই সমস্ত প্রফেশনাল নাট্য শিল্পীরা এবং নেপথ্য কর্মীরা | এখন তাদের ওষ্ঠাগত প্রাণ , আর্থ সামাজিক সংকট গ্রাস করেছে তাদের | 

বর্তমান করোনা বিধ্বস্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্বের সমগ্র নাট্য কর্মীরা চেষ্টা চালাচ্ছে| গভীর আন্তরিকতার সাথে সহমর্মিতার ডালি নিয়ে পাশে থাকছে একে অপরের | এক মানসিক যন্ত্রনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে নাট্য শিল্পীরা, অবসাদ এসে ভীড় জমাচ্ছে তাদের মনিকোঠায়। তারা খুঁজে ফেরে -- থিয়েটার হল, মঞ্চ, গ্রীনরুম। আর অন্যদিকে প্রেক্ষাগৃহ গুলো অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে | যেন মনে হচ্ছে প্রতিনিয়ত সে আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে , আর বলছে -- 'এসো বন্ধু এসো, তোমাদের পদার্পণে আমার এ প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠুক, এ মঞ্চ আলোকে ঝলমল করে উঠুক, গ্রীনরুম প্রাণ ফিরে পাক শিল্পীদের কলতানে… আর প্রতিটি শিল্পীর মনে এই অনুভব---
"ওই দেহ পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্ব জনমের স্মৃতি |
… ...... তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন |"
অনেক সংকট পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে থিয়েটার কিন্তু এগিয়ে চলেছে | দুর্ভিক্ষ, মহামারী, সমাজ নেতাদের শক্তি প্রয়োগ কোনটাই কিন্তু থিয়েটারকে আটকে রাখতে পারেনি |

ঘটনা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে -১৭৯৫ খ্রীঃ ২৭ শে নভেম্বর, শুক্রবার ''The Disguise'' নামে একটি ইংরেজী নাটকের বাংলা অনুবাদ ''কাল্পনিক সংবদল '' 'বেঙ্গলী থিয়েটার' এ হেরাসিম/ গেরাসিম লেবেডেফ অভিনয় করেন | দ্বিতীয়বার ১৭৯৬ খ্রীঃ ২১শে মার্চ, সোমবার এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয় | তৃতীয়বার সংবাদ পত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েও নাটকটি হয়নি | রঙ্গমঞ্চটি আগুনে পুড়ে যায় | তবে এটি আকস্মিক দুর্ঘটনা মাত্র নয় | তারপরেও অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে নাটককে সঙ্গী করে এগিয়ে চলেছিলেন লেবেডেফ | সব বাধা কাটিয়ে উঠে যখন থিয়েটারে সুদিন দেখলেন, তখনই চক্রান্তের শিকার হলেন | বেঙ্গলী থিয়েটার ভস্মীভূত হয়ে গেল| আশাহত লেবেডেফ ভারতবর্ষ ছেড়ে প্রথমে ইংল্যান্ড, পরে রাশিয়ায় ফিরে যান | বাংলার নাট্যাভিনয়ে প্রথম নারী ভূমিকায় অভিনেত্রীদের আবির্ভাব ,বঙ্গীয় নাট্যশালার জনক লেবেডেফ-এর সৃষ্টি |১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে লেবেডেফ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ঠিকই .... কিন্তু রয়ে গেল তাঁর থিয়েটারে লড়াইয়ের ইতিহাস, যা আজও প্রবহমান |

পৃথিবীর সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রথম আঘাত থিয়েটারের ওপরেই এসেছে | কারন থিয়েটার একটি জীবন্ত মাধ্যম , যৌগিক শিল্প | থিয়েটার সমষ্টির কথা বলে | রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ধর্ম যাজক কেউই থিয়েটারকে পছন্দ করতেন না | 

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি - ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে দুটি ঘটনার দ্বিমুখী প্রকাশ | একদিকে বঙ্কিম চন্দ্রের 'বঙ্গদর্শন' প্রকাশ, অন্যদিকে জাতীয় রঙ্গালয় বা ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা | বঙ্গদর্শনে তৎকালীন বঙ্গমনীষীর মানসিক চিন্তার দাবি এবং রঙ্গালয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানসিকতার উল্লাস | দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পন' নাটক দিয়েই জাতীয় রঙ্গালয়ের উদ্বোধন ঘটে | এই নাটকে সাহেবদের অত্যা*চার, সাহেবদের বিরুদ্ধে কৃষকের আক্রমণ যখন বাঙালী দর্শক দেখলেন , তখন তাদের স্বাদেশিক চেতনা উৎফুল্ল হল | কিন্তু ব্রিটিশের বাড়ল উদ্বেগ | নাটকের কিছু অংশ মানহানিকর সাব্যস্ত হয় | 'ন্যাশনাল থিয়েটার' ভেঙে গিয়ে তৈরি হল 'গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার' | তার আগেই 'বেঙ্গল থিয়েটার' চালু হয়ে গেছে | ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৬ এর মধ্যে দুটি রঙ্গালয়ে ধারাবাহিক ভাবে যে সব নাটকের অভিনয় চলল এবং প্রতিনিয়ত দর্শক সংবর্ধনায় দিন দিন আবেগ সঞ্চার করে চলল, তাতে শাসক শ্রেণি চিন্তায় পরল | আইনের প্রয়োগ ও বল প্রয়োগে শিল্প সংস্কৃতির প্রচার বন্ধ করতে চাইল | হুম*কি, বল*প্রয়োগ কোনটাতেই যখন কিছু হল না, তখন ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর 'অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন' বা 'Dramatic Performances Control Act' চালু করলেন ব্রিটিশ সরকার | এছাড়াও মধুসূদন দত্তের একেই কি বলে সভ্যতা', ' বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' , রামনারায়ন তর্করত্নের 'কুলীন কুল সর্বস্ব' এর ওপর আঘাত হানল ব্রাহ্মণ কুলীন সমাজ পতির দল | সরকারী আইনের বাইরে সমাজ নেতাদের শক্তি প্রয়োগে কণ্ঠরোধ ( Cultural hegemony ) -- নানা যুগে নানা ভাবে চেষ্টা চলেছে | কিন্তু থেমে থাকেনি থিয়েটার | কালের অমোঘ নিয়মে এগিয়ে চলেছে |

পৃথিবীতে মানুষের যাত্রা শুরু থেকেই থিয়েট্রিক্যাল কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে মানুষ সব কিছু শিখে এসেছে | পৃথিবীর সৃষ্টির সময় থেকে প্লেগ, কলেরায় গ্রাম থেকে গ্রাম উজার হতে দেখেছে মানুষ | মহামারীর সাথে মানুষ মোকাবেলা করে টিকে থেকেছে | টিকে থেকেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে |

যুগে যুগে দেখা গেছে কোন মহামারী, রাজনৈতিক প্রতিঘাত থিয়েটারকে প্রতিহত করতে পারেনি। থিয়েটার যে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। সর্ব কালের প্রগতিশীল আন্দোলনের অংশীদার থিয়েটার শিল্পীরা। সময় যে বড় সাংঘাতিক। সময়ের সাথে শিল্পের ভাষা তৈরি হয়। করোনা পরিস্থিতির পর হয়তো ৫০-১০০ কোটি মানুষ বেকার হবে, বৈষম্য বাড়বে, দুর্ভিক্ষ হবে, লুটপাট হবে, সামাজিক সম্পর্কের ধরণ বদলাবে, তবুও থিয়েটার চলবে।

একমাত্র থিয়েটারই সমসাময়িক ঘটনাকে নিয়ে কাজ করে | অনেক সংকটের মধ্যে দিয়ে থিয়েটার নদীর মতো নিজের গতিতে বয়ে চলে | নদীকে যেমন বেঁধে রাখা যায় না, থিয়েটারকেও বেঁধে রাখা যায় না | হয়তো বাঁক পরিবর্তন করতে পারে , তৈরি হতে পারে বিকল্প কোন থিয়েটার| তবুও সে চলবে তার আপন গতিতে… আমরা মরে যাবো , কিন্তু থিয়েটার মরে না | সে যে অমর - অবিনশ্বর, সে যে চির শাশ্বত।

শুভ্রা রায়
নাট্য অভিনেত্রী 
কৃষ্ণনগর, নদিয়া, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।