আকাশটা আজ ক'দিন ধরেই ভারী হয়ে আছে
সমুদ্রের ঢেউগুলোও যেন কেমন জানি ইঙ্গিত দিচ্ছে
সাতদিন বাদে জাহাজে ভাড়া খেটে এসে
বিশ বছরের কালু ভাই বলে, সাগর ছেয়েছে
কালো জলের ঢেউয়ে
সমুদ্রের পানির ঢেউ ভালা না
বড় তুফান হবে মনে হচ্ছে।
গাছের পাতা গত দু'দিনে দুইবারও নড়েনি
মাঝ রাতের কুকুরগুলো যেন কেমন শব্দ করে ডাকে
রাতের গভীরে সমুদ্রের জলরাশির গতি
পরিমাপ করে আর ভাবে,
সাগরকূলে দুর্যোগের হাতছানি।
সরকারের কী জানি একটা দপ্তর আছে
আওভাও না আবহাওয়া অধিদপ্তর নাকি তার নাম
মোল্লা চাচাও টিভির খবরে জানতে পেরেছে
দু'য়েকদিন বাদে নাকি আসবে তুফান
সাত নম্বর না কয় নম্বর বিপদ সংকেতও
দেখাতে বলেছে
মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে
গভীর সাগর থেকে।
ঝড়ের ঠিক আগের দিন সকালে
সাগর কিনারের সব জাল
বাপ মা আর ভাই মিলে
ঘরের খুটির সাথে রাখলাম পুঁতে।
বাড়ির চালের হাড়ি সেটাও মাটির তলে
রাখলাম পুঁতে গর্ত করে।
ঐ দিনই ভর দুপুরে কারফিউ করে সরকারি লোকে
বলে, সবারে নাকি তুফান সেন্টারে আশ্রয় নিতে হবে
ঐ যে পাকা আর উচু রাস্তার ধারে
ঐখানে আমাদের স্কুল আছে
ঐ স্কুলই আমাদের তুফান সেন্টার
তুফান কালে গাদাগাদি করে
ঐখানেতে আশ্রয় মেলে।
পরের দিন তুফান একটু একটু করে শুরু হচ্ছে
খাল উবচিয়ে উবচিয়ে পানি বয়ে আসছে
বাতাসের গতি বাড়ে জোয়ারের পানিও উপচে পড়ে
শংকা আর সংশয় দুটোই বাড়তে থাকে।
তুফান শুরু হয়ে গেছে
সাগর গর্জন দিচ্ছে
বাতাসে সব ভেঙ্গে তছনছ করে দিচ্ছে।
মা, আমার ছোট ভাই
আর আমার সত্তর বছরের দাদী ছিলো যে
তাদের সমেত আমিও গিয়েছিলাম আশ্রয় কেন্দ্রে
আমার ছোটভাই তার এক জোড়া জুতা ফেলে এসেছে
ঠিক মনে হয় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে একটু দূরে
মায়ের মানা সত্বেও আমি গেলাম ছুটে
ছোট ভাইয়ের কান্না দেখে।
তুফান সেন্টার থেকে আমাকে বেশি দূরে যেতে হয়নি
বড় তুফানের গতিতে দুলতে দুলতে
জুতা জোড়া নিয়ে
ফিরছিলাম গন্তব্যের দিকে।
বুকের ভেতর একটাই ভয়
তুফানে যেন প্রাণ না যায়।
আমাদের রাস্তাটা বেশ উচু ছিলো
জোয়ারের পানিতে ভাসতে আরও দেরি ছিলো
তবে পানির বড় বড় ঢেউয়ে
রাস্তার দু'পাড় যে আছড়াচ্ছিলো
তা দিব্যি বোঝা যাচ্ছিলো।
হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায়
চোখের সামনে গাছ ভেঙ্গে পড়লো
আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম, খুব ভয় পেলাম
অনেকেই দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে
পরাণে নিয়ে আকুতি বেঁচে থাকার।
দু'পা ফেলতেই দু'জন মানুষ এলো
খুব অন্ধকার আর ঘুটঘুটে
সামনের কিছুই দেখা না গেলো
তাদের কাছে টর্চ বাত্তি ছিলো
সেটা জ্বালানোতেই আমাকে দেখলো।
এমন তুফান কালে সবাই যেখানে বাঁচতে ছোটে
আমাকে দেখে তাদের অন্যরকম নেশা পেলো।
দু'জনে মিলে প্রায় ঘন্টা খানেক আমাকে বদ্ধ রাখলো
আমার মুখের আওয়াজ বন্ধ করে দিলো।
হালকা টর্চ এ চাপ লাগতেই আমি তাদের মুখ দেখলাম
একজন আমার স্কুলের মাস্টার
আর একজন আমাদের মসজিদের ইমাম।
প্রথমে আমার শরীরে চাপলো আমার মাস্টার
হায়রে মানুষ! এতো লেবাস নিয়ে কুকুর তুমি
যে কি না এই তুফান কালে
নিজের মেয়ের বয়সী মেয়ের দেহের
লালসায় পুড়ে মরলে।
আমার কষ্ট যেমন হচ্ছিলো
ঘৃণা হচ্ছিলো তার চেয়ে বেশি
মানুষ এতো খারাপ হতে পারে।
ছি:! মানুষ ছি:!
তারপর এলো আমাদের ইমাম সাহেব
সাদা পাঞ্জাবী পরা মুখে লম্বা দাড়ি
আমাকে সেও ভোগ করলো তার ইচ্ছে মত
আমি কষ্ট ব্যাথা কোনো কিছুই মনে আনতে পারিনি
আমার মনেতে শুধু ঘৃণাই আসছিলো
এই লেবাসধারী কুকুরদের প্রতি
ছি:! মানুষ ছিঃ!
আমি শুধু দু'জনের মুখেই থুথু ছিটালাম
আমার প্রতিরোধের উপায় ছিলো না
তারা চলে গেলো
আমি রাস্তার ধারেই পড়ে থাকলাম।
মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙে
চারিদিক তুফানে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে
জোয়ারের নোনা জলে
আমার পুরো শরীর গেছে ধুয়ে
আমি তুফান সেন্টারের দিকে হাটতেই দেখি
মা দাদি আর আমার ছোট ভাই
আমি তাদের সাথেই বাড়ি ফিরলাম।
মানুষ গরু ছাগল আর কত প্রাণী বৃক্ষকূল
পড়ে আছে নিথর হয়ে
কত অসহায় হয়ে
বাস করে সাগর পাড়ে।
যারা মরেছে তাদের বিধ্বস্ত করেছে সাগর আর তুফান
কিন্তু আমাকে যারা বিধ্বস্ত করলো তারা তো মানুষ
মানুষের কাছেই অনিরাপদ থাকলাম?
কুকুর স্বভাবের মানুষ।
আমি সেই ঘটনা কাউকে বলিনি
না বাবাকে না মাকে
আমি বলতেও চাইনা
আমার মনে শুধুই ঘৃণা জন্মায় ঐ কুকুরদের প্রতি
সেই ষোলো বছর বয়স থেকেই এই ঘৃণা মনে পুষি
আমি ধিক্কার করি
নিঃশব্দে এখনো কান্না করি
ছি! ছি! এতো খারাপ মানুষ হয় কি?