সংকোচের সীমানা পেরিয়ে : মনজুরুল ইসলাম

আসমুদ্রহিমাচল মন্থন করবার সাথে যদি সংস্কৃতির বিশালত্ব মন্থনকে তুলনা করা যায় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে, তবে অবশ্যম্ভাবীরূপে সাংস্কৃতিক মন্থনটি স্থান পাবে সমুদ্র এবং হিমাচল মন্থনের ঊর্ধ্বে। এ কারণে যে, সংস্কৃতির বিশাল ক্যানভাস কোনো সীমায়তির ভেতরে অর্গলবদ্ধ নয়, যেমন হিমালয় এবং সমুদ্রের ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতার আওতাভুক্ত থাকে। অর্থাৎ সমুদ্র এবং হিমাচল জয় করা যদি কারো বিশেষ লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে সেটি সম্ভব হবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। কিন্তু সংস্কৃতিকে জয় করা এক্ষেত্রে একটি দুঃসাধ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে-এটিই স্বাভাবিক। যেহেতু এ পৃথিবীর মধ্যে যা কিছুই দৃশ্যমান সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত। এ প্রেক্ষিতে বিশাল সংস্কৃতির সকল শাখা প্রশাখার ভেতর সাহিত্য একটি প্রশাখা মাত্র। এই সাহিত্য রোমন্থন করলে রোমন্থনকারীর মননে যে বস্তুটি স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হবে সেটিই মূলত মনীষা অর্থাৎ জ্ঞান। এই জ্ঞান অন্বেষণ এবং আহরণ করবার প্রয়োজনে সংস্কৃতির প্রশাখা থেকে সাহিত্য নামীয় অতি ক্ষুদ্র একটি বৃন্তকে অবশ্যই নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে। এখন সাধারণ অথবা অসাধারণ জীবনায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী জানালাসমূহকে যদি উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় তবে সেই জানালাগুলির মাধ্যমে সাহিত্যের প্রবল আলোকরশ্মি জীবনের প্রতিটি বাঁককে একাধারে উজ্জ্বল করে তুলবে এবং মানব-মনীষা সেই উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয়ে অন্যের জীবনকেও প্রভাবিত করবে।

এই প্রেক্ষিত বিবেচনায় মনীষা অর্থাৎ জ্ঞান ব্যক্তিক, শৈক্ষিক এবং রাষ্ট্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এক বিশাল প্রভাব বিস্তারী ভূমিকা পালন করবে। যে জ্ঞান রুদ্ধ জানালাগুলিকে উন্মুক্ত করে দেবে, সেই জ্ঞানই আবার প্রকারান্তরে জানালাগুলির মাধ্যমে তার আলোকরশ্মি প্রশান্ত মহাশূন্যলোককেও ছাড়িয়ে যাবে। সেই আলোর বহুবর্ণে বিচিত্র বর্ণিলতা নিজের অন্তরকে আলোকিত করবার পাশাপাশি সামষ্টিক অন্তরকেও বিশ্ব চরাচরে অকাতরে বিলিয়ে দেবার তাড়না উপলব্ধি করবে। প্রকৃতিগতভাবে জ্ঞান নির্দিষ্ট কোনো আয়তনে অথবা আয়তনের বাইরে থেকে যে কোনো উপায়েই অর্জিত হোক না কেন আত্মপ্রতিভাকে তীক্ষ্ণতার সর্বোচ্চ মাত্রায় উত্তরিত করবার জন্য যা প্রথম শর্ত তা হলো- প্রতিভার তুমুল আলোড়ন। এ আলোড়ন প্রকৃত অর্থেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এ কারণে যে, তার চেতনায় প্রতিভার যে প্রজ্বলন সে প্রজ্বলনের শিখা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অন্য কোনো ব্যক্তির চৈতন্যে প্রবলভাবে আঘাত করে থাকে। এবং এই আঘাতটি প্রতিভাকে সমৃদ্ধ এবং বিকশিত করবার ক্ষেত্রে মূল প্রপঞ্চের ভূমিকা পালন করে সাবলীলভাবে। প্রাচীন থেকে শুরু করে বর্তমানের আধুনিক কাল পর্যন্ত উন্নত সভ্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের যে উৎকর্ষ সাধন করা হয় তার নেপথ্যে যে বিষয়টি একতম অভিধা হিসেবে গ্রাহ্য হবার যোগ্যতা ধারণ করে সেটি প্রশ্নহীনভাবে মানব-মনীষা অর্থাৎ মানুষের জ্ঞান। কিন্তু এই জ্ঞানই যদি মানুষের মানসলোকে স্থিতধী অধিষ্ঠান সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে যে কোনো বিষয়ের ওপর সাবলীল উপস্থাপনা মানবিকতা বোধকে ঋদ্ধ করবার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ উচ্চতায় নির্ণীত হওয়া উচিত তা হয় না। 

এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় অর্থাৎ ঈপ্সিত পথে হেঁটে হেঁটে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছবার যে প্রবল তাড়না সেই জ্ঞান থেকেই ব্যক্তিকে উৎসাহিত করে। আর এই উৎসাহটিই ক্রমান্বয়িকভাবে বয়সের তারতম্য নির্বিশেষে, সেই ব্যক্তিটিকে তার চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন এবং মার্জিত রুচিবোধের সর্বশেষ প্রান্তে উপনীত করে। সঙ্গত কারণেই সবার প্রতি একটি চিরন্তন সুকুমারবৃত্তি ব্যক্তিটিকে অন্যের সাথে উন্নতমানের সম্পর্ক স্থাপনেও একজন সহায়ক ব্যক্তি হিসেবে কাজ করে। একই সঙ্গে ব্যক্তিটির অভিজ্ঞানগুলি প্রতি মুহূর্তে সেই ব্যক্তিটিকে ধীরে ধীরে দক্ষতার সর্বোচ্চ শিখরে স্থাপন করে। যে বিষয়টি এক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবীরূপে স্বীকার্য এবং গ্রহণীয় সেটি হলো, যে কোনো বিদ্যাপীঠ অথবা অন্যান্য যে কোনো সংস্থায় অথবা সমাজের যে কোনো শ্রেণির মানুষের ব্যক্তির সেই তাড়নালব্ধ জ্ঞান যে কোনো বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবার দায়িত্বটি নিজে গ্রহণ করে। 

এখানে একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মধ্যরাত্রির কোনো এক সময়ে খেয়া পারাপারের উদ্দেশ্যে যাত্রীবোঝাই একটি নৌকোকে যখন তীরে নোঙর করবার উদ্দেশ্যে একজন মাঝি যাত্রীসহ নিজেকে এবং নৌকোটিকে রক্ষা করবার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করে, তখন তার মেধা, তার মনীষা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যাত্রীদের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ নৌকোর মাাঝির সে উদ্যোগ যাত্রীবৃন্দকে চূড়ান্ত অর্থে প্রভাবিত করে। তখন শুধু নৌকার মাঝি নৌকাটির একক কাণ্ডারী হিসেবে থাকেন না। তার সাথে যাত্রীরাও তাদের অবচেতন মনেই নিজেরাই একেকজন কাণ্ডারীতে রূপান্তরিত হন। যেহেতু, এই মুহূর্তে এখানে জীবনের প্রশ্নটি মুখ্য। এ প্রেক্ষিতকে বিবেচনা করে মানুষের কোনো শ্রেণি অথবা গোত্রকে বিশেষায়িত না করে প্রত্যেকের জন্য নিখুঁত দক্ষতা, কৌশল, প্রাণবান আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে সেই সব শ্রেণি বা গোত্রের মানুষ যদি তাদের সঠিক কর্মপ্রবাহে তাদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা প্রকাশে ব্যর্থ হন তাহলে তার নিজের জ্ঞানটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেক্ষেত্রে একজন মানুষ বা মানুষের সমষ্টি কখনই তার কালের প্রয়োজন পূরণ করে কালোত্তরিত হতে পারবেন না।

অন্তর্নিহিত প্রতিভাকে মৌলিক চৈতন্যের প্রতিভাসে প্রতিভাসিত করে, অর্থাৎ এর মাধ্যমে বার বার করে নিজেই নিজেকে আবিষ্কারের মাধ্যমে সৃষ্টির যে উপাদান অর্জন করবেন, সে উপাদান শুধু তাকেই সমৃদ্ধ করবে না বরং শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকেও তার সমাধানের দক্ষতা অর্জনে অত্যধিক উৎসাহিত করে তুলবে। আর এর ফলে সেই সমস্ত শ্রেণি পেশার মানুষজন যখন জটিল কোনো পরিস্থিতি অথবা সংকটের মুখোমুখি হবেন তখন সেই পরিস্থিতি এবং সংকট উত্তরণে নিজেকেই সফল করে তুলবেন অন্য কারো সাহায্য ব্যতিরেকেই। একজন প্রকৃত শিক্ষক তার সমগ্র সাধনাকে নিয়োজিত করেন একজন শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে অগ্রগামী হতে, অগ্রগামী হয়ে, যে কোনো বাধা অতিক্রম করে তার লক্ষ্য অর্জনে নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করেন। একই ভাবে অন্য কোনো পেশার মানুষও যদি তার জ্ঞানকে উদ্ধৃত অর্থে ব্যবহার করতে পারেন তাহলে কখনোই তাকে গ্লানিকর আচরণে আবৃত হতে হবে না। 

এখন যদি প্রাতিষ্ঠানিক কৌণিক দৃষ্টি দিয়ে শিক্ষার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত পেশাজীবীর পেশাগত দিকটিকে দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় বিদ্ধ করা যায় তাহলে একটি বিষয় অনিবার্যভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, পেশাভিত্তিক কাজে ব্যাপৃত মানুষগুলি তাদের জীবিকায়নের প্রয়োজনে এবং পেশার প্রতি অনুগত থাকবার প্রয়োজনে সেই পেশার জন্য তাকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি ধরে নিই যে, একজন চর্মকার, চামড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করছেন অথবা কোনো একজন শিল্পী তার শিল্প সৃজনের প্রয়োজনে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করছেন, একইভাবে তাকেও সেই ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এ প্রেক্ষিতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের মাঝখানে যে বিষয়টি সেতুবন্ধ রচনা করে সেটি হচ্ছে শেখাবার এবং শিখবার আগ্রহ। একজন শিক্ষার্থীর মননে যদি যে কোনো বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষার প্রাচুর্য না থাকে, যে আকাঙ্ক্ষা তার মনোজগতকে আন্দোলিত করতে থাকবে অবিরত, তাহলে সে যে কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী হবে না। পাশাপাশি একজন শিক্ষক যদি ঐ শিক্ষার্থীকে তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হন তাহলে তার অবচেতনতায় তিনিও শিক্ষকতার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

অর্থাৎ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে বিষয়ভিত্তিক এমন একটি সূত্রের সৃষ্টি করতে হবে, যে সূত্রটির এক প্রান্তে থাকবেন শিক্ষক এবং অপর প্রান্তে থাকবেন শিক্ষার্থী। এই দুজন ব্যক্তি একই বিষয়ের ওপর ধীরে ধীরে সূত্রটির দু’প্রান্ত থেকে অগ্রগামী হতে থাকবে। এবং অগ্রগামিতার মাধ্যমে দুজনই সূত্রটির মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করবে। যদি এটি করা যায় তাহলে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী দুজনই তাদের মোক্ষ লাভে সফল হবেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থী তার আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতা লাভ করবে শিক্ষকের কাছ থেকে। একইভাবে শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করবার ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক ভূমিকা তার তৃপ্ততার উপলব্ধিকেও সমৃদ্ধ করবে। 

একজন শিক্ষক যে কোনো বিষয়ের ওপর যখন তার সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন তখন এটি অবশ্যই অস্বীকার করা যাবে না যে, শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের উপস্থাপনায় আকৃষ্ট হয়েছে। পরবর্তীকালে ঐ শিক্ষার্থীরাই যখন বিষয়ভিত্তিক কোনো কিছুর ওপর নিজেরাই উপস্থাপন করবে তখন আপনা আপনি তাদের শিক্ষকের উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সার্বিক দিক আপনা আপনি তাদের উপস্থাপনায় বিকশিত হতে থাকবে। বস্তুত শিক্ষা গ্রহণের মূল কথাটিই এখানে। এখন এই বিকাশমানতাকে যদি যে কোনো বিষয় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মৌলিক একটি উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা যায় তাহলে এই গৃহীত উপাদানটি শিক্ষার্থীকে তার সম্পাদিত যে কোনো কাজের পরিপূূর্ণতা আনয়নের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করবে। এ কারণে যে, এ বিশেষ উপাদানটি একাধারে যেমন তার বুদ্ধিমত্তার স্ফুরণ ঘটাবে, পাশাপাশি সেই বুদ্ধিমত্তাকে অবলম্বন করে সে একটি সম্পূর্ণ মৌলিক কর্মসৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে। 

কিন্তু এর অভ্যন্তরে একটি প্রশ্ন আপনা আপনি উপলব্ধ হবে যে, বুদ্ধিমত্তার স্ফুরণের মাত্রাটি উচ্চতার কী অথবা কোন পর্যায়ে স্থিত হবে। যদি বুদ্ধিমত্তার মাত্রা, তার বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমে সেই স্থিতিটিকে সর্বোচ্চ মাত্রা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে তাহলেই কেবল তার কর্মটির সম্পূর্ণতাকে স্বীকৃতি প্রদানের যোগ্য হিসেবে বিবেচনায় আনা যেতে পারে। এখন সর্বোচ্চ মাত্রাটি নির্ধারণের কর্তৃত্ব কার কাছে থাকবে? এটি কি যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর ওপর অথবা যারা তাঁর এই সৃষ্টিকে আত্মস্থ করে বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করছেন। এখানে আপনা আপনি দুটো বিষয়ের অবতারণা করা হলো- এক: স্রষ্টা, দুই: সৃষ্টি অবলোকন করে বিশ্লেষণকারী। যদি বিশ্লেষণকারীর কাছে মাত্রাটি সর্বোচ্চ বলে স্বীকৃত না হয় এবং এই না হওয়ার বিষয়টি যদি সামষ্টিক হয় তাহলে দ্বিতীয় অর্থে স্রষ্টাকে বাধ্য হতে হবে তাঁর সংজ্ঞায়িত মাত্রার উচ্চতাটিকে সার্বিকভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করবার। এটি না করলে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি বিশ্লেষণকারীর মাঝে একটি দূরত্বের সৃষ্টি হবে। যা স্বভাবজভাবেই স্রষ্টাকে তাঁর উচ্চতার সংজ্ঞাকে পুনর্মূল্যায়ন করে বিশ্লেষণকারীর কাছাকাছি আসবার চেষ্টা করতে হবে অনিবার্যভাবে।
এখন এ বিষয়টিকে যদি বিশ্বজনীনতার মাপকাঠির ফ্রেমে আবদ্ধ করে পুরো বিষয়টির সার্বিক বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হওয়া যায় তাহলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হিসেবে বিবেচিত অথবা গ্রহণীয় কিছু ব্যক্তির নাম আপনা আপনি দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। উপমা হিসেবে আমরা প্রথমেই যদি ধরে নিই বর্তমান বিশ্বের বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে কিংবা আলোচিত নোবেলজয়ী নাইজেরিয়ান কবি ওলে সোয়িংকাকে, তাঁদেরও পূর্বসূরিদের মধ্য থেকে যদি আমরা দেখি ম্যাক্সিম গোর্কি অথবা আন্তন চেখভকে তাহলে অবশ্যই আমরা প্রত্যক্ষ করব বিষয়ভিত্তিক স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের সৃষ্টি দেদীপ্যমান। এই “দেদীপ্যমান” কথাটি বলবার উদ্দেশ্যটিই হলো শিক্ষার মৌলিকত্ব। যেহেতু সৃজনশীলতার দিক থেকে তাঁদের সৃষ্টিসমূহ এককভাবে নয়, সামষ্টিকতার ওপর নিশ্চিতভাবে আলোকসম্পাতি।

এ কারণে যে, যদিও মার্কেজ তাঁর সৃষ্টিতে যেভাবে শিক্ষার ওপর আলোকপাত করেছেন, মার্কেজের সৃষ্টিকে যদি লক্ষ করা যায় বিশেষত তাঁর অত্যন্ত কষ্টসাধ্য সৃষ্টি “কর্নেলকে কেউ লেখে না” নামীয় উপন্যাসটি যাকে আয়তনগত দিক থেকে ক্ষুদ্রই বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু সেই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটিতে তিনি সমাজের সামষ্টিক জনগোষ্ঠীকে যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন তা অবশ্যম্ভাবীরূপে শিক্ষা। যেহেতু ঐ উপন্যাসের প্রত্যক্ষ নায়ক একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। কিন্তু তারই পাশাপাশি ওই উপন্যাসের প্রতীকী নায়ক একটি “লড়াইয়ের মোরগ। এখানে বার্তাটিকে শিক্ষা বলা হলো এ কারণে যে, মোরগটি প্রতি মুহূর্তে কর্নেলকে উৎসাহিত করছে কখনোই এবং কোনোভাবেই পরাজয় কারো কাছে কাম্য হতে পারে না। এর নেপথ্যে যে কথাটি রয়েছে সেটি হলো মোরগটি কখনোই কোনো মোরগযুদ্ধেই পরাজয় বরণ করে নি। এখানে অভাবের তাড়নায় জর্জরিত এবং ক্লিষ্ট কর্নেল তাঁর স্ত্রীর প্ররোচনা সত্ত্বেও মোরগটিকে অর্থের বিনিময়ে কারো কাছেই বিক্রয় করেন নি। স্ত্রীর প্ররোচনা তো ছিলই, তারপরেও প্ররোচনার বাইরেও প্রতারণার প্রত্যক্ষ শিকার হয়েও সেই মোরগটির নির্বাক উৎসাহের কারণেই কখনোই কর্নেল তাঁর নিজ গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসেন নি। এটি তাঁর প্রচণ্ড ব্যক্তিসত্তা, আত্মোৎকর্ষের উচ্চতম মাত্রা এবং স্বাধীনতার প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ বিশ্বস্ততা তাঁর নিজের মধ্যে ধারণ করবার জন্যই সম্ভব হয়েছিল।  

এখন মোরগযুদ্ধের ঐ মোরগটিকে যদি কর্নেল তাঁর শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন তাহলে কর্নেলের আত্মোপলব্ধির শক্তিটি কতখানি তীব্র এবং তীক্ষ্ম তা অনুভব করা যায়। যে শিক্ষা তিনি মোরগটির কাছ থেকে গ্রহণ করলেন সেই একই শিক্ষা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা উচ্চ বিদ্যানিকেতনের কোনো প্রাজ্ঞ শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদেরকে প্রদান করেন সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য হবে সেই শিক্ষকের প্রদত্ত শিক্ষাটিকে দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করা। শিক্ষা এমনই একটি বিষয় যা একজন শিক্ষার্থীকে তার বোধের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে দিতে পারে। সে শিক্ষার পদ্ধতিগত দিকটি যাই হোক না কেন, শিক্ষার্থীর বোধের বৃত্তায়নে শিক্ষার মূল কথাটি একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলবে। যে প্রাচীরটি আপনা আপনি সেই শিক্ষার্থী কর্তৃক রক্ষিত হতে থাকবে যুগ যুগ ধরে। এবং এই শিক্ষাটিকেই সেই শিক্ষার্থী তার জীবনপ্রবাহের গতিশীলতাকে অনিবার্যভাবে বৃদ্ধি করতেই থাকবে যতদিন তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। 

এখানে বিষয়টিকে সিদ্ধ করবার জন্যে আর একটি উদাহরণ উপস্থাপন করা যেতে পারে। বিশ্ববিশ্রুত লেখক আন্তন চেখভের “সজল সারস” নামীয় গল্পটিকে যদি এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় গ্রহণ করা যায় তাহলে আমাদের দৃষ্টি একটি বিন্দুতে গিয়ে ঠেকবে; যে বিন্দুটির মর্মবাণী অব্যাহতভাবে নিয়ত ঘোষণা করছে, যে শিক্ষা সর্বজনীন মানুষের সার্বিক কল্যাণে ব্যাপৃত হতে পারে না সে শিক্ষা সব সময়ের জন্য নেতিবাচক। যেমন ওই গল্পটিতে একজন মানসিক রোগের চিকিৎসক, যিনি তাঁর কর্মের প্রতি একশত ভাগ অনুগত এবং নিষ্ঠাবান। সেই ব্যক্তিটিকে যদি যে কোনো স্বার্থের কারণে কৃত্রিমভাবে তাঁকেই মানসিক রোগীতে পরিণত করে শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাহলে সেই বিষয়টি থেকে যে শিক্ষাটি আসবে একদিকে যেমন তা নেতিবাচক অন্যদিকে তার চাইতেও কয়েকগুণ বেশি ইতিবাচক। বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে শিক্ষার্থীরা জানবে যে, একজন মানুষ তাঁর পেশা, তাঁর কর্মের প্রতি সৎ এবং নিষ্ঠাবান থেকে সেই সব মানসিক রোগীদের ভেতরে নতুন করে জীবন প্রবাহের সৃষ্টি করবার ক্ষেত্রে যে অপরিমেয় অবদান রেখে চলেছেন নিয়ত সেই লোকটিকে নিছক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একটি সৎকর্মের পূর্ণ পরিধিকে চুরমার করে দেয়া হলো। অর্থাৎ জীবনের গতি অন্বেষণ করে সেই গতিকে ধারণ করে এগিয়ে যাবার যে প্রচেষ্টাটির উদগম সম্ভব হয়েছিল সেটিকে ধ্বংস করে ফেলা হলো।

এখানে যে শিক্ষাটি আমরা লাভ করেছি সেটি একদিকে যেমন অসৎ মানুষ সৃষ্টি করবার একটি আঁধারে আবৃত প্রয়াস অপরদিকে তেমনি সেই আঁধারকে অগ্রাহ্য করে পুনরায় আলোকের আহ্বান জানিয়ে সেই আলোকোজ্জ্বল রশ্মির মাধ্যমে সেই অন্ধকারের দুর্গটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করবার এক হৃদয়স্পর্শী এবং প্রতিশ্রুতিশীল অঙ্গীকার। অর্থাৎ নেতিবাচক দিকটিকে প্রত্যক্ষ করবার পর সেই নেতিবাচক দিকটিকে পরোক্ষভাবে ইতিবাচকতার আবহে চিন্তার পলিতে স্থান দেয়া।

এখানে উল্লিখিত উদ্ধৃতি থেকে এখন একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একজন শিক্ষক, একজন শিক্ষার্থী অথবা যে কোনো একজন মানুষের চৈতন্যগত অবস্থানের দিকটি। এটিকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই আসতে হবে চৈতন্য নির্মাণের পদ্ধতিগত বিষয়টিতে। চেতনার উত্থান এবং সেই উত্থানের মৌল ভিতটি কী? যদি ভিতটি চিন্তাশীলতা হয় তাহলে সে চিন্তাশীলতার তীক্ষ্ণতার পরিধি কোন স্তর পর্যন্ত সচলমানতার দাবি করতে পারে? যদি ভিতটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয় তাহলে চিন্তাশীলতার তীক্ষ্মতার মাত্রাটি একটি নির্দিষ্ট স্তরে গিয়ে থেমে যাবে। সেই স্তরের পরে যদি কোনো স্তর থাকে তবে সেই তীক্ষ্মতার স্বর সেই স্তরটিকে আঘাত করতে পারবে না। এবং এই আঘাত না করার ব্যর্থতা তার চিন্তাশীলতার মাত্রাকে একটি ম্রিয়মাণ জড়তায় রূপান্তরিত করবে। সে প্রেক্ষিতে উদ্ধৃতি দুটো থেকে ঐ চিন্তাশীলতা কিছুই আহরণ করতে পারবে না। কিন্তু, যদি না পারে সেক্ষেত্রে তার চৈতন্য নির্মাণের বিষয়টিও যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন শিথিল হয়ে পড়বে।

এই চৈতন্য নির্মিতির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রুশ সাহিত্যলোকের মহাকাশের ঠিক মধ্যবিন্দুতে মিট মিট করে অবিরাম জ্বলতে থাকা ক্লান্তিহীন পথচারী আর এক কালজয়ী মহাপুরুষ ম্যাক্সিম গোর্কির কাছে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। এ কারণে যে, ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর একটি গল্প “চেলকাশ” এর বিষয়বস্তুতে যা উৎকীর্ণ করেছেন সেই উৎকীর্ণিত আলোকরশ্মির বিকিরণ আমাদের চৈতন্য নির্মিতির ক্ষেত্রে যে একটি বিশাল মাপের শিক্ষা প্রদান করেছিল তা বক্ষমান আলোচনার মৌলিক নির্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যে গল্পটিতে ম্যাক্সিম গোর্কি চেলকাশ নামীয় নিতান্তই একজন চোরের মূল্যবোধ মানবিকতার প্রতি কতটা দায়বদ্ধ হতে পারে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। একজন রিক্ত, নিঃস্ব, কর্মহীন অথচ সৎ একজন তরুণের বেঁচে থাকবার আকুতির কাছে যে লোকটি নিজেকে আকণ্ঠ সমর্পণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার চুরি করা অর্থের পুরোটাই ওই তরুণটিকে অকাতরে দান করতে পারে- নিতান্তই একজন চোরের পক্ষে কি এটি করা আদৌ সম্ভব?

এখন আমরা যদি ম্যাক্সিম গোর্কিকেই সেই চেলকাশ নামীয় চোরের চরিত্রটিতে প্রতিস্থাপন করি তাহলে আমরা কী প্রত্যক্ষ করব? এটিই নয় কি যে, ম্যাক্সিম গোর্কি নিজেই উদ্ধৃত গল্পে সেই কর্মহীন নিষ্পাপ তরুণ গ্যাব্রিলার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন- কোনো পাপ না করেও, কোনো অসামাজিক কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত না রেখেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা যায় এবং পাশাপাশি চেলকাশের কাছ থেকে তরুণচিত্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে-সঠিক পথে থেকেও ইচ্ছের দৃঢ়তাকে পুষ্ট করে একজন চোরকেও ভালো মানুষে রূপান্তরিত করা সম্ভব। 
এ প্রেক্ষিতে অবশ্যই বিবেচনা করতে হব- বক্ষমান আলোচনায় উদ্ধৃত যোগসূত্রটির কথা। যে সূত্রটির দুপ্রান্তের এক প্রান্তে একজন শিক্ষক এবং অন্য প্রান্তে একজন শিক্ষার্থী মুখোমুখি অগ্রগামী হতে হতে এক পর্যায়ে এসে সূত্রটির মধ্যবিন্দুতে মুখোমুখি দণ্ডায়মান হয়ে দুজন দুজনের অর্থাৎ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর আন্তরিক ভাবের আদান প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন। এখান থেকে যে শিক্ষাটি আমরা লাভ করলাম তার মূল কথাটিই হলো-শিক্ষকের সঠিক শিক্ষা প্রদানের সক্ষমতা এবং শিক্ষার্থীটির অবলীলাক্রমে সে শিক্ষাটিকে স্বাধীনভাবে আদ্যোপান্ত গ্রহণ করবার মানসিকতা। তাহলে এখানে স্পষ্ট যে, কিছু শিখবার প্রথম শর্তটিই হলো শিক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষাকে আমূল নিজের মধ্যে ধারণ করা। প্রসঙ্গক্রমেই এখানে আমরা আফ্রিকা অঞ্চলের একটি দেশ নাইজেরিয়ার নোবেলজয়ী কবি ওলে সোয়িংকা-এর একটি কবিতার কিছু অংশের উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করবার চেষ্টা করবো।   
“বাড়িভাড়া আয়ত্তের মধ্যেই, বাড়ির লোকেশন চমৎকার।
বাড়িওয়ালা বাড়িতে থাকেন না, এছাড়া চার বাড়ি আছে
কিন্তু এর পরেও যে কথাটি থেকে যায় সেটিই বলতে হল, যেন
দোষ স্বীকার করে বলার মতো, বলো: ম্যাডাম, কষ্ট করে যে
বাড়ি দেখতে আসব, শেষ পর্যন্ত থাকতে দেবেন তো?
আমি আফ্রিকান।”
...
“আফ্রিকান নিগ্রো ঘোর
কালো রং, নাকি তোমার গায়ের খানিক হাল্কা কালো?”

...

“আপনি কি আমার গায়ের রংকে
চকোলেটের রং দিয়ে বুঝে নিতে চান? মানে আপনি জানতে
চাইছেন আমার গায়ের রং, প্লেইন চকোলেট, নাকি মিল্ক
চকোলেটের মতো কালো?” টেলিফোনের ওপার থেকে কোনো কথা নেই, গভীর
নৈঃশব্দে গিলে খেয়েছে টেলিফোন সেট।”
...
“গায়ের সবটা এমন কালো নয় ম্যাডাম
শুধু মুখ নয়। আমার সর্বাঙ্গে দেখুন আমার হাতের তালু তীব্র
কালো নয়, খানিক লালচে ছোপ আছে তাতে, আমার পায়ের পাতা
বিশ্রী কালো নয়, ম্যাডাম, হ্যালো ম্যাডাম, হ্যালো,
আপনি নিজে স্বচক্ষে দেখবেন না কেমন আমার রং?
রিসিভার রেখে দেবার নির্মম শব্দ শোনা গেল।”
উদ্ধৃত কবিতাটির সম্পূর্ণ ভাবানুষঙ্গতার ভেতর থেকে কী শিক্ষাটি আমরা লাভ করলাম? এ প্রশ্নটির সঠিক জবাব কবিতাটির মধ্যেই কবি অসংকোচে প্রকাশ করেছেন। নাইজেরিয়া একটি কালো মানুষের দেশ। সে দেশের শতকরা ৯৫ শতাংশ মানুষই কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু এই ৯৫ শতাংশ কালো মানুষ দীর্ঘকাল থেকে সীমাহীন নির্যাতনের ভেতর দিয়ে শাসিত হয়ে আসছে মাত্র পাঁচ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ শ্রেণির মানুষের দ্বারা। যেহেতু ঐ পাঁচ শতাংশ মানুষ প্রবলভাবে সামরিক শক্তিধর হিসেবে নিজেদেরকে সে দেশের অসহায় মানুষগুলির কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মূল কারণটি ছিল- উল্লিখিত ৯৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই প্রকৃত শিক্ষার আলোকে আলোকিত নয়। অর্থাৎ গোটা নাইজেরীয় জাতিটি শিক্ষা এবং আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষের সাথে মোটেই পরিচিত নয় - এক অর্থে তাদেরকে শিক্ষা এবং আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষের সাথে পরিচিত হবার সুযোগই করে দেয়া হয় নি এক ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। একজন মানুষ যিনি তার দেশেই একটি বাড়ি ভাড়া নেবেন তিনি কৃষ্ণাঙ্গ, যার কাছ থেকে নেবেন তিনি শ্বেতাঙ্গ, সেহেতু তিনি বাড়িভাড়া গ্রহণকারী ব্যক্তিটির গায়ের রং সম্পর্কে অবহিত হয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়িটি আর সেই নাইজেরীয় ব্যক্তিটিকে প্রদানই করলেন না। কথা শেষ হবার পূর্বেই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিটি কর্তৃক টেলিফোনের রিসিভারটি রেখে দেবার শব্দটিই যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। 

কবিতাটিতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, মানুষের শরীরের রংটিই মানুষের মনুষ্যত্বকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে। এই বিষয়টি থেকে একজন শিক্ষক যেমন নিজে শিক্ষা গ্রহণ করে সেই শিক্ষা অর্থাৎ “মানুষ মানুষই” শরীরের রং মনুষ্যত্বের পরিচয় ধারণ করে না, তার শিক্ষার্থীদেরকে বোঝাতে সক্ষম হন তাহলে সেই শিক্ষার্থীটি মনুষ্যত্বকে রক্ষা করবার জন্যে নিজের মনের ভেতর থেকেই অধিক মাত্রায় আগ্রহান্বিত হয়ে উঠবে এবং এই লভিত শিক্ষাটি শিক্ষার্থীটি তার সতীর্থ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছে অবিকল বর্ণনা করবে। সার্বিকভাবে কেবল তখনই বিষয়টি সর্বব্যাপকতা লাভ করবে। পরন্তু, শিক্ষার্থীটি সেই মুহূর্ত থেকে মানুষ হিসেবে বর্ণবাদকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করতে শুরু করবে এবং একই সাথে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠবার উৎসাহ অর্জন করবে।  

একটি জাতি- জাতিটি যে রাষ্ট্রের, যে ধর্মের অথবা যে কোনো বর্ণ বা গোত্রের হোক না কেন, সে জাতিটির যে ক’টি মৌলিক অধিকার রয়েছে সেক’টির মধ্যে প্রথমটি হলো- বেঁচে থাকবার অধিকার এবং দ্বিতীয়টি হলো সন্দেহ অথবা প্রশ্নের অবকাশ না রেখেই উচ্চ শিক্ষা লাভ। জাতিটির বেঁচে থাকবার প্রশ্নে যে ক’টি শর্ত পূরণ অনিবার্য সেক’টির মধ্যে স্বাস্থ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো বিষয়গুলি একেকটি মূল অনুষঙ্গ। এই অনুষঙ্গগুলি বেঁচে থাকবার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলে জাতিটি যেভাবেই বলা হোক না কেন, বেঁচে থাকবার ক্ষেত্রে নিস্পৃহ হয়ে পড়বে। এটি হলে জাতিটি হয়ত ন্যূনতমভাবে কিছু কালের জন্যে শুধু জীবনধারণের ক্ষেত্রে বিরামহীন ক্লান্ত শরীরে চেষ্টা করে যাবে- যাকে কখনোই জীবন-যাপন বলা যাবে না। সর্বশেষ মাত্রায় গিয়ে বলা যাবে হয়ত কেবল জীবন ধারণ আর ধারণকৃত জীবন নিয়ে যদি যাপিত জীবনের একান্ত আপনার সুখবোধটিকে উপলব্ধি করা না যায় তাহলে সে জীবনধারণের প্রয়োজনীয়তাও অসার প্রমাণিত হয়। 

ঠিক তেমনি জাতিটির মর্মলোকে যদি আলোকিত শিক্ষার বিচ্ছুরণ প্রবিষ্ট করানো সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে জীবনধারণের মতোই শিক্ষাহীনতার কারণে একাধারে গ্লানি এবং মর্যাদাহীনতাকে নিয়েই জাতিটিকে ক্ষণে ক্ষণে যেমন অসম্মানিত হতে হয় এবং এর ফলে জাতিটির সংস্কৃতিটি যেভাবে নিম্নগামিতার দিকে ধাবিত হয় তা জাতিটিকে তার মননশীলতার দিক থেকে প্রতি মুহূর্তেই হত্যা করে চলে। এ কারণে যে, সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি জাতির উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ঊর্ধ্বায়িত সংস্কৃতি নির্মাণের ক্ষেত্র ভূমিটিকে কর্ষণ উপযোগী করে তোলার প্রথম এবং সর্বশেষ দাবিটিই হলো যথোপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করা। এটি শুধু দাবিই নয় এটি ঐ জাতিটির একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি জাতিটির অন্তর্ভুক্ত যে কোনো ব্যক্তির একটি শিশু জন্মলাভ করবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অর্থাৎ জন্মাবার পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই অধিকারটি শিশুটির জন্যে, ব্যাপক অর্থে জাতিটির জন্য স্বভাবজ চাহিদার একটি অন্যতম অংশ। এই অংশটি পূরিত না হলে জাতিটির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নও সম্ভব হয়ে উঠবে না।
 
কিন্তু জীবন-যাপনের জন্যে যেমন কিছু অনুষঙ্গের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য তেমনি শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রেও কিছু অনুষঙ্গ অপরিহার্য। যে সব অনুষঙ্গের ভেতর-  ১. অভিভাবকের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ২. সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলবার প্রশ্নে যা প্রয়োজন অর্থাৎ বিদ্যালয়ে ভতি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে নেবার নিরঙ্কুশ প্রচেষ্টা ৩. প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদির সাথে বিদ্যালয়ের পরিবেশ অনুযায়ী পোশাক পরিচ্ছদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান এবং ৪. প্রয়োজনে সন্তানটিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে অভিভাবক যদি সক্ষম না হন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্য না হন তাহলে তাৎক্ষণিকতায় সমস্যার প্রকৃতি নির্ধারণ করে রাষ্ট্রকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা। চূড়ান্ত অর্থে শিক্ষা গ্রহণের বিদ্যমান পরিবেশে যদি কোনো বৈষম্য থাকে তবে সেটির মূল উপড়ে ফেলা। একজন প্রান্তিক স্কুল অথবা কলেজের শিক্ষার্থী যেন শহুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মতো সমমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগটি পেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করবার দায় রাষ্ট্রের। একই সাথে স্থিত এ সমস্যাটি সৃষ্টিতে যারা অব্যাহতভাবে অন্যায় ভূমিকা পালন করে চলেছে তাদেরকে শনাক্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও রাষ্ট্রিক দায়বদ্ধতার বাইরে ন পড়া উচিত নয়।  

প্রকৃত অর্থে এই অনুষঙ্গসমূহ একজন শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের যে ভিতটি নির্মাণ করবে সেই ভিত থেকে শিক্ষার্থীটি কখনোই এবং কোনোভাবেই উৎসাদিত হতে পারবে না। এবং ঠিক তখনই জাতিটিও তার নিজের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে অন্যান্য উন্নত জাতির সম্মুখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কথা বলবার সক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান এই বৈষম্যকে জিইয়ে রাখে তবে সেটি হবে সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বাভাবিকভাবেই কোনো শিক্ষার্থী যখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, তার মধ্যে প্রতিভার অগ্নি শিখাটি থাকবার পরেও সেটি স্বাভাবিক মাত্রায় জ্বলে উঠতে পারছে না কিংবা সেটি দাউদাউ করে জ্বলতে না দিয়ে বরং চিরতরে নিভিয়ে দেয়া হচ্ছে তখন সেই শিক্ষার্থীর মাঝে বিরাজ করবে চরম হতাশার। এবং এই হতাশাটি যে সন্ত্রাসবাদের দিকে পর্যবসিত হবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? 

এখন এই প্রবন্ধে যত কিছুই আলোচনা করা হলো, যা কিছু উদ্ধৃত করা হলো এবং যাদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো তাদের কাছ থেকে এবং সে সব উদ্ধৃতি থেকে আমরা কী এবং কোন বার্তাটি লাভ করলাম? নিঃসন্দেহে বলা যায়, কোনো প্রকার বাধা বিঘ্নের কারণে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনে যে কোনো প্রকার সংকোচকে অগ্রাহ্য করে শুধু লক্ষ্য অর্জন করাটিই একজন শিক্ষক, একজন শিক্ষার্থী তথা গোটা জাতির অঙ্গীকার হওয়া উচিত। প্রকৃতপক্ষে এই অঙ্গীকারটুকু পালনে যখন রাষ্ট্রীয় মনন সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হবে তখন আপনা আপনি রাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সক্ষম হবে।

০৫/০৬/২০১১খ্রিষ্টাব্দ
লালমনিরহাট

তথ্যসূত্র:  
১. কর্নেলকে কেউ লেখে না, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, অনুবাদক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, (এম্পানিয়োল থেকে অনুবাদ) প্রথম প্রকাশ, অমর একুশে বইমেলা ২০১৫।। প্রথমা প্রকাশন, কারওয়ান বাজার , ঢাকা-১০০০। 
২. আন্তন চেখভের শ্রেষ্ঠ গল্প, সজল সারস অনুবাদ-জুলফিকার নিউটন, অমর একুশে বইমেলা, ঢাকা-২০১০, তাম্রলিপি।। বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।। পৃষ্ঠা ৩৭৬-৪২০। 
৩. শ্রেষ্ঠ গল্প, চেলকাশ, ম্যাক্সিম গোর্কি, সম্পাদনা মশিউল আলম, অনুবাদ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, চতুর্থ মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৩।। মাওলা ব্রাদার্স।। অবসর, বাংলাবাজার ঢাকা।। পৃষ্ঠা নং-০৩-৩০। 
৪. রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত, কবিতা দেশে দেশে, একুশে ফেব্রুয়ারি ২০১২।। কথা প্রকাশ।। শাহবাগ, ঢাকা।। পৃষ্ঠা নং-৯৭। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ।

1 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

  1. শাফায়াতJune 24, 2024 at 8:00 PM

    দীর্ঘ পুরাতন শব্দকন্টকিত নিবন্ধটি পাঠ করিয়া ইহাই বুঝিলাম যে কিছুই বুঝিলাম না। ইহা প্রমাণিত হইল যে লেখক এমন মাত্রার পণ্ডিত যে আমাদের মত তুচ্ছ জ্ঞানের ব্যক্তিদের ইহার নাগাল পাওয়া দুরূহ।

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।