একাত্তরের দিনগুলি, লেখক : জাহানারা ইমাম, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ১৯৮৬,প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী, প্রকাশক: সন্ধানী প্রকাশনী |
জাহানারা ইমাম বুকে পাথর চাপা দিয়ে একসাগর দুঃখকে বিন্দু বিন্দু শব্দে একাত্তরের দিনগুলোতে তুলে ধরেছেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বরে ডায়েরি লেখা শেষ হয়। শেষ হয়েছে জামীর সাথে মেজর হায়দারের রসিকতার ভেতর দিয়ে। মেজর হায়দার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ দেখা করতে এসেছেন। ভাই রুমি এবং পিতা শরীফকে হারিয়ে জামীর মাঝে অনেকটা অসংলগ্নতা এসেছে। জামীর ইচ্ছে ছিল চাইনিজ রাইফেল হাতে ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হলে ছাদের উপর থেকে গুলি ছুঁড়ে ভাইয়ের প্রতিশোধ নেবে কিন্তু তার আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমানে বোমাবর্ষণ, আক্রমণ এসবের মধ্যদিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তাই জাহানারা ইমাম মেজর হায়দারকে বলেন,
' জামী পারিবারিক অসুবিধার কারণে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি । ও একেবারে পাগল হয়ে আছে। ওকে কাজে লাগাও। '
কষ্টের শেষপ্রান্তে এসে এসব কথা শুধু বলার জন্যই বলা। মেজর হায়দারও জামীকে বলে তার বডিগার্ড বানাবে । বলেন, ' এটা খুব টাফ জব। চব্বিশঘণ্টা ডিউটি। ' পিতার মৃত্যুর পর এই প্রথম জামী দাঁত বের করে হাসে। বলে, ' আটচল্লিশ ঘন্টা হলেও পরোয়া নেই।' স্কুলছাত্র জামী মেজর হায়দারের কথায় সাময়িক এডভাঞ্চার অনুভব করে হেসে ফেলে। কথোপকথনের এটাই উদ্দেশ্য ছিল।
বইটি শুরু হয় ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে। শুরুর প্রথম লাইন,
' আজ বিকেলে রুমী ক্রিকেট খেলা দেখে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসবে হ্যামবার্গার খাওয়ানোর জন্য। '
স্বচ্ছল পরিবারে রুমির এটাই ছিল জীবনের স্বাভাবিক রুটিন । ইন্টার পাশ করা অপেক্ষা করছেন ইঞ্জিয়ানিয়ারিং পড়বেন আমেরিকায় ।এর মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । পাকিস্তানের শাসকদের সাথে ক্ষমতার বদল নিয়ে মার্চের শুরুর দিনগুলোতে কথা চলছিল । ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠক, সাতই মার্চের ভাষণ এসব পরিপ্রেক্ষিত যেভাবে ঘটে সেসব বর্ণনা ঢাকা শহরের একজন সাধারণ বাসিন্দার দৈনন্দিন জীবনের সাথে উঠে আসে বইয়ের শুরুতে।
ধীরে ধীরে যুদ্ধ ঘনিয়ে আসে। রুমি মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। আগরতলায় খালেদ মোশারফের অধীনে ট্টেনিং শেষ করে ঢাকায় ফিরে নানা স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর গেরিলা কৌশলে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায় । সারাদেশে গেরিলা কৌশলে যুদ্ধ তখন চলমান । রাজধানি ঢাকায় রুমিদের সেই আক্রমন ছিল টু-আরলি। কেননা ঢাকায় প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হয় একেবারে শেষদিকে বিজয়ের আগে । তবুও তা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিমান হামলা । সেই হামলায় পাক-বাহিনী আত্মসমর্পন করে । রুমিদের বেশ ক'টি গেরিলা আক্রমনে কিছু পাক-সেনা নিহত হয়। এরপর একসময় বাসা থেকে রুমিকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে জামী এবং পিতা শরীফকেও। রুমীর পিতা শরীফকে প্রচন্ড বেত্রাঘাত এবং নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়। জামীর উপর চালানো হয় অমানুষিক অত্যা*চার। পিতার সাথে তাকেও ছেড়ে দেয়া হয় । জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফের উপর এই নির্যাতন এবং অপমানের আত্ম-অনুশোচনার সমাপ্তি ঘটে ১৩ ডিসেম্বর রাতে হার্ট-এ্যাটাক এবং পরে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
রুমি আর ফিরে না আসায় জাহানারা ইমাম পাগলার দরবারে যায় ছেলে ফিরে আসার প্রত্যাশায়। একজন মা হিসেবে সন্তান ফিরে আসবে প্রতীক্ষার কালক্ষেপনের জন্য মগবাজার পাগলা বাবার দরবার যাওয়া, এতিমখানায় খাসী,গরু কোরবানি দেয়া এসব নেহাতই মানসিক শান্তনার জন্যই করতে থাকেন তিনি । এভাবে চলতে চলতে যুদ্ধের দিন ঘনিয়ে আসে চারদিকে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। ১৪ ডিসেম্বরের আগের দিন স্বামী শরীফ ছাদের উপর উঠে প্রথম ঘামতে থাকে তারপর ডাক্তার ডাকা, হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া এবং মৃত্যুবরণ। ১৪ ডিসেম্বর এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থিত বাসার পাশের গলিতে তাঁর দাফন জানাজা হয় তাঁর।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের দিনটিতে তিনি লিখেছেন, ' আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল। মঞ্জুর এসেছিলেন, বাড়িতে যাঁরা আছেন, তারাও সবাই ছাদে উঠলেন। ২৫ মার্চ যে ফ্লাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্লাগপোলটাতেই আজ আবার সেদিনের সেই পতাকাটাই তুললাম।
সবাই কাঁদতে লাগলেন। আমি কাঁদতে পারলাম না। জামীর হাত শক্ত মুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।...রুমী! রুমী কি বেঁচে আছে? আমি কি করে খবর পাব ? কার কাছে খবর পাব? শরীফ এমন সময়ে চলে গেল? দু'জনে মিলে রুমীর জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাম, রুমীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন একাই আমাকে সব করতে হবে, একাই সব কষ্ট বহন করতে হবে। '
বইটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির সাথে সাথে একজন স্বামী-সন্তান হারা জাহানারা ইমামের বুকফাটা আর্তনাদ উঠে এসেছে। তবে মেজর জিয়াউর রহমান পঁচিশে মার্চের ক্রাকডাউনের পর চট্টগ্রাম কালুরঘাটে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর যে ঘোষণা দিয়েছিলেন এর উল্লেখ না থাকাটা এই ডায়েরীর একটা বড় রকমের ঘাটতি।