চেনা পথ, চেনা মুগ্ধতা ।। মিফতাহুল জান্নাত শিশির

মুগ্ধ হাতে হাত রেখে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলছিলো
অন্বেষা, ঝামেলা করোনা একবার বিয়েটা হয়ে যাক, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে । আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিলাম-
কিছুই ঠিক হবেনা। এখন যখন কিছু ঠিক নেই,  পরেও কিছু ঠিক হবেনা আমি নিশ্চিত।
সেদিন আর মুগ্ধ কথা বাড়ায়নি। হন হন করে হেঁটে গিয়েছিলো। পিছন ফিরেও তাকায়নি। হয়তো ওর সেদিন অনেকটা রাগ হয়েছিলো আমার উপর। সেদিনের পর আমিও একটা চাকুরীতে যোগদান করি, মাইনেও ভালো। যদিও চাকুরীটা আমার খুব প্রয়োজন না। সমাজের মানুষের মুখ আটকাতেই চাকুরীতে যোগদান করা। বিশেষ করে মুগ্ধ'র মায়ের।
ইতিমধ্যে দেড় বছর পার হয়ে গেল। মুগ্ধ আজও আমায় ভুলতে পারেনি। প্রায়ই ফোন করে, টেক্সট পাঠায়। বোঝানোর চেষ্টা করে আমাকে । আমি পাথরে গড়া মূর্তি নই, মুগ্ধ'র কষ্ট গুলো বুঝি। আমারও কষ্ট হয়। মুগ্ধ'র টেক্সটে বিরক্ত হতে হতে আমিও একটা টেক্স করলাম- " যদি আমার কথা গুলো শুনতে চাও তাহলে অফিসে এসো।  দেখাও হবে, কথাও হবে।
মুগ্ধ আসার পর আমি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঘড়ির কাঁটায় বিকেল পাঁচটা। স্পিকারে রোমান্টিক ইন্সট্রমেন্টাল মিউজিক বাজছে। আমি আর মুগ্ধ পাশা পাথি বসে। হাতের মুঠোয় আরেকটি চেনা হাত।  চেনা বিকেল। টেবিলে আমার আর মুগ্ধ'র সামনে দুটো কফির মগ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। চিকেন শর্মার ফয়েল ছাড়াতে ছাড়াতে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম-
- কি বলবে বলো ।
- অন্বেষা, আজও ভালোবাসি তোমায় ঠিক আগের মতো করেই । তখন আমি স্বাবলম্বী ছিলাম না। ভালোবাসার সাথে অর্থের যোগান থাকাও জরুরী। তুমি একটা কাজ করো,  আঙ্কেলকে বলো আমার মা যে জিনিস গুলো যৌতুক হিসেবে চেয়েছে সেগুলো আমিই কিনে দেব। আঙ্কেল সেগুলো জাস্ট আমার বাসায় পাঠিয়ে দেবেন।
- তোমার মা কি চান যে আমাদের বিয়েটা হোক ? যদি তিনি চান, তবে কালতো অফিস ছুটি তুমি আন্টি আর আঙ্কেলকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসো।
মুগ্ধের বাবা মায়ের সামনে যে কথা গুলো বলতে হবে আব্বুকে তা সব শিখিয়ে দিলাম। পরের দিন বিকেলে মুগ্ধ তার বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলো। তাদেরকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে আমি দৌড় দিলাম কিচেনে। কাজের মেয়ে বুলবুলিকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়ে বললাম- তুই এগুলো নিয়ে যা, আমি চা নিয়ে আসছি। চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আন্টি বললেন-
- এতো কষ্ট করে এগুলো করার কি দরকার ছিলো মা ?
শুনে আমি একটু হাসলাম। আন্টি আমার আব্বুকে বললেন,
- ভাই সাহেব, এই বিয়েটা দেড় বছর আগেই হবার কথা ছিলো,  যদি তখন আপনি রাজি থাকতেন। শুনে আমি বললাম-
- আন্টি তখনও রাজি ছিলেন, এখনও রাজি আছেন।  রাজি ছিলাম না শুধু আমি । আন্টি বললেন-
- তবে তুমি এখন রাজি আছো মা ?
- জ্বী আন্টি আমি রাজি, তবে একটি শর্ত আছে । বিয়ের পর মুগ্ধ আমাদের বাড়িতেই থাকবে ।
 - এটা কেমন শর্ত মা?  বিয়ের পর মেয়েরা ছেলের বাড়িতে থাকে এটাই নিয়ম ।  শুনে আব্বু বললেন-
- যৌতুক হিসেবে আমি যখন এতো কিছু দেবো, তার বিনিময়ে আপনি  আপনার ছেলেকে দিবেন, সে ঘর জামাই হয়ে থাকবে।
- তা হয়না। আমার ছেলে ঘর জামাই থাকবে নাকি ?
বিরক্ত হয়ে আব্বু বললেন-
তাহলে আপনি যেগুলো যৌতুক চেয়েছেন, আপনি সে গুলো আমাকে দেবেন আমি আমার মেয়েকে আপনাদেন দেবো। এ কথা শুনে আন্টি বললেন-আপনি আমাদের কাছে যৌতুক চাচ্ছেন ! আমি বললাম-
-না আন্টি, আব্বু যৌতুক চাচ্ছেন না,  শুধু আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আন্টি রেগে আঙ্কেলের হাত টেনে ধরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। মুগ্ধ আমার হাত টেনে ধরে বারান্দায় নিয়ে এসে বললো-
- এ কি শুরু করেছো তুমি ?  আমি তো সব টাকা দিতেই চাইলাম, তার পরেও কেন এমন করছো ?
-আমি যৌতুককে করি তুমি জানো না?  আব্বুও তো রাজি ছিলো দেড় বছর আগেই, রাজি ছিলাম না আমি।  তখন আমার চাকরী ছিলোনা বলে কি বলেছিলো তোমার মা মনে নেই তোমার ? টাকা তুমি দাও আর আব্বুই দিক, সেটা দিয়ে যৌতুকই কেনা হবে। লোকে কি বলবে যৌতুক দিয়েই বিয়ে হয়েছে। বিয়ে যৌতুক ছাড়াই হবে,  নাহলে কোন দিনও হবেনা। যাও, বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ডিসিশন নিয়ে আমায় জানাবে। আর তেমার সিদ্ধান্ত যদি " না " তবে আর কখনো আমাকে ফোন কিংবা টেক্স দেবেনা। পাঁচ বছরের সব স্মৃতি মুছে ফেলবো আমি।
আজ কথা গুলো মুগ্ধকে বলতে পেরে আমার বুকের উপর থেকে যেন একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেল। মুগ্ধ'র চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিলো। আমারও বলতে ইচ্ছে করছিলো, আমি তো বাধ্য হয়েই করেছি এ সব তুমি তা বুঝো না? আজ আমি যদি যৌতুক সহ তোমাকে বেছে নেই, তাহলে কতো মেয়ে যৌতুকের শিকার হবে তুমি তা বুঝোনা ?
মুগ্ধ'র হাত আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম-
- বাসায় গিয়ে প্রপার ডিসিশন নাও। ভাগ্যে থাকলে তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে, যৌতুক আটকাতে পারবে না আমাদের । ফোন দিও, তোমার " হ্যাঁ " শুনবার অপেক্ষায় রইলাম।
দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামে রাত ৩ টার সংকেত বেজে উঠলো। স্বপ্নেই কেমন যেন একটা শব্দ কানে বেজে উঠছে আমার ঠিক বুঝতে পারছিনা। একটানা রিং বেজেই চলেছে। রিসিভ করতেই মুগ্ধ বললো-
-যৌতুকের কাছে আমাদের ভালোবাসা হেরে যায়নি অন্বেষা, আমরা জিতে গেছি।
খুশিতে আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো। সুখেও যে মানুষ কাঁদে এই প্রথম বুঝলাম।
-কিভাবে রাজি করালে আন্টিকে? ইমোশনাল ব্লাকমেইল করোনি তো ?
-আরে নাহ , ওয়েট ফর ফার্টনাইট। এই গল্পটি সেদিনই শোনাবো। হাসতে পারবেনা কিন্তু ! তুমিও ওয়াইট করো আমিও তোমার গল্প শুনবার জন্যই  আসছি। কারন-এপথ যে আমার বড্ড চেনা। চেনা বাঁশির সুরেই আমি মুগ্ধ হতে চাই। আমি চাই আমার স্বপ্নের  আকাশে ডানা মেলুক  শঙ্খচিল, সু্খের শ্বেত পায়রা । 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।