চিন্তাচেতনা ও আদর্শগত দিক থেকে যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্যা। সর্বসাধারণের নিকট যিনি ‘বিবিদি’ নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি প্রথম যুগের গানের ভাণ্ডারী সঙ্গীতশিল্পী, লেখক ও অনুবাদক ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। পিতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতা জ্ঞানদানন্দিনী আর পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতা জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী, বিদুষী ও প্রগতিশীল মহিলা।
১৮৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর পিতার কর্মস্থল তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশের কারোয়ারে (বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যে) জন্মগ্রহন করেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। পৈতৃক নিবাস কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই সন্তান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইন্দিরা দেবী। দুজনেই ছিলেন কৃতি ব্যক্তিত্ব। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর চেয়ে দেড় বছরের বড়। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন একজন বিশিষ্ট সংগীতবিদ লেখক ও অনুবাদক। রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান ছিল।
১৮৭৭ সালে মা জ্ঞানদানন্দিনীর সাথে ভাই সুরেন্দ্রনাথ সহ তিনি পারি জমান ইংল্যান্ডে। বছরখানেক পর রবীন্দ্রনাথও ইংল্যান্ডে চলে গেলে কবিগুরুর নিবিড় সান্নিধ্যে বেড়ে ঊঠেন তারা দুই ভাইবোন। সুরেন্দ্রনাথ এবং ইন্দিরা দেবীকে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন কবিগুরু। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এর উপর তালিম নেন। কবিগুরুর অসংখ্য গানের নোটেশন লিখেছেন তিনি। এছাড়াও তিনি কিছু ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৮৮১ সালে প্রথমে সিমলার অকল্যান্ড হাউজে এবং পরে কলকাতার লোরেটা হাউজে পড়াশোনা করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি এন্ট্রান্স ও পরে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে তিনি ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম বি.এ পাশ করেন। ইংরেজি ও ফারসী ভাষায় বি.এ পড়েছিলেন তিনি। ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে তিনি ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবং বাদ্রিদাস মুকুলের নিকট উচ্চাঙ্গসঙ্গীত (কণ্ঠ) শিক্ষা নেন।
১৮৯৯ সাল, ইন্দিরা দেবীর বয়স যখন ছাব্বিশ বছর তখন আইনজীবী, প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে বিয়ে হয়।
অনুবাদক হিসেবে ইন্দিরা দেবী অল্পবয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। কৈশোরে তিনি রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ও মাতা জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত 'বালক' পত্রিকায় রাস্কিনের রচনার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরে ফরাসি শিখে তিনি 'রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ', 'পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাশ্রম', এবং মাদাম লেভির 'ভারতভ্রমণ কাহিনী' অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতার ও রচনার দক্ষ অনুবাদ ছিলেন ইন্দিরা দেবী। রবীন্দ্রনাথও তার অনুবাদ পড়ে সবসময় সন্তোষ প্রকাশ করতেন। ইন্দিরাই প্রথম রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে বামাবোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী,সাধনা,পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সঙ্গীত ও সাহিত্যবিষয়ে তাঁর অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। বঙ্গনারীর শুভাশুভ বিষয়ে তাঁর মতামত ‘নারীর উক্তি’ নামক প্রবন্ধে বিধৃত হয়েছে।
ইন্দিরা দেবী অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। সঙ্গীত বিষয়েও তার জ্ঞান ছিল অগাধ।রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি পিয়ানো, বেহালা ও সেতারবাদনে পারদর্শিনী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা তাঁর এক অমর কীর্তি। ‘মায়ার খেলা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘কালমৃগয়া’ প্রভৃতিসহ আরও দুশো রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু স্বরলিপি গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেন। তিনি বেশ কিছু সংগীত বিষয়ক বই লিখেছেন। তার মধ্যে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে একযোগে লিখিত ‘হিন্দু সংগীত’ গ্রন্থের (১৩৫২ বঙ্গাব্দ) ‘সংগীত পরিচয়’ নামক প্রাথমিক অংশ উল্লেখযোগ্য। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত এর তথ্য এবং তত্ব দুটিকেই সমৃদ্ধ করেছেন সমান হারে।
তাঁর কণ্ঠধৃত সুরে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি গানও রচনা করেছেন। মহিলাদের সঙ্গীতসঙ্ঘের মুখপত্র আনন্দ সঙ্গীত পত্রিকার তিনি অন্যতম যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে যুক্তভাবে লিখিত হিন্দুসঙ্গীত তাঁর সঙ্গীতচিন্তার পরিচায়ক। তাঁর নিজের রচিত কিছু গান স্বরলিপিসহ সুরঙ্গমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ইন্দিরা দেবীর কয়েকটি মৌলিক রচনা হলো: শ্রুতি স্মৃতি, রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম (১৯৫৪) ও রবীন্দ্রস্মৃতি (৫ খন্ড, ১৯৫৯)। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ১৯২০ সালে প্রকাশিত 'নারীর উক্তি',১৯৫৬ সালে প্রকাশিত 'বাংলার স্ত্রী-আচার', ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত 'স্মৃতিকথা', 'পুরাতনী' ও গীতপঞ্চশতী।
১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ‘ভুবনমোহিনী’ স্বর্ণপদক, ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি এবং ১৯৫৯ সালে রবীন্দ্রভারতী সমিতি প্রথমবারের মতো ‘রবীন্দ্রপুরস্কার’-এ ভূষিত করে। ইন্দিরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কাকু আজীবন আমাদের সাহিত্য, সঙ্গীত এবং চিত্রকলা শেখার জন্যে উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন। তাঁর শেষ জীবনের প্রান্ত ভাগে এসে সেই চিত্রকলাকে প্রাণপণে আকঁড়ে ধরেন নিজস্ব চিন্তাধারা দিয়ে। চিত্রকলার কিছু আদিরূপ অঙ্কনে তিনি আমাদের নিয়োজিত করেন। যেগুলোকে বলা যায় মেয়েলী ধাঁচের কিছু চিত্র আঁকা চর্চা। রবি কাকু সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সব সময় মনে হয় তিনি যৌবনের চেয়ে বৃদ্ধ বয়সে বেশি সুন্দর মানুষে পরিণত হন। আচকান আর জোব্বা ছেঁটে ছোট করা হয়। নারী-পুরুষের ছিল কুর্তা এবং পায়জামা। রবি কাকু বাইরে যাবার সময় ধূতি এবং চাদর ব্যবহার করতেন। কখনো সঙ্গে নিতেন শাল। জোব্বা তিনি পরিহার করে চলতেন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিমলাতে উডফিল্ড নামের বাড়িতে বেশ কিছুদিন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। কাকা ও ভাইঝির নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই বয়সের পার্থক্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ইন্দিরা দেবী বলেন, ‘আমি মনে করি ঠিক তখন তাঁর চামড়ায় পরিবর্তন এসে রুক্ষতা ভর করেছিল এবং তাঁর থাক থাক চুল এবং সাদা দাঁড়ি তাকে এনে দিয়েছিল ঋষী অথবা বৃদ্ধ ভবিষ্যত দ্রষ্টার সৌন্দর্য।' ১৮৮৮ সালে ২৭ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ পিতার আদেশে শিলাইদহে আসেন। এখান থেকে ইন্দিরা দেবীকে সর্বোচ্চসংখ্যক চিঠি লেখেন কবি। এই চিঠিগুলোর কথা ইন্দিরা দেবীর বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। তাঁর রচনা থেকে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁদের পরিবারের নানা তথ্য যেমন জানা যায়। তেমনই জানা যায়, তাঁর নপিসিমা স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবীর সঙ্গে তাঁর হরিহর-আত্মা সম্পর্কের কথা।
সঙ্গীত বিশারদ,অনুবাদক হবার পাশাপাশি তিনি নিজেকে সামাজিক উন্নয়নেরও অংশীদার করেছেন। বাবার পথ ধরেই মহিলা শিক্ষা লিগ, সর্ব ভারতীয় মহিলা সম্মেলন, সঙ্গীত সংঘ, সঙ্গীত সম্মেলন সহ আরো নানান কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন।রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর স্বামীর সঙ্গে তিনি শান্তিনিকেতনে স্থায়িভাবে বসবাস করেন এবং তখন থেকেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাদান করেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে বিশ্ব ভারতীর ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেন। এখানে ইন্দিরা দেবী ‘আলাপনী মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা ও তার মুখপত্র ঘরোয়া প্রকাশ করেন। মহিলা কল্যাণে গঠিত ‘বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশন লীগ’, ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’, ‘হিরণ্ময়ী বিধবা আশ্রম’ ইত্যাদি সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬০ সালের ১২ আগস্ট ঠাকুর পরিবারের নবজাগরণের অংশীদার মহীয়সী সাহিত্যিক এবং সঙ্গীত বিশারদ ইন্দিরা দেবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।